DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

পরিবেশ বিপর্যয় ও শ্রম ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে চলেছে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প

images5দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ  বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প শ্রমিকের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা হয়তো কেউ ভাবতেও পারবেন না। বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের কর্ম পরিবেশ, মজুরি আর আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা মিলিয়ে একজন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকের অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা নিয়েই আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন। । প্রতিবেদনটিতে একজন জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিকের প্রকৃত জীবন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। 

৩৪ বছর বছর বয়সী জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক মাসুদ। দেখতে অনেক শুকনো বলে মনে হলেও বেশ পেশীবহুল তিনি। তার বাহু এবং হাতের বিভিন্ন স্থানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ট্যাটুতে ভরপুর। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি শারীরিকভাবে কতটা বিধ্বস্ত। তার গায়ে থাকা লিনেন শার্টের উপর দিয়ে শরীরের হাড়গুলো বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিল। বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতের পাশে জাহাজ ভাঙ্গার কাজেই সারাদিন কাটে তার। সূর্যোদয় থেকে শুরু করে প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা তাকে সেখোনে কাজ করতে হয়। আর এই কর্মক্ষেত্রেও থাকে রাগী বসের চোখ রাঙানি। সেখানে তপ্ত পরিবেশের মধ্যে তাকে কাজ করতে হয় যেখানে সামান্য ছায়ার ব্যবস্থাও নেই।

কাজের শেষে একদিন সন্ধ্যায় তার সাথে চট্টগ্রামের কোনো এক চত্বরে ‘ভাইস নিউজ’ পত্রিকার সাংবাদিকেরা দেখা করেন। তখন ছিল অত্যন্ত তাড়াহুড়োর সময় এবং আশেপাশের বাস-রিকশার চালকেরা গন্তব্যে ফিরবার জন্য একটানা হর্ণ বাজাচ্ছিল। আশেপাশের শব্দের আওয়াজ এতই বেশি ছিল যে মাসুদের কথাগুলো শোনাই যাচ্ছিল না। যদিও সে জোরে জোরে বলার জন্য চেষ্টা করছিল।

কথায় কথায় তিনি বলছিলেন গত ১৫ বছর যাবত তিনি জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে কাজ করছেন। মাসুদের বাড়ি বাংলাদেশর উত্তরঙ্গের দরিদ্র এলাকায়। যখন তার বয়স ১৯ তখন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের এক নিয়োগকর্তা তার এলাকায় এসে তাকে এই শিল্পে কাজের প্রস্তাব দেয়।মাত্র কিছুদিন আগেই মৌসুমী বৃষ্টির প্রভাবে তাদের পরিবারের সব জমিজমা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এমন সময়ে হয় তার পরিবারসহ উপোস করা অথবা চাকরী প্রস্তাবকারী লোকটির প্রস্তাব গ্রহণ করে উন্নত চট্টগ্রামে কাজ করা এই দুইটি সুযোগই তার হাতে ছিল। যখন ঐ লোকটির সাথে মাসুদ চট্টগ্রামে আসছিল তখন লোকটি তার পরিবারকে ৮ শত টাকা দিয়ে এসেছিল।

যাইহোক, মাসুদ এখন বিশ্বের অন্যতম বড় একটি জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। সে এখন পুরোনো সুপার ট্যাঙ্কস, নষ্ট জাহাজ, কার্গো ইত্যাদি ভাঙ্গাভাঙ্গির কাজ করে যেগুলো পুরোনো থেকে আবার পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। কিন্তু যেখানে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ ও অনুকূল পরিবেশে কাজ করার কথা সেখানে তারা চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলের টানা আট মাইল একটি ময়লা বীচের মধ্যে কাজ করছে। এখানে মানা হয় না কোনো শ্রমিক আইন। তাছাড়া এখানে প্রচুর পরিমাণে সস্তা শ্রমেরও ব্যবহার হচ্ছে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন মাত্র ১৬০ টাকার বিনিময়ে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ করে। যদিও এইসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা দাবি করে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য সকল প্রযোজনীয় সরঞ্জামাদিই এখানের সরবরাহ করা হচ্ছে কিন্তু শ্রমিকরা বলছে তাদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই পাচ্ছে না তারা।সেখানে তারা খোলা হাতেই জাহাজ ভাঙ্গার কাজে করে যেখানে প্রচুর পরিমাণে এসিটিলিনের মত বিষাক্ত গ্যাস আছে।

জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি এনজিও ‘শিপ ব্রেকিং প্লাটফর্ম’র ভাষ্য অনুযায়ী, এখানে কাজ করা আধুনিক সময়ের দাসত্বের ন্যায়। তাছাড়া তারা আরোও বলছেন, এখানে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে ২০ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নীচে।

এক হিসেব মতে, প্রতি বছর প্রায় দেড়শো থেকে দুইশো নষ্ট জাহাজ চট্টগ্রামের উপকূলে পড়ে থাকে। অফিসিয়াল হিসেবে মতে, ২০১৩ সালে এখানে ২০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। যদিও এই নিহত হওয়ার আসল সংখ্যাটা অজানাই থেকে যায় কারন সব শ্রমিকরা এখানে অফিসিয়ালি নিবন্ধিত না। তাছাড়া শিপ ইয়ার্ডের মালিকরা এইসব দুর্ঘটনার খবর জানানো থেকে এড়িয়ে চলেন।

ইয়াং পাওয়ার ইন সোস্যাল একশন (ডব্লিউ পি এস এ)নামের একটি স্থানীয় পর্যবেক্ষণকারী দলের হিসাব মতে এখানে প্রতিসপ্তাহে একজন শ্রমিক মারা যায়। এছাড়া শিপ ব্রেকিং প্লাটফর্মের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে এখানে এক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ দুর্ঘটনায় ৪ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে এবং আরও ৩ জন শ্রমিক মারাত্নকভাবে আহত হয়েছে। কিন্তু বিষাক্ত গ্যাসীয় পরিবেশে কাজ করা অসংখ্য শ্রমিকের কথা কোনো হিসাবেই নেয়া হয় না। এইখানে কাজ করে ৪০ বছর বয়সী প্রায় শ্রমিকই ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছেন।

মাসুদ বলেন, এইখানে কাজ করতে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও প্রতিদিন আমি কাজে যাই। তিনি আরও বলেন, এখানে কাজ করার সময় এক বিষ্ফোরনের ঘটনায় চোখের সমানেই আমার বৃদ্ব বাবা নিহত হয়েছে। এখানে কাজ করে তার অনেক সহকর্মীকেই তিনি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের স্বীকার হতে দেখেছেন। মাঝে মধ্যে স্টীলের পাত পড়ে গিয়েও এখানে অনেকে মারা যায়। মাসুদ আরও বলেন, এখানে কাজ করা একরকমের নকআউট খেলার মত। তিনি নিজেও অনেকবার বিভিন্নরকমের দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছেন।

বিষাক্ত এসবেসটস গ্যাসের গন্ধ পরিবেষ্টিত পরিবেশের মধ্যেই মাসুদ প্রতিদিন কাজ করে। তিনি সবচেয়ে বেশি খান সবজি; এমনকি কখন যে শেষ মাংস খেয়েছেন তাও মনে করতে পারছেন না। কিন্তু এই খাবারটুকুও তার কাছে এসবেসটসের মতই মনে হয়। এমনকি তার পরিধেয় কাপড়চোপড়েও এসবেসটসের গন্ধ পাওয়া যায়।

এইসব জাহাজভাঙ্গা শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে আন্তজার্তিক সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও এই শিল্পটিই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। এই শিল্পে থেকে প্রতিবছর প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের মত আয় হয় এবং বাংলাদেশের প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিক এখানে কাজ করে। এই জাহাজ ভাঙ্গাই বাংলাদেশের স্টীলের প্রধান উৎস।তাছাড়া এর কারনেই বিদেশ থেকে ধাতু আমদানি কমছে। বাংলাদেশ সরকার এই শিল্প থেকে প্রতিবছর ১ শত ৩০ মিলিয়ন ডলারের মত রাজস্ব আয় করে। যেহেতু দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই এই শিল্পের বিকাশ ঘটছে,তাই প্রতিবছরই চট্টগ্রামে পুরোনো জাহাজের পরিমাণ বাড়ছে।

অন্যদিকে, ডব্লিউ পি এস এ’র মোহাম্মদ আলী শাহীন মনে করেন সামনের দিনে এই শিল্প আরও আগ্রাসী এবং প্রতিযোগিতামূলক হবে। এছাড়া এর কারনেই দূষণের পরিমাণও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন বিষয়ে কোনো আইনের প্রতিই নজর দিচ্ছে না বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের এক আদেশে বলা হয়েছে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। এমনকি নির্দিষ্ট কোনো এলাকা ছাড়া এসব শিল্পের কাজ হওয়া উচিত না।কিন্তু সরকার এই আদেশের কোন কর্ণপাতও করছেন না এবং এই আইনের কোন প্রয়োগ করছেন না।বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি( বেলা)’র মতে , সরকার কেবল লাভের কথাই বিচেনা করছে। এশিয়ার মত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যেসব দেশে জাহাজভাঙ্গা শিল্পের কর্মপরিবেশ খারাপ সেসব দেশে এই শিল্প নিষিদ্ধ করতে আইন প্রয়োগ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বিশ্বজুড়ে ১২১৩ টি বাণিজ্যিক জাহাজ ভাঙ্গা হয়েছে। এইসব ভাঙ্গাভাঙ্গির বেশিরভাগ কাজ হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানে, যেখানে পরিবেশ আর শ্রম আইনকে খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়। তুরস্ক এবং চীনে এই সব জাহাজ ভাঙ্গার কাজ অনেক পরিবেশবান্ধব পদ্বতিতে করা হয়।সাগরের পানিতে যাতে বিষাক্ত গ্যাস মিশে যেতে না পারে এই বিষয়টিও এখানে কঠোর ভাবে লক্ষ্য করা হয়।এছাড়া এইসব দেশে শ্রম আইনের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হয়।তার মানে হচ্ছে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প থেকে কম আয় হয় তুরস্ক এবং চীন জাহাজ ভাঙ্গার জন্য প্রসিদ্ধ নয়।

এই বিষয়টি বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস এসোশিয়েশনের সাবেক সভাপতির নজরে এনে তার কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে এই শিল্পের সমালোচনা বেড়ে যাওয়ায় ইদানীং এই শিল্পে কিছুটা বিপর্যয় জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা ট্যুরিস্টদের কাছে এক সময় অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয় থাকলেও কিন্তু আজকাল ট্যুরিস্টরা এসব দেখার জন্য আর আসছে না।

মূলত, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প শ্রমিকদের জীবন একরকম দু:সহ আর তারা এখানে বেশ অবিচারেরও স্বীকার হয়। কেউ কেউ আবার এখান থেকে পালিয়েও যায়। বেশিরভাগ শ্রমিকেরই এখান থেকে সরে যাবার কোনো সুযোগ থাকে না। তারা পারে না জীবনের অন্যরকম অভিজ্ঞতা গুলো উপভোগ করতে। শ্রমিকরা তাদের স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে উপোষ থাকবার চেয়ে কষ্টের এই কাজ করেও কোনোরকম খেয়ে বেচে থেকেই সুখ বোধ করে।

পরিশেষে মাসুদ বলেন, তিনিও এখান থেকে পালাতে পারতেন কিন্তু তিনি জানেন এটি একটি মিথ্যা আশা মাত্র। এখন তার একটাই আশা কোনো দুর্ঘটনা যেনো তাকে তার স্ত্রী পুত্রের কাছ থেকে কেড়ে না নেয়।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!