DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রেলমন্ত্রীর পিএ মোশাররফ হোসেন

unnamedদৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ   কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমিজমা নিয়ে আছেন বিপাকে। কারণ দখলদারদের তোপের মুখে নিজের বসতভিটাটিও হারাতে বসেছেন ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ। ‘জীবনের শেষ বেলায় এসে এভাবে দখলবাজদের কাছে জীবন জিম্মি হবে, তা কখনো চিন্তাও করিনি বাবা। ছেলেরা কেউ বিদেশে, কেউ ঢাকায় থাকে। গ্রামে আমরা বুড়োবুড়ি। কখন এসে সন্ত্রাসীরা হামলা করে এই আতঙ্কে দিন কাটে।’ বলছিলেন আব্দুল মান্নান।

 

 

 

কাশিনগর বসন্তপুরে আব্দুল মান্নানের মতো এমন অনেক পরিবারের দিন কাটছে আতঙ্কে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দখলবাজির মুখে সবাই কোণঠাসা। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ওই গ্রামের অনেকেই। হামলা-মামলার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না কেউ।

 

স্থানীয় সূত্র ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) মোশাররফ হোসেনের ইশারায় এসব হচ্ছে বসন্তপুরে। তিনি বেশির ভাগ সময়ই থাকেন ঢাকায়। মন্ত্রী এলাকায় গেলে তার সঙ্গে যান। কিন্তু ঢাকায় বসেই স্থানীয় অনুসারী, অনুগামীদের দিয়ে ঠিকই রামরাজত্ব কায়েম করেছেন চৌদ্দগ্রামে। এলাকায় আছে তার ক্যাডার বাহিনী।

 

গত মার্চে উপজেলা নির্বাচনের সময় এই মোশাররফ হোসেন প্রকাশ্যে সাংবাদিককে হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এক মিনিট কেন্দ্রে থাকলেই তোদের লাশ পড়বে, সাংবাদিক মারলে কী হয়?’ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে উপজেলা নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের এভাবে প্রকাশ্যে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার পরও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে। বরং পুলিশের সামনেই এভাবে বুক ফুলিয়ে শাসিয়েছেন রেলমন্ত্রীর পিএ।

 

ভুক্তভোগী আব্দুল মান্নানের পরিবার তাদের ওপর অত্যাচারের প্রতিকার চেয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি আমলে নিয়ে বিষয়টি কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) দেখার জন্য লিখিত নির্দেশ দেন। কুমিল্লা জেলা এসপি বিষয়টি মীমাংসার জন্য চৌদ্দগ্রাম থানাকে নির্দেশ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। ভুক্তভোগীরা বিষয়টি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকেও লিখিতভাবে জানিয়েছে।

 

চৌদ্দগ্রামের স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় মোশাররফ হোসেনের ক্যাডার বাহিনী সব সময়ই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা করে। তারা আওয়ামী লীগ ও রেলমন্ত্রীর আস্থাভাজন এই পরিচয় খাটিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকেও দাপিয়ে বেড়ায়। রেলমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলছে এই চক্র। অথচ রেলমন্ত্রী এসবের সাতেও নেই পাঁচেও নেই।

 

সূত্র দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে জানায়, মোশাররফবাহিনীর অন্যতম সদস্য মাসুদুর রহমান। যিনি কাশিনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এই মাসুদকে পরিচালনা করেন মোশাররফ। মূলত তার হুকুম বাস্তবায়ন করাই মাসুদের কাজ। স্থানীয়রা জানায়, মাসুদের কোনো অক্ষরজ্ঞান নেই। এ ছাড়া পারিবারিকভাবেও তাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। কয়েক দিন আগেও শুধু রাইস মিল চালিয়ে পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতেন তিনি। কিন্তু মন্ত্রীর পিএর সঙ্গে থেকে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মাসুদ।

 

স্থানীয়রা আরো জানায়, একসময় এলাকায় শামসু ডাকাত বলে পরিচিতি ছিল তার। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় এসেছে ডাকাত পরিচয় বাদ দিয়ে এখন তিনি শামসুল হক। তিনিও রেলমন্ত্রীর পিএর লোক বলেই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে আসছে হরহামেশা। কাশিনগর বসন্তপুর এলাকার একসময়ের ত্রাস শামসুল হক ও আনাল হক স্থানীয়দের চাপের মুখে দেশ ছেড়েছিলেন। এখন তারা আবার ফিরেছেন। সঙ্গে আছে আগেই সেই চরিত্র। এর বাইরেও অনেকেই আছেন মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। যাদের কাজই হচ্ছে মোশাররফের হুকুম তামিল করা। অভিযোগ আছে, কিছুদিন আগে আনাল হক তার এক ভাতিজাকে গুম করে নিয়ে যায়। পরে প্রশাসনের চাপের মুখে পাঁচ দিন পর ভাতিজাকে মুমূর্ষু অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখে।

 

জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমি আগে শুনিনি। কেউ আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে এলে আমি বিষয়টি যাচাই করে দেখব।’  

 

তবে রেলমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মোশাররফ হোসেনের দাবি, তার বিরুদ্ধে এলাকায় কোনো অভিযোগ নেই। তিনি প্রথমবাংলাদেশ ডট নেটকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ সবই ভুয়া। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। আব্দুল মান্নান ও তার পরিবারের সদস্যরা জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা কদিন আগেও এলাকায় নাশকতা সৃষ্টি করেছে।’  

 

উপজেলা নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের হত্যা হুমকি ব্যাপারে জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সাংবাদিকদের মধ্যে এলাকায় আমার প্রতিপক্ষরা এসব খবর ছেপেছে। আমি কাউকে হত্যা করতে চাইনি।’   

 

কাশিনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমানের অভিযোগ, আব্দুল মান্নানের সঙ্গে শামসুল হকের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব চলছে। তারা কেউ মীমাংসার জন্য তাদের কাছে যায়নি। অথচ উল্টো তাদেরই দোষারোপ করছে। তিনি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ কে বলেন, ‘গ্রামের ঝামেলা গ্রামেরই ভাঙতে হবে। এদিক-সেদিক দৌড়ঝাঁপ করে লাভ নেই।’ তবে নিজেদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও দখলবাজির সব অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

 

দখলবাজিতে এগিয়ে মোশাররফ বাহিনী

 

অন্যের জমি জোরপূর্বক দখল নেওয়াতে এগিয়ে আছে মোশাররফ বাহিনী। কাশিনগর বসন্তপুর গ্রামে অনেকেই জমিই বেহাত হয়েছে এই বাহিনীর তোপের মুখে। মুখ খুললে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছে। তাদের দাপট এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছে গিয়েও অনেকে নিরাপত্তাবঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান অভিযোগ করেন, শামসুল হকের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী তাদের বাপ-দাদার পৈতৃক সম্পত্তি জবরদখলের চেষ্টা করছে। তাদের বিরুদ্ধে উল্টো হয়রানি মামলা দিয়ে ভিটামাটি ছাড়া করতে চাইছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে জেল-জরিমানাও খাটিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকেও ব্যবহার করেছে এই চক্র। এসব সন্ত্রাসী কর্মকা-ের প্রতিবাদ করায় গত বছরের শেষ দিকে সন্ত্রাসীরা মান্নান, তার স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যদের ওপর দুই দফায় ধারালো অস্ত্রসহ হামলা চালায়। এতে পরিবারের সদস্যরা মারাত্মকভাবে জখম হয়। পরে এ ব্যাপারে মামলা করতে গেলে স্থানীয় থানা মামলা নেয়নি। পরে এ নিয়ে আদালতে মামলা করা হয়। যার নম্বর সিআর-৬৮০। আদালত থেকে এলাকায় তদন্তে গেলে থানা থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। মামলাটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সন্ত্রাসীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের জানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরে এ মামলার ব্যাপারে আদালতে নারাজি দেওয়া হলে মামলাটি কুমিল্লা জেলার ডিবির কাছে আবার তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। ডিবিতে মামলাটির নম্বর ৩৭৭। মামলাটি এখন ডিবিতে তদন্তাধীন আছে। অভিযোগ আছে, সন্ত্রাসী মামলাটির তদন্তে বাধা দিতে বিভিন্ন মহলে জোর তদবির চালাচ্ছে।

 

জানতে চাইলে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবু নাসের দৈনিক  প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘থানা থেকে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাদীপক্ষের নারাজির পর আদালত মামলাটি ডিবিতে এসেছে। এখন আবার তদন্ত চলছে। তবে একটু সময় লাগবে।’

 

আদালতের রায়ের পরও দখলমুক্ত হচ্ছে না জমি

 

আদালত থেকে জমি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একাধিক রায় থাকলেও এখন বেহাত হয়ে যাওয়া জমিতে দখল ফিরে পাচ্ছেন না আব্দুল মান্নান। তিনি জানান, জমিসংক্রান্ত একাধিক মামলার রায় আমাদের অনুকূলে থাকার পরও চৌদ্দগ্রাম থানার পুলিশ অসহযোগিতার মনোভাব দেখাচ্ছে। যে কারণে নিজেদের জমির দখল ফিরে পাচ্ছেন না তারা।

 

আব্দুল মান্নান জানান, বসন্তপুর মৌজার ছয় নম্বর জেএল এবং ১৩ নং সিএস খতিয়ানের ১৪ একর ৪৪ শতক জমি বেদখলে চলে গেছে। এ ছাড়া তিন নম্বর খতিয়ানের তিন একর ৮৯ শতক, শ্রীবল্লভপুর মৌজার, জেএল নং-৪৭১/১, চার নম্বর সিএস খতিয়ানের দুই একর ৫৪ শতক এবং গোপালনগর মৌজায় ৪৬ নম্বর খতিয়ানের ৪৭ শতক জমি দখল করে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা।

 

রেলমন্ত্রীর দেখা পাচ্ছেন না তারা

 

নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের কাছে একাধিকবার ধরনা দিলেও তার দেখা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার পিএ মোশাররফ হোসেন তাদের বের করে দিয়েছেন, এমন অভিযোগও করেছেন আব্দুল মান্নানের ছেলে ছালেহ আহম্মেদ খোকন। তিনি দৈনিক  প্রথম বাংলাদেশ কে বলেন, ‘ঈদের আগে ন্যাম ফ্ল্যাটে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে মোশাররফ আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। একপর্যায়ে গায়ে হাত দিয়ে আমাকে বের করে দেন।’ খোকনের দাবি, রেলমন্ত্রীর কাছে বিস্তারিত তুলে ধরলে তারা প্রতিকার পাবেন।

 

সাংবাদিকদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন মোশাররফ

 

গত ১৫ মার্চ সকাল ১০টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার অশ্বদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পৌঁছালে সাংবাদিকরা দেখেন, রেলমন্ত্রীর পিএ মোশাররফ হোসেন শতাধিক ক্যাডার নিয়ে কেন্দ্রের সামনে মহড়া দিচ্ছেন। এ সময় তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। সাংবাদিকরা কেন্দ্র পরিদর্শন করতে চাইলে তিনি ক্ষেপে যান। পাল্টা সাংবাদিকদের পরিচয় জানতে চান। একপর্যায়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে নিজেকে মন্ত্রীর পিএ পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের আটক করে পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেন। এ সময় মোশাররফের ক্যাডার বাহিনী সাংবাদিকদের ঘিরে ধরে গালাগাল করে। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের টানাহেঁচড়া করতে থাকে। মোশাররফ সাংবাদিকদের মারার জন্য লাঠি আনতে নির্দেশ দেন তার ক্যাডার বাহিনীকে। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে জোরপূর্বক ধাক্কা দিয়ে সাংবাদিকদের গাড়িতে তুলে দেন তিনি। ওই ঘটনায় আজও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি মোশাররফের বিরুদ্ধে। যে কারণে তিনি একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

 
 

 

 

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!