DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

সূর্যসেন হল: ছাত্রলীগের অপকর্মের আঁতুড় ঘর

সূর্যসেন হল {focus_keyword} সূর্যসেন হল: ছাত্রলীগের অপকর্মের আঁতুড় ঘর 3to2w9pq e1405457700468দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ স্বাধীনতার আগে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়টি আবাসিক হল স্থাপন করা হয় তার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী মাস্টার দা সূর্যসেন হল অন্যতম। আমৃত্যু স্বাধীনচেতা ইংরেজ শাসনবিরোধী বিপ্লবী বীর মাস্টার দা সূর্যসেনকে সম্মান জানিয়ে অবাসিক হলটির নামকরণ করা হয়। মল চত্বর সংলগ্ন হলটির উত্তর দিকে রয়েছে নবনির্মিত বিজয় একাত্তর হল এবং দক্ষিণে রয়েছে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল।

নামকরণের দিক থেকে সার্থক হলেও নানা সমস্যায় জর্জরিত হলটি। সম্প্রতি হলটি ঘুরে নানা সমস্যার কথা জানা যায়। হলের বৈধ শিক্ষার্থীরাই থাকার কক্ষ না পেয়ে গণরুম, বারান্দা, ছাদ কিংবা মসজিদে রাত কাটান। একই সঙ্গে হল ক্যাফেটেরিয়াসহ হল মেসে শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে খাবার পরিবেশন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধান অনুযায়ী, হল প্রশাসন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কথা থাকলেও কার্যত তারা কিছুই করছেন না। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা এসব শিক্ষার্থীদের মানববেতর জীবনযাপন করতে হয়। এছাড়া ছাত্রলীগ নামধারী ক্যাডারদের ‘সেইফ জোন’ হিসেবে পরিণত হয়েছে হলটি।

ছাত্রলীগের অবৈধ দখল:  

হল ঘুরে যেসব সমস্যা দেখা গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে আবাসন সমস্যা। কারণ হলের রুমগুলো অবৈধ্যভাবে দখল করে রেখেছে ছাত্রলীগ।

জানা গেছে, ছাত্রলীগের অনেক নেতা রয়েছেন যারা হলে থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি চাকরি করছেন। শুধু এসব নেতাকর্মীরাই নন ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ এবং জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের অনেক কলেজের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় হলগুলোতে অবৈধ্যভাবে অবস্থান করছে। অথচ হলের বৈধ ছাত্ররাই সিট পাচ্ছেন না।

২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, সূর্যসেন হলে ৩ হাজার ৩৯৭ জনের থাকার অনুমতি থাকলেও আবাসিক ব্যবস্থা আছে কেবল ৫৭৭ জনের। দ্বৈতাবাসিক হিসেবে আরও ৪৭০ জন থাকতে পারলেও আরও ২ হাজার ৩৫০ জনের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই।

সরজমিনে দেখা গেছে, সূর্যসেন হলের নিচতলার গণরুমগুলোর চেহারা ভিন্ন। কক্ষের সবটুকু জায়গাজুড়ে শুধুই বিছানা। পা ফেলার জায়গাও নেই। হলের শিক্ষার্থীরা জানান, ১৭৭, ১৭৮, ১৭৯, ১৮০ ও ১৮১ নম্বর কক্ষের অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে প্রত্যেকটা কক্ষে কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ ছাত্র থাকে। এছাড়াও এসব হলের ২০১/ক, ২৪৯, ৩০১, ২২৬/ক নম্বরগুলোর সবই গণরুম।

সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের আঁতুড় ঘর:

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এ হলে এমন একটি চক্র গড়ে উঠেছে যারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ এলাকায় নিয়মিত চাঁদাবাজি করে। একই সঙ্গে সেই চক্রটি ক্যাম্পাস এলাকার মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। এমন কি তাদের বিরুদ্ধে রাস্তা থেকে যাত্রী নামিয়ে বাস আটক করে মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে এসব গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং উল্টো তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। গত ১১ মার্চ গণমাধ্যমের চাপে হলে তল্লাশি চালিয়ে ২০টি ককটেলসহ প্রায় ৭০টির মত চাপাতি উদ্ধার করে প্রশাসন।

অপহরণের সেইফ জোন:  

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের একতলা থেকে (২১৯ নম্বর কক্ষের জানালা দিয়ে) ‘লাফিয়ে পড়ে’ আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সদ্য ভর্তি হওয়া তরিকুল ইসলাম (অর্ক)। তার পেছন পেছন লাফিয়ে পড়েন হলের ছাত্রলীগ কর্মী আরিফুর রহমান (লিয়ন)। তবে কী কারণে এমন ঘটনা তা জানা যায়নি।

ঘটনার পরপরই হল কর্তৃপক্ষ কক্ষটি সিলগালা করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। অনেকের মতে অপহরণগত কোনো কারণে এমনটি ঘটতে পারে।

সাংবাদিক পেটানো ছাত্রলীগ:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্তৃক সাংবাদিক আক্রমণের ঘটনা নতুন নয়। বিগত কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পাস রিপোর্টাররা তাদের বেপরোয়া হামলার শিকার হচ্ছে। গতকাল সোমবার রাতে সূর্যসেন সংলগ্ন মল চত্বরে বিভিন্ন পত্রিকা টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ার ৮ সাংবাদিককে কুপিয়ে জখম করে সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। হলের একজন সহ-সভাপতি ও একজন সহ-সম্পাদকের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন।

এদিকে এ ঘটনায় সূর্যসেন হল কমিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে এবং সহ-সভাপতিসহ ১২ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মতে, তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের প্রস্তুতি চলছে।

বিষয়গুলো জানাতে সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি মোবারক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিগত দিনে প্রশাসককে আমরা সব ধরনের সহায়তা করেছি। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে যেসব ছাত্রলীগ নেতা এসব অপকর্ম করবে তাদের শাস্তি হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো ছাড় নেই। সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় ১২ জনকে বহিষ্কার ও তিনজনকে পুলিশে দেয়া হয়েছেভ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক হল প্রভোস্ট ড. এএমএস মাকসুদ কামাল আমাদের বলেন, ‘আগে যেভাবে অবৈধ্য বহিরাগতরা হলে অবস্থান করতো এখন আর সেই সুযোগ নেই। থাকলে কয়েকজন বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান করছে। সম্প্রতি আমরা রুম বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এক্ষেত্রে রুমের সব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় যদি কাউকে পাওয়া যায় তবে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এছাড়া গত তিনমাসে হলে দুইবার তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ককটেলসহ দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এম আমজাদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সব রুমে ঢালাওভাবে তল্লাশি চালানো সম্ভব নয়। সূর্যসেন হলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে, আমরাও তথ্য সংগ্রহ করছি। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দৈনিকপ্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘আবাসন সমস্যা আগের মতো নেই। ছেলে ও মেয়েদের জন্য নতুন নতুন হল নির্মাণের ফলে আবাসন সমস্যা অনেকটাই কমে আসছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সর্বোচ্চ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

উল্লেখ্য, সূর্যসেন হলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। প্রথমে এই হলের নাম ছিল জিন্নাহ হল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় কিছু সাহসী আবাসিক ছাত্র এই হলের নাম বদলে রাখেন সূর্যসেন হল। তবে তখনো অফিসিয়ালি এই নাম গ্রহণ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ১৯৭২ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মাস্টার দা সূর্যসেন হল। অদ্যাবধি হলটি এই নামেই পরিচিত। বর্তমানে এখানে ৫ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী বসবাস করছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!