DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

অধিকাংশ শীর্ষ নেতা অন্তরীনঃ ভেঙে পড়ার মুখে জামায়াতের নেতৃত্ব

download-110 দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ ভেঙে পড়ছে জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ । বর্তমানে জামায়াতের ২৩ সদস্যের নির্বাহী পরিষদের মধ্যে ৮ জন জেলে, ৯ জন আত্মগোপনে আছেন। ৩ জন মারা গেছেন। এছাড়া একজন বিদেশে, একজন অসুস্থ এবং অপর আরেকজন দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় আছেন।এর ফলে দলীয় কর্মকান্ডে স্থবিরতা আসার দেয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম এই দলটির। 

এর বাইরে দলের চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল মহানগর কমিটির আমিরও জেলে আছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে মধ্যম ও নিচের সারির নেতারা হাল ধরেছেন কেন্দ্রীয় ও মহানগরের। জামায়াতের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, এর ফলে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় এবং সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টনে একধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।

অবশ্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির মনে করেন, জামায়াত কৌশলগত কারণে এখন চুপচাপ আছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত নেতৃত্ব পর্যায়ে কোনো সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, জামায়াতের নেতৃত্ব ভেঙে পড়েছে বা নেতৃত্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে বলে যা মনে হচ্ছে, আসলে তা নয়। জামায়াতের প্রকাশ্য অংশ ভেঙে পড়েছে বলে মনে হলেও আন্ডারগ্রাউন্ড অংশ পুরো অক্ষুণ্ন আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের দুজন সদস্য বলেন, দলের প্রথম সারির ১১ জন নেতা কারাবন্দী ও মারা গেছেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশিসংখ্যক নেতা আত্মগোপনে আছেন বা নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। এ অবস্থায় দলীয় সিদ্ধান্তগুলোর বেশির ভাগই আসছে বিচ্ছিন্নভাবে। এতে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নানা ধরনের কথা হচ্ছে। তবে এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের কেউ প্রকাশ্য হয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে চান না।

তবে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমাদের শীর্ষ নেতারা জেলে যাওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে যাঁরা নীতিনির্ধারণে আছেন, তাঁরা সর্বসম্মত প্রক্রিয়া ঠিক করে নিয়েছেন। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হচ্ছে না।’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় জামায়াতে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরের বছর ২০১০ সালের ২৯ জুন একযোগে গ্রেপ্তার হন মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, তখন থেকেই নেতৃত্বের সংকট শুরু হয় জামায়াতে। এরপর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন মামলায় গত চার বছরে আরও অনেক নেতার গ্রেপ্তার, ফাঁসি এবং মৃত্যুর ঘটনায় এ সংকট ঘনীভূত হয়।

আব্বাস আলীর পথে মকবুল আহমাদ: একসময় জামায়াতের আমির গোলাম আযম দেশে ফিরতে না পারায় এবং দেশে ফিরে নাগরিকত্ব ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা আবদুর রহিম, আবদুল জাব্বার ও আব্বাস আলী খান। আমির মতিউর রহমান নিজামী গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার পর আবার একই পরিস্থিতির মুখে পড়ে জামায়াত। নিজামী জেলে যাওয়ার আগে নায়েবে আমির মকবুল আহমাদকে ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি এখনো এই পদে আছেন। শিগগিরই ভারপ্রাপ্ত আমির পদে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলে জানান জামায়াতের নেতারা।

সর্বশেষ গত জুলাই মাসে প্রকাশিত জামায়াতের গঠনতন্ত্রে দেখা যায়, ‘আমিরে জামায়াত’-সম্পর্কিত গঠনতন্ত্রের ১৫ নম্বর ধারায় (ঘ) উপধারা যুক্ত করে ভারপ্রাপ্ত আমিরের মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল করা হয়েছে। তাতে বলা আছে, ‘কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বিবেচনায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমিরে জামায়াতের নির্বাচন অনুষ্ঠান যদি কিছুতেই সম্ভব না হয়, তা হইলে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত আমির কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার অনুমোদন সাপেক্ষে স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।’

এ বিষয়ে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি যতক্ষণ নির্বাচন করার মতো না হয়, ততক্ষণ বর্তমান আমির বহাল থাকবেন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইতিমধ্যে এ বিষয়ে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনা হয়েছে।

অবশ্য দলের গঠনতন্ত্রে তিন বছর অন্তর আমির নির্বাচন, আমির অনূর্ধ্ব ছয় মাসের জন্য দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে একজন ভারপ্রাপ্ত আমির করা, নিযুক্ত আমির ছয় মাসের মধ্যে অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নতুন আমির নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথাও উল্লেখ আছে।

একইভাবে দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের গ্রেপ্তারের পর এ টি এম আজহারুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি হন। তাঁর গ্রেপ্তারের পর দায়িত্ব পান শফিকুর রহমান।

নায়েবে আমির ও সহকারী সেক্রেটারির পদ শূন্য: আমিরের পরের দুটি পদ নায়েবে আমির (সহসভাপতি) ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের অধিকাংশ পদও শূন্য হয়ে পড়েছে। নিজামীদের রেখে যাওয়া কমিটিতে পাঁচজন নায়েবে আমির ছিলেন। বর্তমানে এ পদে আছেন মাত্র একজন। গত জুনে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নায়েবে আমির করা হয়। আরেক নায়েবে আমির মকবুল আহমাদ এখন ভারপ্রাপ্ত আমির। দলের দুই জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির এ কে এম ইউসুফ ও এ কে এম নাজির আহমদ সম্প্রতি মারা গেছেন। অপর দুই নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আবদুস সুবহান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি হয়ে এখন কারাবন্দী।

একইভাবে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন ছয়জন। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। একই মামলায় কারাবন্দী আছেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও এ টি এম আজহারুল ইসলাম। মুজিবুর রহমান পদোন্নতি পেয়ে এখন নায়েবে আমির। আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক প্রায় ১০ মাস আগে বিদেশে গিয়ে আর ফেরেননি। অধ্যক্ষ আবু তাহের নামে অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল গুরুতর অসুস্থ। তিনি কয়েক বছর ধরে ঘর থেকে বের হন না।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, কয়েকজন নেতা জেলে, আর কিছু নেতা বাইরে আছেন। এসব শূন্য পদ নয়। তবে যাঁরা মারা গেছেন বা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের পদ পূরণের চিন্তাভাবনা চলছে।

এই সংকট সামাল দিতে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের সিলেট মহানগরের আমির শফিকুর রহমান ও খুলনা মহানগরের আমির মিয়া গোলাম পরওয়ারকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল করে। শফিকুর রহমান এখন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারির দায়িত্বে আছেন। আর মিয়া গোলাম পরওয়ার একাধিক ফৌজদারি মামলায় জেলে আছেন। এ অবস্থায় দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি পদের আর কোনো নেতাই দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় নেই।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, তাদের (জামায়াত) কৃতকর্মের জন্যই আজ তাদের এই জরাজীর্ণ অবস্থা। তিনি বলেন, এ দেশে জামায়াতের রাজনীতি করারই অধিকার ছিল না। জিয়াউর রহমান সে সুযোগ করে দিয়েছেন। এখনো তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জামায়াতের সাংগঠনিক অবকাঠামো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মেলে। তৃণমূল থেকেই তাদের দল ও নেতৃত্ব সংগঠিত। এত প্রতিবন্ধকতার পরও জামায়াতের দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বের যে অবস্থান, তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।

জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, এখন শূন্যপদে নিয়োগ পেতে অনেকে আগ্রহী। কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে চেষ্টা শুরু করেছেন। এ অবস্থায় দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। ওই নেতাদের দাবি, রফিকুল ইসলাম খান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর আমিরের পদটিও ধরে রাখতে আগ্রহী। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। কারণ, এক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদের দায়িত্ব দেওয়াটা হবে দলের জন্য নতুন নজির। তা ছাড়া, এটি দলের গঠনতন্ত্রেরও বিরোধী। দলের নীতি হচ্ছে, নেতৃত্ব কখনো চাওয়া যাবে না; বরং নেতৃত্ব অর্পিত হয়।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের তিনজন দায়িত্বশীল নেতা এই প্রতিবেদককে জানান, নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে দলের নীতিনির্ধারকেরা ঢাকা মহানগর কমিটির আমির রফিকুল ইসলাম খান ও নায়েব আমির হামিদুর রহমান আযাদকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করছেন। এই দুই নেতা দলের নির্বাহী পরিষদেরও সদস্য।

এদিকে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজনের ফাঁসি ও দুজনের মৃত্যুর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারাধীন অপর আট নেতার ভবিষ্যৎ নিয়েও ভীষণ শঙ্কায় আছে জামায়াত। এ ছাড়া নির্বাহী পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের দলীয় রাজনীতি থেকে দীর্ঘ সময় দূরে রয়েছেন। বর্তমানে তিনি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। অপর দুই সদস্য রফি উদ্দিন আহমদ ও তাসনীম আলম আছেন আত্মগোপনে। এ অবস্থায় দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য আরও বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানায়।

অবশ্য বছর খানেক আগে এক দফায় চারজনকে নির্বাহী পরিষদে যুক্ত করা হয়। তাঁরা হলেন দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য এ টি এম মাছুম, ঢাকা মহানগর কমিটির নায়েবে আমির হামিদুর রহমান আযাদ, আবদুল হালিম ও সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল। তখন দলের ভেতরেই কয়েকজন নেতার নির্বাহী সদস্য হওয়া নিয়ে কথা ওঠে।

নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন: দলের দায়িত্বশীল নেতাদের অনেকে মনে করেন, জ্যেষ্ঠতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার বিচারে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে এবং নির্বাহী পরিষদে যুক্ত হওয়ার মতো উপযুক্ত অনেক নেতা আছেন। এর মধ্যে দলের রাজশাহী মহানগর আমির আতাউর রহমান, চট্টগ্রামের আমির এম শামসুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য আবদুর রব, ইজ্জত উল্লাহ, সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সাইফুল আলম খান, মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক জসিম উদ্দিন সরকার, সিলেট মহানগর আমির এহসান মাহবুব যোবায়ের, বরিশালের আমির মোয়াজ্জেম হোসেন ও কক্সবাজার জেলার আমির মোহাম্মদ শাহজাহানকে উল্লেখযোগ্য মনে করে নেতা-কর্মীদের এই অংশটি। এসব নেতার উপযুক্ত মূল্যায়ন না হওয়ায় দলের ভেতরে ক্ষোভ ও নানামুখী প্রশ্ন জোরদার হচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ মনে করে, সংকটকালে তরুণ নেতৃত্ব আপাতত কাজ চালিয়ে যাওয়া বা সংগঠনকে ধরে রাখার মতো পারদর্শিতা দেখাতে পেরেছে। তবে এর আড়ালে দলে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টিও করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলের দীর্ঘদিনের নীতি ভঙ্গ, এমনকি দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের মতো অভিযোগও উঠেছে। এর প্রভাবে দলের সাংগঠনিক কাজে স্থবিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানান একাধিক নেতা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!