DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এবং আজকের প্রেক্ষাপট

imagesআজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। আজকের এই দিনে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারতীয় মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। রমনার রেসকোর্স ময়দানে ওই দিন অপরাহ্নে এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি তার কোমরের বেল্ট খুলে এবং নিজস্ব পিস্তলটি ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে সমর্পণ করে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা নিষ্পন্ন করেন।

এরপর আত্মসমর্পণ দলিলে উভয় জেনারেল স্বাক্ষর করেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জন্য এ আত্মসমর্পণ ছিল পরাজয় ও অবমাননার একটি স্মারক। এর আগেও পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আরও দুদুটি যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেসব যুদ্ধে কোনো পক্ষেরই আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ১৯৭১-এ তৃতীয়বারে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ৯ মাসব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

এ মুক্তিযুদ্ধে বীরের রক্ত স্রোত ও মায়ের অশ্রুধারায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ৯ মাসব্যাপী এ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ ও হীনবল করে তুলেছিল। বস্তুত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় ত্যাগ ও সাহসিকতার মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছিল বিজয়ের সোপান। এ দেশের লক্ষ-কোটি মানুষের সমর্থন না থাকলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবমণ্ডিত আত্মত্যাগ না থাকলে পাকিস্তানিদের পরাজিত করা সম্ভব হতো না। একজন মহান মনীষী বলেছিলেন, রাজনীতি হল রক্তপাতহীন যুদ্ধ এবং যুদ্ধ হল রক্তপাতময় রাজনীতি। যুদ্ধ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। এ দ্বন্দ্বে জনগণ যে পক্ষে থাকে সেই পক্ষেরই বিজয় অনিবার্য। ইতিহাসে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে মধ্য যুগে যেসব যুদ্ধ হতো, সেসব যুদ্ধে বিবদমান দুই পক্ষের সৈনিকরা লড়াই করত। যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করত সেনাপতিদের সঠিক কৌশল নির্দেশনা এবং সৈনিকদের লড়ার দক্ষতার ওপর।

অনেক সময় বিবদমান পক্ষগুলোর সৈন্য সংখ্যার ওপরও যুদ্ধের জয় পরাজয় নির্ভর করত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব যুদ্ধের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পৃক্তি ছিল না। যুদ্ধ ছিল নিছক শক্তির পরীক্ষা। উপনিবেশবাদ প্রায় সমগ্র পৃথিবীটাকে গ্রাস করেছিল উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র ও কূটকৌশলের বলে। কিন্তু উপনিবেশবাদ থেকে দুনিয়ার দেশে দেশে যে মুক্তিসংগ্রাম হয়েছে, সেই সংগ্রামে উপনিবেশবাদীদের উন্নত সমর সম্ভার কোনো কাজে আসেনি। শেষ পর্যন্ত জনতার সম্মিলিত শক্তিরই জয় হয়েছে। সে কারণে এসব যুদ্ধকে বলা হয় জনযুদ্ধ। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা একটি জনযুদ্ধেই লড়েছিল। এটা ছিল ন্যায় যুদ্ধ। অন্যদিকে শত্রুরা গণহত্যা, নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে দেশ রক্ষার নামে যে যুদ্ধ করেছিল, সে যুদ্ধ ছিল অন্যায় যুদ্ধ। ন্যায় যুদ্ধ ও অন্যায় যুদ্ধের মধ্যে শেষ বিচারে ন্যায় যুদ্ধেরই বিজয় হয়। ১৬ ডিসেম্বর একটি ন্যায় যুদ্ধের বিজয় স্মারক। এ বিজয়ের ফলে বাংলাদেশের জনগণ মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে গিয়েছিল দীর্ঘ ৯ মাসের অত্যাচার ও লাঞ্ছনার ইতিহাস। সবার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল আনন্দাশ্রু।



বিজয়ের ৪৩ বছর কেটে গেছে। সময়টি চার দশকেরও বেশি। এ সময়ে আমাদের অনেক সাফল্য যেমন আছে, তেমনি আছে অনেক ব্যর্থতাও। সাফল্যের দিকগুলো তুলে ধরতে হলে প্রথমেই যে কথাটি বলতে হয় তা হল, বাংলাদেশের জনচরিত্রে ও জনব্যক্তিত্বে পরিবর্তনের কথা। ১৯৭১-এর আগে বাংলাদেশের মানুষ বহু আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও এ কথা স্বীকার করতে হবে, আমাদের যোদ্ধা জাতি হিসেবে বড় ধরনের কোনো পরিচয় ছিল না।



কিন্তু ৭১-এর একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি একটি যোদ্ধার জাতিতে পরিণত হল। এমনকি যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, তারাও পরিণত হয়েছিল যুদ্ধের সক্রিয় সমর্থকে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া, তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা, শত্র“র অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের সাবধান করে দেয়া, পথ চিনিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে সাফল্য এনে দেয়া- সব ক্ষেত্রেই ছিল সাধারণ মানুষের সক্রিয় উদ্যোগ। এ উদ্যোগ সম্মুখ সমরের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না এবং এভাবেই গোটা জাতি পরিণত হয়েছিল একটি যোদ্ধা জাতিতে। সাহস, বীরত্ব ও দেশপ্রেম যেমন যুদ্ধের অনুষঙ্গ, তেমনি শৃংখলাভঙ্গ এবং নীতিবিচ্যুৎ হওয়াও যুদ্ধের অনুষঙ্গ।

নীতি ভ্রষ্টতা অনেককেই নানা বিচ্যুতির পথে তাড়িত করেছিল। যুদ্ধটি যদি আরও প্রলম্বিত হতো তাহলে আমাদের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়ত। কিন্তু আমরা হয়তো বড় কিছু অর্জন করতে পারতাম। সোনা যেভাবে আগুনে পুড়ে খাঁটি হয় তেমনি আমরাও একটি নিখাদ সোনার মতো খাঁটি জাতিতে পরিণত হতে পারতাম। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা ও আলজেরিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশেরই মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। ফলে এসব জাতির চরিত্রে এসেছিল বড় ধরনের পরিবর্তন। আমাদের পক্ষেও সে ধরনের পরিবর্তন সম্ভবপর হতো। তা হয়নি বলে আমরা এখনও দুর্নীতি ও অপশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছি। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ইতিহাসের এ ধারাকে পাল্টে দেয়ার কোনো সুযোগ আর আমাদের হাতে নেই।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন পরিস্থিতির একটি দ্রুত সমাধান। এ ব্যাপারে তিনি তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক সর সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন রাজনীতিবিদ, আর মানেক স ছিলেন যুদ্ধবিশারদ। মানেক স ইন্দিরা গান্ধীকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন আট মাসের আগে কিছুই করা সম্ভবপর হবে না। শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। হিমালয়ে বরফ জমলে চীনাদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হবে না। বাস্তবে তাই হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীও মানেক সর যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। চূড়ান্ত যুদ্ধটি হয়েছিল শীতের মাস ডিসেম্বরে। কিন্তু ভারতীয় রণকৌশলবিদরা এর চেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করতে চাননি। কারণ তাদের দৃষ্টিতে যত বেশি অপেক্ষা করা হবে ততই যুদ্ধটি বামপন্থীদের নেতৃত্বে চলে যাওয়ার ঝুঁকির সৃষ্টি হবে। ভারতের কাছে একটি রেড বেঙ্গল স্টেট কাম্য ছিল না। 



কারণ দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠিত হলে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। এ চিন্তার পক্ষে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস গ্রন্থে সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে।৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের জনব্যক্তিত্বে পরিবর্তনের সূচনা হয়। রবীন্দ্রনাথ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে দেখতে পেতেন অন্নপায়ী বঙ্গবাসীর বিরাট চারিত্রিক পরিবর্তন হয়েছে। যে বাঙালির আকাক্সক্ষা ছিল নিদেনপক্ষে রাজকর্মচারী হওয়া সে বাঙালির মধ্যে এখন অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ানোকেই পছন্দ করেন।

গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পর্যন্ত অনেকেই সরকারি চাকরির পরিবর্তে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক ক্ষেত্রেই সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। কৃষকের জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। অর্থকরী ফসল ফলানো, চাষবাসের ক্ষেত্রে উন্নত পদ্ধতির প্রবর্তন, খাদ্যশস্যের ফলন বৃদ্ধি, শাকসবজির ফলন বৃদ্ধি, মাছ, মুরগি ও পশুর খামার করা এবং দুগ্ধ খামার করা গ্রামীণ কৃষির চেহারা পাল্টে দিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তন লাখ লাখ গ্রামবাসীকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে আজ দ্বিতীয়। বাংলাদেশীরা আর ঘরকুনো বাঙালি হিসেবে অলস জীবনযাপন করে না। জীবনকে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে তুলতে তারা আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। তাদের শ্রমের ফসলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ বিশ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।



বিদেশী ঋণ পরিশোধ নিয়ে আজ আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়নের প্রসার ঘটছে। বিশেষ করে আরবান করিডোরকে আশ্রয় করে নগরায়ন বিস্তৃত হচ্ছে। নগরায়নের সবচেয়ে বড় চাপটি অনুভব করা যায় রাজধানী ঢাকায়। এখানে নগরায়নের চাপের তুলনায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধার সম্প্রসারণ সমান্তরাল গতিতে না এগোনোর ফলে নাগরিক জীবনে বিড়ম্বনা বাড়ছে। ফলে বিকেন্দ্রীকরণের দাবিও হচ্ছে সোচ্চার। স্বাধীনতা-পূর্বকালে শহর ও গ্রামের মধ্যে তফাত ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। এখন শহর ও গ্রামের মধ্যে সেই তফাত অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে।

গ্রামে পাকা সড়ক, যন্ত্রচালিত যানবাহন, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও কৃত্রিম পানীয়র মধ্যে শহরের আমেজ অনুভব করা যায়। ঢাকা থেকে দশ-বারো ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। কাজেই গ্রাম ও শহরের ভেদরেখা ক্রমান্বয়ে অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী চার থেকে পাঁচ দশকের মধ্যে বাংলাদেশ একটি নগর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। দেশের পরিচালক রাজনীতিকরা এ সম্ভাবনা নিয়ে কতটুকু ভাবছেন? কিই বা ভাবছেন? সিঙ্গাপুর, হংকং নগর রাষ্ট্র। অবশ্য হংকংয়ের চীনে অন্তর্ভুক্তি ঘটার পর ব্যাপারটি একটু বদলে গেছে। সিঙ্গাপুর ও হংকং খুবই ক্ষুদ্র ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ যদি নগর রাষ্ট্রে পরিণত হয় তাহলে সেটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম নগর রাষ্ট্র। এ নগর রাষ্ট্রে রূপান্তরে জনবসতির ঘনত্ব একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু তার পাশাপাশি প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে সুপেয় পানি, অব্যাহত জ্বালানি সরবরাহ, পরিবেশের ভারসাম্য এবং খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন প্রভৃতি সমস্যার সমাধান কীভাবে ঘটবে? এর জন্য কী পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।

নগর জীবন গড়ে তোলার জন্য যে অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়, সেই অবকাঠামোর জন্য একদিকে যেমন বিশাল বিনিয়োগ করতে হয় অন্যদিকে তেমনি নগর জীবনের নানাবিধ অর্থনৈতিক সাশ্রয় এবং উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ জীবনযাত্রার মানেও উন্নয়ন ঘটায়। আজ ভবিষ্যতের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে এসব বিপরীতমুখী শক্তির ভারসাম্য আনয়নের কৌশলের কথাও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সীমিত ভূমিতে বহু মানুষের আবাসস্থল এবং গবাদিপশুর আশ্রয়স্থল কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে যে বিপুল নগরায়ন ঘটেছে, তার পশ্চাতে রয়েছে বিশাল খামার জমি। বাংলাদেশে সেই সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। একদিকে জমির অপ্রতুলতা, অন্যদিকে জমির ওপর অগণিত মানুষের মালিকানা স্বত্ব। মালিকানা স্বত্বের বিপুলতা ও বৈচিত্র্যকে অতিক্রম করে কীভাবে ভূমির স্বত্বাধিকারে সংস্কার ঘটিয়ে একটি বিশাল নগর রাষ্ট্রকে টেকসই করা যায়, সেই দুরূহ ও জটিল অনুশীলন এখন থেকেই করতে হবে।৭৪-এর মতো দুর্ভিক্ষ হয়তো ভবিষ্যতের বাংলাদেশে আর কখনও ঘটবে না। অবশ্য কপাল মন্দ হলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে গৃহযুদ্ধের মতো দুর্যোগও আশংকা করা যায়। সে রকম পরিস্থিতিতে আবারও হয়তো দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে হবে। 



কিন্তু আমরা সেই দুর্দিনের কথা ভাবতে চাই না। এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্দিন যাতে না আসে তার জন্য আমাদের সাংঘর্ষিক রাজনীতিকে কীভাবে সম্প্রীতি ও সহনশীলতার রাজনীতিতে পরিণত করা যায় সেই বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। আমি তো ভালোই আছি কিংবা ভবিষ্যতে কেবল নিজেকে কীভাবে ভালো রাখা যায়, সে কথাই ভাবব এমন স্বার্থপর চিন্তা থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। ভাবনার জগতে একটি পরিবর্তন এনে ভাবতে হবে সর্বজনের কল্যাণের মধ্যেই ব্যক্তিরও কল্যাণ নিহিত।

সে জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমে যৌথ কল্যাণের নৈতিকতা বোধও সৃষ্টির প্রয়াস নিতে হবে।বাংলাদেশ উত্তরকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ১.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় সাফল্য। সরকার ও জনগণ উভয় পক্ষই এ সাফল্যের জন্য সাধুবাদ পেতে পারেন। পরিবারের আকার ছোট রাখার প্রতি আগ্রহ আমাদের দেশের মানুষের চিরায়ত মূল্যবোধে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন। বিশাল জনসংখ্যা বহরের বোঝা বইবার শক্তি বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে নিদেনপক্ষে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এর ফলে জনসংখ্যার বোঝার একটি সমাধান হবে বটে, তবে দেখা দেবে নতুন ধরনের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। চীনে এক সন্তানের পরিবার আন্দোলন সফল করতে গিয়ে বেশ কিছু সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পুত্রসন্তানের আকাক্সক্ষা মাতৃগর্ভে নারী শিশুর ভ্রুণ হত্যার মতো অমানবিক সমস্যারও সৃষ্টি করেছে। এছাড়া বিবাহযোগ্য তরুণীর জন্য বিবাহযোগ্য তরুণ পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ তরুণীর সংখ্যা তরুণের চেয়ে বেশি। 



কাজেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করতে গিয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো বিবেচনায় নেয়া হয় না। একে নিছক চিন্তার দুর্বলতা বললে ভুল হবে। আসল কথা হল, দেশ গড়ার জন্য সঠিক ও বহুমাত্রিক চিন্তা-ভাবনা দরকার।

বাংলাদেশের নদীগুলোর ওপর উজানে বাঁধসহ নানামাত্রিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে তীব্র পানি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সংকট মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং জনশক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে পানির বিকল্প উৎস নিশ্চিতকরণ। এগুলো বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সমস্যা। এগুলো কোনো নির্দিষ্ট দলীয় মানুষের সমস্যা নয়। এর জন্য সব দল ও মতের অনুসারীদের ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এ দেশে যখনই একটি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসে তখনই একটি নতুন সরকার নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে দেখা দেয় জটিল রাজনৈতিক সমস্যা। কীভাবে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি টেকসই রূপ দেয়া সম্ভব তা নিয়ে ক্ষমতাসীনরা প্রায়ই উদাসীন থাকেন। অন্যদিকে ক্ষমতাবহির্র্ভূতরা উপায়ান্ত না দেখে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। দেশ আমাদের একটি, জনগণও এক এবং অবিভাজ্য। অনন্তকালের জন্য কোনো দলই ক্ষমতায় থাকতে পারে না। এ সত্যগুলো উপলব্ধি করলে সমস্যা যত বড়ই হোক কোনো সমাধান অসম্ভব নয়।



বাংলাদেশে তীব্র ধনবৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। এক শ্রেণীর নাগরিকের বিত্ত-বৈভবের অভাব নেই। দেশে ও বিদেশে তাদের রয়েছে অঢেল সম্পদ। এদের বিলাসিতারও কোনো শেষ নেই। লেক্সাস ও বিএমডব্লিউর মতো দামি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার না করলে তাদের মর্যাদাহানি হয়। এর মধ্যে এক ধরনের উৎকট অশালীনতাবোধও আছে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা।

তখন দেশে লেক্সাস গাড়ি আসা শুরু হয়েছে। জনৈক মন্ত্রীর সংসদ সদস্য পুত্র একটি লেক্সাস গাড়ি কিনেছিলেন। ওই গাড়িটির ছিটগুলো ছিল চামড়ার। উদ্ধত আচরণে অভ্যস্ত এ তরুণ সংসদ সদস্যটি একজন বয়োজ্যেষ্ঠ দলীয় নেতাকে বলল, আমার গাড়ির ছিটের গন্ধ শুকে দেখুন। তীব্র আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ওই রাজনীতিক ঘৃণাভরে তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। আসলে বাংলাদেশে এখন চলছে কুৎসিত ধনীদের রাজত্ব। এদের কাছে জ্ঞান, মেধা ও অভিজ্ঞতার কোনো মূল্য নেই। এরা লাভের অর্থনীতির চর্চা করে না। তারা চর্চা করে লোভের অর্থনীতির। কার্ল মার্কস যে আদিম পুঁজি সঞ্চয়নের কথা বলেছিলেন, সে পথেই তারা অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছে। চোরাচালান, চোরাকারবার, মাদক পাচার, মানব পাচার, ব্যাংকের অর্থ লুটতরাজ, শেয়ারবাজারে লুটতরাজ, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধধর্মী ব্যবসা নেই যার সঙ্গে এদের সম্পর্ক নেই।

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক হবে বলে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিজ্ঞা ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পণ্ডিত পরামর্শকরা মনে করতেন ডিক্রি জারি করে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করা সম্ভব। তাদের যুক্তি ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো ২২ পরিবার বা সামন্তগোষ্ঠী নেই। কিন্তু তাদের এ অলীক চিন্তা বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যটি অর্জিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভুল প্রমাণিত হল। শুরু হল গাড়ি দখল, বাড়ি দখল। এখন কীই না দখল হয়! তারা যদি বুঝতেন ব্যক্তিগত সম্পদ ও সম্পত্তি রক্ত বীজের মতো ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এমন অলীক কথা ভাবতেন না। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র হবে এমন কথা এখন আর কেউ ভাবে না। বয়স্কদের মধ্যে কারও কারও সমাজতন্ত্র নিয়ে নস্টালজিয়া থাকলেও তরুণরা এ নিয়ে ভাবতেও রাজি নয়। যাদের মধ্যে কিছু সৎ চিন্তা আছে তারা একটি আদর্শ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কথা ভাবেন। 



এ পুঁজিবাদে লাভ থাকে। কিন্তু লোভ থাকে না। পুঁজিবাদ গড়তে হলেও প্রয়োজন হয় উদ্যোগ, উদ্ভাবনা, দায়িত্ববোধ, সুদূরপ্রসারী চিন্তা, সুস্থ কর্মপরিবেশ রচনার সৃজনশীলতা, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আয়ত্তের সক্ষমতা এবং সর্বোপরি দেশে একটি উন্নয়নমুখী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলায় সহযোগী ভূমিকা পালন। এ ব্যবস্থায় শোষণ থাকলেও দক্ষতা ও জ্ঞানের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নেই।

আজ বিজয় দিবসে ভাবতে হচ্ছে, কীভাবে বাংলাদেশ থেকে লোভের অর্থনীতির অবসান ঘটিয়ে নিদেনপক্ষে লাভের অর্থনীতির দিকে পা বাড়ানো সম্ভব হবে। কিছু ক্ষেত্রে লাভের অর্থনীতির ভিত্তি যে রচিত হয়নি তা নয়। তবে পুঁজি এখন যেভাবে আছে এবং যে অবস্থায় আছে তাকে লাভ আহরণের উদ্যোগমুখী করাই আমাদের সব চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের বয়স ৪৩ বছর হয়েছে। আগামী ৫০ কী ৬০ বছরের মধ্যে দেশটি নিয়মনীতির মধ্যে পরিচালিত হবে এটাই হোক আজকের প্রত্যাশা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!