DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়াবার ছোবল নেশায় চরিত্র হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা

101629_1ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় কামালের (ছদ্মনাম) মেধাক্রম ছিল প্রথম ৫০০-এর মধ্যে। অনায়াসে ভর্তি হয়ে যান ফিন্যান্স বিভাগে। প্রথম বছর অবৈধভাবে হলে থাকার সময়ই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সখ্য বাড়তে থাকে বিভাগ ও হলের বড় ভাইদের সঙ্গে। অনেকটা সঙ্গ দিতে খেয়ালের বশেই জড়িয়ে পড়েন মাদকের নেশায়। মাস্টারদা সূর্যসেন হলে ওঠার পর মাদক নেওয়ার ধরনে পরিবর্তন আসে। নেশা হয়ে ওঠে ইয়াবা। দিন-রাতের কোনো ভেদ থাকে না। বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক আলগা হতে থাকে। নতুন বন্ধু হয়ে ওঠে ইয়াবা সঙ্গীরা। ক্লাস-পরীক্ষার কোনো খবর নেই। দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে পারেননি। পরের বছর মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়েও ফলাফলে পরিবর্তন আসেনি। ছাত্রত্বের ইতি ওখানেই। কামালের এবার অনার্স শেষ বর্ষে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ছাত্রজীবন থেকে পিছলে এখন কামাল গ্রামের বাড়িতে।

ঘটনার একটু হেরফেরে এমন কত কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। নেশার ঘোরে পড়াশোনা শিকায় তুলে ছাত্রত্ব হারাচ্ছেন বা হারানোর পথে রয়েছেন অনেকেই। জেনেশুনে অনেকটা শখের বশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী ‘হালের ফ্যাশন’ ইয়াবায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর সহজলভ্যতা, নেশা করার জন্য হলগুলোর নিরাপদ আশ্রয় পরিস্থিতিকে ভয়ংকর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ক্যাম্পাস ও হলগুলোকে টার্গেট করে আশপাশে রীতিমতো বাজার সাজিয়ে বসেছে মাদক ব্যবসায়ীদের চক্র; যেখানে হাত বাড়ালেই মেলে ইয়াবা।


হলে ইয়াবার জোগানদাতা হিসেবে সাধারণ মাদক ব্যবসায়ীর পাশাপাশি নাম এসেছে ছাত্রলীগেরও। অভিযোগ রয়েছে, হলে মাদক বহন করে নেতা-কর্মীরা। সব কিছুই ঘটে প্রকাশ্যে। সবাই জানে। তবে ঝামেলার আশঙ্কায় কেউ এ নিয়ে কথা বলে না। পরিচয় গোপন রাখা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হলে অবশ্য সরব সবাই। ছাত্রলীগ নেতারা অবশ্য অভিযোগগুলো এক কথায় নাকচ করে দেননি। তাঁদের বক্তব্য, কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।শিক্ষার্থীদের শুধু টাকার জোগান দিয়ে যেতে হয়। যে কারণে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্ররা। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খুব একটা গায়ে মাখছে না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে দায়িত্বশীলরা দায়সারা মন্তব্য করে এড়িয়ে যান।

প্রতিদিনই হলের কক্ষে বা কোনো নিরাপদ স্থানে গিয়ে ইয়াবা সেবন চলে। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রদের সঙ্গে হলে গিয়ে কয়েকটি থানার এসআই পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরাও ইয়াবা সেবন করছেন। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন, সলিমুল্লাহ মুসলিম, মাস্টারদ্যা সূর্যসেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ ও অমর একুশে হলের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে ইয়াবার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রী হলের এক নেত্রীর বিরুদ্ধেও এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

ক্যাম্পাসের পাশেই ইয়াবা ব্যবসায়ীরা : বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে ইয়াবা সরবরাহ করতে ক্যাম্পাসের চারদিকেই রয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ী। শাহবাগ, চানখাঁরপুল, পলাশী, নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থান ব্যবসায়ীদের। তারা শিক্ষার্থীদের চাহিদামতো সরবরাহ করে আবার অনেকের কাছ থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। ক্যাম্পাস এলাকায় ইয়াবা বিক্রির তালিকায় সবার উপরে রয়েছে পলাশী ও আজিমপুর এলাকায় বসবাসকারী শামীম। সে পলাশীর কোয়ার্টারে থাকে। সেখান থেকে ছাত্ররা গিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসে। যখন তখন গেলেই তার কাছে মিলে ইয়াবা। চানখাঁরপুল এলাকায় ব্যবসা করে মুরাদ। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে চানখাঁরপুল এলাকায় বাসা ভাড়ায় থাকে। শিক্ষার্থীরা তার বাসায় গিয়ে নিয়ে আসে। পুরান পলাশীর আরমান নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে পাওয়া যায় ইয়াবা। তবে সবার কাছে বেচে না সে। সিনিয়র কিছু ছাত্র নেতা তার কাছ থেকে ইয়াবা কেনেন।

ইয়াবা সেবনে হল সবচেয়ে নিরাপদ : ক্যাম্পাসে পুলিশ প্রবেশ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা প্রক্টরের অনুমতি নিতে হয়। কাজেই পুলিশের কাছে কোনো বিশেষ তথ্য থাকলেও সহজে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে না। এই সুযোগে বিশ্ব^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে নিরাপদে চলছে ইয়াবা সেবন। আর ছাত্র নেতাদের পরিচয়ে অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীও হলে আসেন নেশা করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৭৭ নম্বর কক্ষে প্রতিদিনই চলে নিরাপদে ইয়াবা সেবন। এখানে হলের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে আশপাশের থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যও ইয়াবা সেবন করে থাকেন। এই কক্ষটি দখলে রয়েছে হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার কাছে। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হল শাখার সহসভাপতি পদমর্যাদার কয়েকজন নেতা বিষয়টি স্বীকার করেন। একুশে হল ও শহীদুল্লাহ হলের একাধিক কক্ষে এমন ইয়াবা সেবন হয় বলে জানান ওই সব হলের ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা।

নেশার টাকা জোগাতে ছিনতাই : গত ২ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে বের হলে ছিনতাইয়ের শিকার হন আল আমিন নামে এক ব্যক্তি। ছিনতাইয়ের সময় সেখানে থাকা পথচারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান লিয়ন ও একই বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আসাদ মিয়াকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। অতি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিনতাই বাড়ছে। সন্ধ্যা নামলেই সলিমুল্লাহ হল এলাকায় কোনো না কোনো ব্যক্তিকে ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়। এসব রোজকার ঘটনা। আর এসব ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে হল ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও। তাঁরা অতিমাত্রায় ইয়াবায় আসক্ত বলে তাঁর বন্ধু বা সহচররা জানান।

লিয়নের বন্ধুরা জানান, ভর্তির শিক্ষাবর্ষ অনুযায়ী তৃতীয় বর্ষে থাকার কথা থাকলেও লিয়ন এখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। ঘটনার সময়ও তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন। নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নেন না। সারা দিন নেশার ওপরই থাকেন। এই বছর পাস করতে না পারলে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাবে।

সলিমুল্লাহ হল এলাকায় প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনার সঙ্গে হলের সহসভাপতি ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মোস্তাহিদ আজম আমান, সংগীত বিভাগে প্রথম বর্ষের রাসেল আহমেদ তাহসান, সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের মিজানুর রহমান পিকুল ও আইন বিভাগের ফুয়াদ হাসান শাহাদাতের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে তাহসান ও পিকুল চতুর্থ বর্ষে থাকার কথা থাকলেও এখন প্রথম বর্ষে পড়ছেন। এবার পাস করতে না পারলে ছাত্রত্বের অবসান হবে। তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের সবাই ইয়াবার নেশায় বিপর্যস্ত। নেশার টাকা জোগাতেই ছিনতাই করছে।

গত ১৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড এলাকায় মাহবুবুল আলম অন্তু নামের এক ব্যবসায়ী ছিনতাইয়ের শিকার হন। এই ছিনতাইয়ের প্রতিকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এম আমজাদ আলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, ফুলার রোডে বসে থাকার সময় সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল আহমেদ তাহসান ও মাহবুবুল ইসলাম আপনকে ছিনতাইয়ে অভিযুক্ত করে বিচার দাবি করেন। শুধু এটাই নয়, এর আগেও তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, তাহসান ও আপন দুজনই ইয়াবায় আসক্ত। তবে অনেক সময় পুলিশের উপস্থিতিতেও এমন অপরাধ সংঘটিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

ছাত্রলীগ জড়িত নয় : ইয়াবা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফ বলেন, অভিযোগের ব্যাপারে কিছু জানা নেই। তবে ছাত্রলীগের কেউ ইয়াবা সরবরাহ বা হলে ব্যবহার করার সুযোগ দিলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্রয়ে এমন অপকর্ম হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো হলের কক্ষে ইয়াবা সেবন বা অপরাধমূলক কাজ হলে এর দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। হলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না কেন? কোনো নেতা-কর্মী এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে হল প্রশাসনকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের চেয়ে ছাত্রলীগ বড় নয়। প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার পরই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ কোনো অপরাধ করলে এর দায় ছাত্রলীগের ঘাড়ে পড়বে না। কারণ হল প্রশাসন অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড হতো না।’

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এম আমজাদ আলী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি জানি না। হল প্রশাসনের মাধ্যমে খোঁজ নেওয়া হবে।’ ছিনতাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসের আশপাশে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে এর সঙ্গে বহিরাগতরাও জড়িত থাকে। নিরাপত্তা বার না থাকায় কাউকে চিহ্নিত করতে পারি না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যারা জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

কয়েক ছাত্রের বিরুদ্ধে এক ব্যবসায়ীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পেয়েছি, কিন্তু এ বিষয়ে খতিয়ে দেখতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে খোঁজ নেওয়া হবে।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!