DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ইসলামিক স্টেটের(আইএস) শক্তি ও অর্থের উৎস

PX*6842348সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দাবি করছে, ইরাক ও সিরিয়ায় কার্যক্রমরত সশস্ত্র সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী সশস্ত্র সংগঠন। শুধু অস্ত্র আর অর্থের দিক থেকেই নয়, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকেও সংগঠনটি অন্য আর দশটা সংগঠনের থেকে বেশ এগিয়ে। আইএসের এই অর্থ ও সামরিক শক্তির উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হ্যারিয়েট আলেকজান্ডার ও বিচ। দৈনিক প্রথম বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হলোঃ

সংগঠনটির অর্থ আর ক্ষমতার উৎস আসলে কী?

গত জুন মাসে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মসুল দখল করে সংগঠনটি। এরপর থেকেই তাদের কোষাগারে মোটা অংকের অর্থ জমা হতে শুরু করে। বিশ্লেষকদের ধারণা, গত ছয় মাস ধরে ইরাকের উত্তরাঞ্চল এবং সিরিয়ার নিজেদের কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে সংগঠনটি ১২০ কোটি ইউরো খরচ করেছে। যা আয়ারল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশের বাৎসরিক সামরিক ব্যয়ের থেকেও বেশি।

আইএসের আর্থিক উৎস সম্পর্কে ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ পল সুলিভ্যান বলেন, ‌‌‘আইএসের অবস্থান আফগানিস্তানের মতো কোনো অনুর্বর পল্লী অঞ্চলে নয়; তারা মরুভূমি কিংবা গুহার ভেতরে লুকিয়েও থাকে না। তাদের কার্যক্রম হলো বিশ্বের অন্যতম তেল, গ্যাস ও বাণিজ্যিক সম্পদপূর্ণ একটি এলাকায়। নিজেদের কার্যক্রম বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তারা এসব সম্পদ দখলে নিতে পারে।’

আইএসের সবচেয়ে বড় আর্থিক বিজয়টা এসেছিল জুনে। মসুল শহর দখলের পর শহরটির বিভিন্ন ব্যাংকে লুটপাটের মাধ্যমে। এ সময় তারা আনুমানিক ২৪ কোটি ইউরো নিজেদের তহবিল জমা করে। যদিও ইরাক সরকার এ ঘটনাকে ভিত্তিহীন দাবি করেছিল।

এছাড়াও তাদের দখলকৃত পাঁচটি তেলখনি থেকেও প্রত্যেক দিন ১৮ লাখ ইউরো আয় হতো। এসব তেল রপ্তানি হতো ইরান ও তুরস্কের সীমান্ত দিয়ে।

স্থানীয় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেও সংগঠনটি গত বছর ৫০ লাখ ইউরো আয় করেছে। এছাড়া গত বছর শুধু মানুষ অপরহণ করেই ৪ কোটি ইউরো আয় করে সংগঠনটি। বিদেশি জিম্মি প্রতি ৩০ লাখ ইউরো করে নিলেও ব্রিটিশ সাংবাদিক জেমস ফোলির ক্ষেত্রে তারা ৮ কোটি ইউরো দাবি করেছিল। পরে অবশ্য তাকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। সে ঘটনার ভিডিও অনলাইনেও প্রকাশ করা হয়।

এসব উপার্জন ছাড়াও আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দেশের সমর্থকদের অনুদানও সংগঠনটির আয়ের অন্যতম উৎস। যদিও সৌদি আরবসহ ওই অঞ্চলের অন্য দেশগুলো আইএসকে সহায়তার ব্যাপারে নিজেদের নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তারপরেও গোপনে কেউ কেউ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় সৌদি নাগরিকরা তালেবানদেরকে মসজিদের মাধ্যমে অর্থ সহায়তা দিতে পারতো।

আইএস মসুল শহরের নিয়ন্ত্রণভার নেয়ার পর ইরাকে নিযুক্ত জাতিসংঘের দূত দাবি করেন, আইএস সদস্যরা ৪০ কেজি পারমাণবিক উপাদান নিজেদের দখলে নিয়েছে। অবশ্য ওই পারমাণবিক উপাদানগুলোকে খুব সহজেই পারমাণবিক অস্ত্রে রূপান্তর করা সম্ভব নয়।

ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলের উর্বর এলাকা দখল করার পর সংগঠনটি ইরাকের মোট উৎপাদিত গমের ৪০ শতাংশের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।  সংগঠনটির সদস্যরা খাদ্যশস্য ও ময়াদা সরকারি বাজাসহ স্থানীয় বাজারেও বিক্রি করছে।

সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের দখলকৃত এলাকা {focus_keyword} ইসলামিক স্টেটের শক্তি ও অর্থের উৎস THUMB

কৌশল এবং লক্ষ্য

আইএসের লক্ষ্য হলো একটি সুন্নি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যা চলবে ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী। এজন্য তারা প্রথমে একটি শহর দখল করে। তারপর সেখানকার মানুষদের বাড়ি দখলে নিয়ে নিজেদের স্বপ্ন তাদের মধ্যে চালান করেন। এ কারণেই বাইরের কোনো সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে তাদের ওপর হামলা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।

আইএসএলের ওপর হামলা প্রসঙ্গে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির মুখপাত্র সাইদ হুসেইন আল-মারি বলেন, ‘আইএস কোনো রাষ্ট্র নয় যে আপনি তাদের সামরিক স্থাপনা কিংবা অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাবেন। বরং তারা হলো সিরিয়ার পূর্ব অংশ ও মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক শ্রেণীর ঠগ।’

সামরিক বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন আইএসের রসদ সরবরাহ যানগুলোতে হামলা চালাতে। মরুভূমির মধ্য দিয়ে চলা এসব কনভয়ে সাঁজোয়া যান থেকে শুরু করে ট্যাংকসহ নানান যান থেকে। যে কারণে এগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হবে বলেই তাদের ধারণা।

বর্তমানে সবার নজর আলেপ্পো শহরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মারিয়া ও আজাজের দিকে। শহর দুটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসাদ বাহিনী ও আইএসের মধ্যে লড়াই চলছে। সরকারি বাহিনী ছাড়াও মারিয়াতে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ইসলামিক ফ্রন্ট নামে একটি সংগঠন।

আজাজ শহরের পরেই তুরস্ক সীমান্ত। এ কারণে শহরটির দখল নিতে পারলে আইএস বেশ কিছু সুবিধা পাবে। কয়েক দিন আগেই শহর দুটির নিকটস্থ একটি গ্রামের দখল নিয়েছে সংগঠনটি।

আইএসের অবকাঠামো দখলের পরিকল্পনায় রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এর মধ্যে অন্যতম হলো, উত্তর-পশ্চিম ইরাকের হাদিয়া জলাধার এবং ইউফ্রেতিস নদীর ওপর দিয়ে তুরস্কে যাওয়া তেলের পাইপলাইন; বেইজি শহরের একটি সার কারখানা এবং দেশটির উত্তর অংশের একটি সিমেন্ট কারখানা।

আল কায়েদার সঙ্গে অতীতে সম্পর্ক থাকলেও আল কায়েদার ভুলগুলো এড়িয়ে চলছে সংগঠনটি। ২০০৩ সালে যখন আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন হিসেবে আইএস কাজ করছিল তখন বেশ কিছু শহর দখল করার পরও তা ধরে রাখতে পারেনি। মূলত শহরের অধিবাসীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত কড়াকড়ি করার কারণে। এ কারণে আইএস তাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে। শহর দখলের পাশাপাশি অধিবাসীদের মনও জয় করার চেষ্টা করছে তারা। এজন্য যে কোনো শহর দখল করার পর সরকারের যেসব নীতিতে জনগণের অসন্তোষ ছিল সেগুলোকেই প্রথমে বাতিল করছে আইএস। মসুল শহর দখল করার পর তারা সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি রোধ করে। দখল করার পর ঘুষ গ্রহণের দায়ে এক কর্মকর্তাকে শাস্তি প্রদান ছাড়াও একটি তদারকি কমিটিও গঠন করে সংগঠনটি।

সামরিক শক্তি

ধারণা করা হচ্ছে আইসএলের সদস্য সংখ্যা সাত হাজার থেকে ১২ হাজারের মধ্যে। যার মধ্যে তিন হাজার বিদেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্রিটিশ নাগরিক রয়েছে।

কট্টোরপন্থি এই সংগঠনটির অস্ত্রাগারে রয়েছে ট্যাংক, বিমান বিধ্বংসী কামান। এছাড়া সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া যোদ্ধাবাহী সাঁজোয়া যান। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আইএসের কাছে সোভিয়েত আমলের টি-৫৫ সিরিজের ৩০টি ট্যাঙ্ক, টি-৭২ সিরিজের ১০টি ট্যাঙ্ক রয়েছে।

মাঝারি ক্ষমতাসম্পন্ন বেশ কিছু কামান রয়েছে যেগুলার পাল্লা ১৪ মাইলের মতো। এসএ-৭ সিরিজের ভূমি হতে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, বিএম-২১ গ্রেডের একাধিক রকেট লাঞ্চার এবং ফিম-৯২ নামের ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ম্যানপ্যাড। এছাড়াও জেডইউ-২৩-২ বিমান বিধ্বংসী বন্দুক এবং এম৭৯ ওসা, এইচকে-৮ এবং ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী এটি-৪ স্পিগট।

প্রত্যেক সদস্যের কাছে তিনটি করে এম-১৬ রাইফেল এবং যুদ্ধের বর্ম রয়েছে। এসব বর্ম আর রাইফেল মূলত সিরিয়া ও ইরাকি সামরিক বাহিনীর কাছ থেকেই এসব কেড়ে নেয়া হয়েছে। কারো কারো মতে তাদের কাছে স্বল্প সংখ্যক হেলিকপ্টারও রয়েছে।

আবু বকর আল-বাগদাদী {focus_keyword} ইসলামিক স্টেটের শক্তি ও অর্থের উৎস Abu Bakr al Baghdadi

নেতৃত্ব

আইএস এলের সাংগঠনকি কাঠামো অনেকটা উগ্রপন্থি আমলাতন্ত্রের মতো, যার নেতৃত্বে রয়েছে স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল-বাগদাদী। সামারায় জন্ম নেয়া বাগদাদী ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করার সময় ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক সায়েন্স বাগদাদের ছাত্র ছিলেন। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের শুরুর দিকে আল কায়েদা কিংবা স্থানীয় কোনো প্রতিরোধকারী দলের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা ছিল না। তারপরেও ২০০৫ এর শেষের দিকে তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকেই আল কায়েদা থেকে আইএসের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ইরাকে আল কায়েদাকে নেতৃত্ব দেন।

এসময় তিনি রহস্যময় চরিত্রের কিছু মানুষকে নিজের সহকারী বানান। কয়েদিদের সামলানো থেকে শুরু করে আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো সব কাজেই তাদের পারদর্শী করে তোলেন তিনি।

বাগাদাদী সম্পর্কে ইসলামি কট্টরপন্থিদের ওপর গবেষণাকারী হিশাম আল-হাশিমি বলেন, ‘সে (বাগদাদী) যুক্তিবাদী। কী করছে সে বিষয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করে। সে অত্যন্ত আদর্শবাদী এবং আদর্শের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়াও নিজেকে একজন প্রকৃত সুন্নি শাসক হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারেও সে সংকল্পবদ্ধ।’

বাগদাদীর খিলাফত কাঠামোর সবার ওপরে রয়েছে একটি ‘মন্ত্রিসভা’ যেখানে অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তারা স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে আবু আলী-আনবারি নামে এক সামরিক কর্মকর্তা যিনি বর্তমানে সিরিয়ায় আইএসের অধীনস্থ সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে পরিচালনা করছেন। সাদ্দামের হোসেনের সময় তিনি ছিলেন ইরাকি সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল। সাদ্দাম বাহিনীর আরো এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আবু মুসলিম আল-তুর্কমানিও বাগদাদীর ‘মন্ত্রিসভায়’ ঠাঁই পেয়েছেন। আবু সালেহ নামে এক ব্যক্তি আইএসের ইরাক অংশের আর্থিক দিকটি দেখাশোনা করে থাকেন।

জুন মাসে আইএসের একটি ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করার নথিপত্র থেকে এসব তথ্য জানা যায়। এসব নথি অনুযায়ী, আইএসের ‘মন্ত্রিসভায়’ উচ্চপদস্থ ও মাঝারি মিলিয়ে এক হাজারের মতো কমান্ডার রয়েছে। অবস্থান অনুযায়ী তাদের মাসিক বেতন তিনশ থেকে শুরু করে দু’হাজার ডলার পর্যন্ত।

অনলাইনে আটককৃত সেনাদের হত্যার ছবি {focus_keyword} ইসলামিক স্টেটের শক্তি ও অর্থের উৎস 8F15C98C 6AC8 47FB 9C4C A1E399D93424 mw1024 s n

সামাজিক মাধ্যম

মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফোলির শিরশ্ছেদের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানোর ঘটনাকে অনেকেই দেখছেন আইএসের প্রচারণার অংশ হিসেবে।

টুইটার, ফেসবুক, এবং ইউটিউবের মাধ্যমে সংগঠনটি নিজেদের কার্যক্রম প্রচার করছে। জুলাই মাসে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মসুল শহরের একটি মসজিদে বাগদাদী ঘোষণা দিচ্ছেন- সংগঠনটি ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত’ থেকে ‘ইসলামিক স্টেট’ নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সংগঠনটির লক্ষ্য হবে মধ্যপ্রাচের শেষ অংশ থেকে রোম পর্যন্ত নিজেদের অধীনে আনা।

আইএসের সাধারণ সেনাদের কার্যক্রমও অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। হত্যা করার সময়ের ছবি, হত্যা করার পর বিদেশি যোদ্ধাদের সেলফির ছবিও প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। যোদ্ধারা Ask.fm সাইটটি ব্যবহার করে প্রশ্ন ও উত্তরের জন্য। সংগঠনে যোগদানে আগ্রহীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেয়া হয় এই সাইটটির মাধ্যমে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!