DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বাতাসে টাকা ওড়ে চট্টগ্রাম কারাগারেঃদুর্নীতি ও অনিয়মের অবিশ্বাস্য কাহিনী

ctg karagar1 copyদৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ   ব্যাপক অনিয়ম, মাদক বেচাকেনা, জুয়ার আসর ও ঘুষ বাণিজ্য চলছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। যে কোনো অনিয়মই টাকার বিনিময়ে রাতারাতি নিয়মে পরিণত হয় এখানে। অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ছে বিশেষ শ্রেণির ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী, গডফাদার ও কথিত রাইটাররা।

আধিপত্য বিস্তারে এখানে চলে একে অপরকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতা। তবে টাকার ভাগাভাগি নিয়ে হত্যার অভিযোগের মামলাও দায়ের হয়েছে আদালতে। এখানে ঘাটে ঘাটে টাকা ছাড়া বন্দিরা পায় না কোনো সুযোগ-সুবিধা। কারাবিধির কোনো নিয়মই পাত্তা দেয় না কেউ। এই কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজোশে কম সাজা ভোগ করে বের হয়েছিলেন ফেনীর আলোচিত নিজাম উদ্দিন হাজারী এমপি।


‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’— এ মূল মন্ত্রকে ধারণ করে কারাগার প্রতিষ্ঠা করা হলেও শান্তিতে নেই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিরা। ঘুষ-বাণিজ্যের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

প্রকাশ্যেই চলছে মাদক বাণিজ্য। নেতৃত্বে রয়েছে জেল সুপার, জেলার আর এক ডেপুটি জেলার। সঙ্গে রয়েছে আরও ৫০ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। মূলত সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ডেপুটি জেলার জাহেদের নেতৃত্বে সুবেদার আন্জু, কারারক্ষী রাসেল, চিফ রাইটার ফরহাদ, মোহাম্মদ আলী, বিশ্বজিত্, তাহের, জসীম, কফিল এবং কারা চিকিত্সক মোস্তাফিজুর রহমান। আর তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে চট্টগ্রাম কারাগারে ১১৬টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব থাকা ১১৬ জন রাইটার।


image_2_345সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী কারা অভ্যন্তরে মাসে লেনদেন হয় কমপক্ষে গড়ে ১০ কোটি টাকার। অভিযোগ রয়েছে, এসব টাকার অর্ধেক যাচ্ছে জেল সুপার, জেলার আর এক ডেপুটি জেলারের পকেটে। আর অর্ধেক ভাগবাটোয়ারা করে নেয় সিন্ডিকেটের লোকজন। কারাগারের বাইরেও অনেকে পেয়ে থাকে ভাগ।


চট্টগ্রাম কারাগারের জেল সুপার ছগীর মিয়া দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ কে বলেন, চট্টগ্রাম কারাগার দেশের অন্যান্য কারাগার থেকে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। অথচ বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীরা জেলের বাইরে থেকে কারাগারের মাদক বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করছেন। তিনি কারাগারের ভিতরের অবস্থান জানার জন্য বিভিন্ন সাজাপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে রাতযাপন করা প্রয়োজন রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।


জানা যায়, কারাবিধি অনুসারে টাকা ছাড়া আটক বন্দিরা পান না কোনো সুযোগ-সুবিধা। টাকা দিলে কারাগারে থাকা যায় রাজার হালে। আর টাকা না দিলে বন্দিদের দিয়ে কারাগারের টয়লেট পরিষ্কার করা, গাছ পরিচর্যা, ময়লা পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সবধরনের নিচু কাজই করতে হয় বন্দিদের। আদালত থেকে বন্দিদের কারাগারে আনার পর প্রথমে রাখা হয় আমদানি ওয়ার্ডে।

সেখানে বিভিন্ন ওয়ার্ডের রাইটাররা এসে জড়ো হন। নিয়ম অনুযায়ী নতুন বন্দিদের রাখা আমদানি ওয়ার্ডে প্রথমে প্রবেশ করেন হাসপাতালের রাইটার। সেখানে বিভিন্ন মামলায় আসা বন্দিদের সঙ্গে কথা হয় কারা-রাইটারদের। এখানে চলে কারা হাসপাতাল ওয়ার্ডে বন্দি বেচাকেনা। কারা হাসপাতালে থাকতে প্রতি বন্দির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। এখানে যে কোনো সুস্থ বন্দিকে অসুস্থ বানানো হয় নিমিষেই।

এরজন্য যোগাযোগ করা হয় কারা মেডিক্যাল চিকিত্সকের সঙ্গে। প্রতি বন্দিকে মেডিক্যাল ওয়ার্ডে রাখতে তাকে দিতে হয় ২০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা। এছাড়া প্রতি মাসেই কারাগারের ১১৬ ওয়ার্ড এবং মেডিক্যালের ২৬ ওয়ার্ড পরিচালনার জন্য অবৈধভাবে নিলাম ওঠে। আর নিলাম নিয়ে রাইটারের মধ্যে চলে আধিপত্যের খেলা। যে বেশি দিতে পারে সেই পায় বেশি সুযোগ-সুবিধা। নিলাম নেয়ার পর থেকে রাইটাররা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রতিটি বন্দির মাথা গুনে আদায় করা হয় অবৈধ টাকা। টাকা না দিলে বন্দিদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে সম্প্রতি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে চট্টগ্রাম কারাগারে।


কারাগারে বর্তমানে হাজতি ও কয়েদি মিলে বন্দি রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। এর বিপরীতে প্রতি শিফটে কারারক্ষীর সংখ্যা মাত্র ৫০ জন। হিসাব অনুযায়ী ১১০ বন্দির পাহারা কিংবা দেখাভালের দায়িত্বে রয়েছে মাত্র এক কারারক্ষী।

ধারণক্ষতার চেয়ে চারগুণ বন্দির মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া বিডিআর সদস্য, জঙ্গি নেতাকর্মী, শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অসংখ্য স্পর্শকাতর আসামির নিরাপত্তা নিয়ে বিপাকে রয়েছে কারা প্রশাসন। তবে কারাগারে কারারক্ষীর সঙ্কটকে লোকবল সঙ্কট হিসেবে দেখছেন না জেলার নেছার আহমেদ মুকুল। তিনি  বলেন, প্রতি মাসেই কয়েকজন করে কারারক্ষী অবসরে যাচ্ছেন। তাই কারারক্ষীর সংখ্যা সামান্য কম। তবে সংখ্যা আরও বাড়ানোর ব্যাপারে আমরা সজাগ রয়েছি।


অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারে প্রতি মাসে অন্তত ১০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। মাদক বাণিজ্য, বন্দি বেচাকেনা, জুয়ার আসর, খাদ্যের কারচুপি, পিসির আত্মসাত্, দ্বিগুণ দামে ভালো মানের খাবার বেচাকেনা, অবৈধভাবে বন্দির স্বজনদের বিশেষ সুবিধায় এমনকি ডেপুটি জেলারের কক্ষে সরাসরি সাক্ষাত্ই হচ্ছে এসব টাকার প্রধান উত্স।

আর এসব অপকর্মের মূলহোতা সুবেদার আন্জু মিয়ার রয়েছে আরেকটি পরিচয়। তাকে কারাগারের অঘোষিত ক্যাশিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কারা কর্তৃপক্ষ। তার হাত দিয়েই আসে ওয়ার্ড নিলামের টাকা। এছাড়া আন্জু মিয়া রাইটারদের আতঙ্কের নাম। মূলত তার মাধ্যমে ওয়ার্ড নিলাম নিতে হয় রাইটারদের। আর মাস শুরুতেই এসব টাকার সিংহভাই পৌঁছে যায় জেল সুপার, জেলার আর এক ডেপুটি জেলারের পকেটে।

আন্জু মিয়ার সিন্ডিকেটে রয়েছে ডেপুটি জেলার জাহেদ, কারারক্ষী রাসেল, চিফ রাইটার ফরহাদ, মোহাম্মদ আলী, বিশ্বজিত্, তাহের, জসীম, কফিল এবং কারা চিকিত্সক মোস্তাফিজুর রহমান। সমপ্রতি চট্টগ্রাম কারাগারে জাকির হোসেন নামে এক সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে হত্যার ঘটনায় সুবেদার আন্জু মিয়াকে তাত্ক্ষণিক বদলির আদেশ দেয়া হলে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে কারাগারে এই মূর্তিমান আতঙ্ক।

কারাগারে বন্দি দেখার নামে চলছে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি।

সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখার নামে চলছে চরম হয়রানি। কারাবিধি অনুসরণের নামে চলছে কোটি টাকার বাণিজ্য। বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে দ্বিতল ভবনে ৫০০ টাকা, কারা অফিসের জানালার ফাঁকে সাক্ষাত্ করতে ১ হাজার ৫০০, অফিসের ভিতরে মুখোমুখি বসে সাক্ষাত্ করতে ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কারাগারে ঘুমানোর ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি রয়েছে।

এগুলো হচ্ছে ইলিশ ফাইল আর কেসি ফাইল। যেসব অসচ্ছল বন্দি ওয়ার্ড-রাইটারকে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে তাদের স্থান হয় মূলত ইলিশ ফাইল ও কেসি ফাইলে। ইলিশ ফাইলে বন্দিদের গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়। কেসি ফাইলে পা পুরোপুরি লম্বা করে ঘুমাতে হয়। দুই পায়ের মাঝখানে আরও একজন বন্দিকে ঘুমাতে দেয়া হয় চট্টগ্রাম কারাগারে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!