DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

অস্বীকার করেও তাঁর পথে হাটছেন কেন?

আবু রুশদঃ মানুষটিকে সাধারনত কেউ হাসতে দেখেননি। প্রখ্যাত ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বীণু শুধুমাত্র একটি ছবি তুলতে পেরেছিলেন যেখানে তাঁকে হাসতে দেখা যায়। কঠোর,কঠিন এক সৈনিকের ছায়া ছিল মানুষটির মুখাবয়বে, চলায়, আচরণে। তারপরও কি যে হলো? মাত্র বছর চারেক রাজনীতির মাঠে থেকে কাপিয়ে গেলেন পুরো দেশ, রেখে গেলেন এক সমুদ্র ভালোবাসা।ত্রিশ,চল্লিশ,পঞ্চাশ বছর রাজনীতিতে এপথ-ওপথ করে যারা যেটুকু জনপ্রিয়তা, গ্রহনযোগ্যতা ও সর্বপরি জাতিগত, কৌশলগত দিকনির্দেশনা দিয়ে যেতে পেরেছেন, চার বছরের রাজনীতি অনেকক্ষেত্রেই তা ছাপিয়ে গেছে। এ এক বিস্ময়, মেসমেরাইজিং এক নেতৃত্বের অবাক করা বাস্তবতার ইতিহাস।

জেনারেল জিয়া। মিলিটারী পদবীটির সাথে কি হাটে,মাঠে,ঘাটের মানুষের পথচলার সংগ্রামটুকু সমান্তরালে পথচলে? ঘোর আাঁতেলেকচুয়াল বিন্যাসে নাক হয়তো উঁচু করে ইউটোপিয়ার নেশাক্রান্তরা বলতেই পারেন-না। কিন্তু জিয়ার সামরিক পদবীটিও আজ রাজনীতির মেঠোপথের সঙ্গী। এটাই বাস্তবতা। এটাই জাতীয়তাবাদ। এটাই এদেশের সোদা মাটির গন্ধে ভরা, কোন প্রভুর সহায়তার বাইরে থাকা কোটি কোটি বাংলাদেশির হৃদয়ের আকুলতা। এটাই ওই সৈনিক থেকে রাজনীতিবিদ মানুষটির রাজনীতির মাঠে ক্ষণিকের পথপরিক্রমায় গড়ে ওঠা মহাকালের সফলতা।

জিয়া আজ নেই। জিয়ার তৈরি রাজনৈতিক দলটিও আজ ক্ষতবিক্ষত। কেন, কার জন্য সেই প্রশ্ন ইতিহাসের কাছে করার চেয়ে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার কাছে সমর্পন করাই বেশি শ্রেয়। ছিন্নভিন্ন করে, খুবলে চামড়া উঠিয়ে সব শেষ করে দেয়ার নেশায় যতো না মত্ত ঘৃণার চাদরে মোড়া শ্বাপদকুল, তারচেয়ে একটি ক্ষুদ্র দেশের মাথা উঁচু করে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর মানসিক ক্ষমতাকে শেষ করে দেয়ার প্রক্রিয়াই হলো আজকের পরিণতি।এটা একদিনে ঘটেনি। যেদিন জিয়া হাল ধরে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পররাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি হবে স্বাধীন ও মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে স্বাতন্ত্র জানান দেয়ার, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে ওই জীবনকাঠিটিকে হায়েনার ধারালো দাঁত দিয়ে খুবলে খাবার। এক, দুই, তিন করে সফলও হয়েছে সেই হায়েনারা। চার বছরের মধ্যেই জিয়ার শরীরে বুলেটের বার্স্ট ফায়ার করেছে তারই সঙ্গী,সাথী কমরেডদের একাংশ। তারপর তারই হাতে নিয়োগ পাওয়া এক ‘অতিশয় নিরীহ’ জেনারেলের হাতে সূচিত হয়েছে সমান্তরাল জাতীয়তাবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ বিরোধি শক্তির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির মহাযজ্ঞ। এর আর কোন শেষ নেই। বারবার আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েছে কেবল জাতীয়তাবাদীরাই। দাড়িয়েছে তারাই যাদের পাশে কথায় কথায় কোন প্রভু এসে দাঁড়ায় না। পলাশীর প্রান্তরের মতো প্রভুদের আজ্ঞাবহ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে অনেকেই। মহা উল্লাসে তাদের আজ বলতে শোনা যায়- জিয়ার দল নেই! জিয়ার নাম নেই! বিমানবন্দর, কলেজ, স্কুল থেকে ওই নাম মুছে গেছে! বেশ খুশি খুশি লাগছে তাদের! আহা, কি আনন্দ আকাশে, বাতাসে!কিন্তু, আসলেই কি তাই? জিয়ার দল দুর্বল হয়ে গেছে, লাখো কর্মী জেলে, মামলা-মোকদ্দমায় কাহিল। তারপরও কি জিয়া নিখোঁজ? জিয়ার দেখানো পথ হারিয়ে গেছে?

জেনারেল জিয়া যখন ক্ষমতায় আসীন হন তখন বাংলাদেশে সবধেন নীলমনি হিসাবে ছিল একটি মাত্র সেনা ডিভিশন। বিমান বাহিনীতে ছিল এক স্কোয়াড্রনের মতো জঙ্গী বিমান। নৌ বাহিনীতে ছিল ভারত থেকে দেয়া মান্ধাতার আমলের ‘বিএনএস পদ্মা’র মতো পেট্রোল বোট। মাত্র চার বছর। সেই সশস্ত্র বাহিনী সবাইকে চমকে দিয়ে ঘুড়ে দাড়ালো। গঠিত হলো পাঁচটি ডিভিশন। চীন,তুরস্ক, আমেরিকা, পাকিস্তান থেকে এলো ট্যাংক,কামান, রাইফেল,মেশিনগান, বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রসহ যাবতীয় সরঞ্জাম। নৌবাহিনতে এলো চীনা মিসাইল বোট, সাবমেরিন চেজার, টর্পেডো বোট, ফ্রিগেট। বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো ঢাকাসহ দেশের আকাশে উড়ে জানান দিলো আমাদেরও সক্ষমতা আছে। মাথা উঁচু করে, সিনা টান করে সাধারণ মানুষ ভাবতে শিখলো-আমরা বাংলাদেশি, আমরাও পারি।সশস্ত্রবাহিনীতে অফিসার সংকট দূর করতে দ্রূত কোর্সের পর কোর্স নেয়া হলো মিলিটারী একাডেমিতে। তৈরি হলো হাজারো অফিসার। তাদের পাঠানো হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষতার সাথে যুদ্ধ করে রক্ষা করলো দেশের সীমানা। সেইসব অফিসারদের অনেকেই ২০০৯ সালের পর সেনাপ্রধান হয়েছেন। বর্তমান সেনাপ্রধানও তাদের একজন। জেনারেল জিয়া যে যাদুর কাঠির বলে মাত্র চার বছরে সেনাবাহিনীতে পাঁচ ডিভিশন দাঁড় করাতে পেরেছিলেন, তারপর বাকি পাঁচ ডিভিশন তৈরিতে আমাদের লেগেছে চল্লিশ বছর।তবে যাই করা হয়েছে তাও ওই মানুষটির দেখানো পথ ধরেই। সেই চীন থেকেই এসেছে বেশিরভাগ সমরাস্ত্র, এখনো আসছে। কই, পারলে জিয়ার তৈরি চীনের সাথে, মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্কটা একটু বাদ দিয়ে দিন। ধ্বংস করে দিন সব সম্পর্ক তাঁর তৈরি দলের মতো, যেই দলকে ধ্বংস করার জন্য সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাতদিন, যাবতীয় বুদ্ধি বের করায় সব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন! কেউ তো পারলেন না গত চল্লিশটি বছর! সবাইকে তো জিয়ার দেখানো পথেই হাটতে হলো, হচ্ছে! তাহলে দাঁড়ালো কি?

রেমিটেন্স নিয়ে গর্বের শেষ নেই কারো। কয়েকদিন পর পর মিডিয়ায় সাড়ম্বরে এই রেমিটেন্সের গল্প আমাদের দেখতে হয়। আমরা সাদরে দেখি। বলি, মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মজীবীদের যাওয়া শুরু হলো কার হাত দিয়ে? কে ওইসব দেশের সাথে তৈরি করেছিল ইস্পাত কঠিন হৃদ্যতার সম্পর্ক? তার নাম কি জিয়া নয়? তিনিই কি ওইসব দেশে লাখে লাখে শ্রমিক পাঠানোর পথ তৈরি করে দিয়ে যাননি? সেই পথ ধরেই তো এখনো সবাই যাচ্ছে। আসছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। আর সেই ডলারের গল্প আমরা শুনছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। কই, ওইসব দেশের সাথে সম্পর্ক ছেদ করুন দেখি! যেহেতু জিয়া সেই সম্পর্ক তৈরি করে গেছেন, তাই ওসব তো হারাম, তাই না! কিন্তু পারছেন তো না। তাহলে আবারো কি বলা যাবে না যে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলতে পারলেও তাঁর তৈরি বৈদেশিক সম্পর্ক থেকেই রেমিটেন্স আনতে হচ্ছে! হায়!

তালিকাটি দীর্ঘ করা যায়। কি লাভ করে? জিয়া অপরাধ করেছিলেন! কি দরকার ছিল তাঁর সেনাবাহিনীর অবয়ব বাড়িয়ে? কি দরকার ছিল সেসময় ভারত-রাশিয়ার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে চীনসহ মুসলিম দেশগুলোর সাথে সামরিক ও অন্যান্য সম্পর্ক তৈরির? তিনি যদি তা না করতেন তাহলে তাঁকে কখনোই জীবন দিতে হতো না। আরাম,আয়াশে গলফ খেলে তিনি সময় কাটাতে পারতেন। তবে, তাঁর দেখানো পথে যারা আজ চাকচিক্যময় জীবন কাটাচ্ছেন, বিশাল পদ-পদবী ভাগ্যে জুটেছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আসছে দেশে তাদের সবার জীবন হতো মাথা নীচু করে চলার। হয়তো সেটাই ভালো ছিল, ভালো হতো।আধিপত্যবাদের নিগড়ে থাকলেই পরমানন্দে থাকা যেতো!অন্তত:মেরুদন্ডহীন সব প্রাণীকুলকে দেখে আজ তাই মনে হয়।

বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। জেনারেল জিয়া অমর হউক।[ বঙ্গবন্ধুর সাথে জেনারেল জিয়ার ছবিটি আমার নিজের কালেকশন। এখন সবাই ব্যবহার করছেন। ওটা প্রথম আমার সম্পাদিত জার্নালে ছাপা হয় ২০০৯ সালে।]

লেখকঃ সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!