DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বিশ্বসেরা ফাইটার বৈমানিক ও বিএনপির সাবেক সাংসদ গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আযম আর নেই।

কর্নেল(অবঃ)মোঃ আবদুল হকঃ বিশ্ব সেরা ফাইটার বৈমানিক ,চারটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের পক্ষে আকাশ যুদ্ধে অংশগ্রহনের দুর্লভ কৃতিত্বের দাবিদার,বিএনপির সাবেক সাংসদ গ্রুপ ক্যাপ্টেন(অবঃ) সাইফুল আযম গতকাল ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।

এই অসীম সাহসী বৈমানিক বীরের অসামান্য জীবনের উপর আলোকপাতের প্রয়াস রইলঃ

১।  বাংলাদেশ যে সকল বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গর্ব করতে পারে সেগুলোর মধ্যে একটি হলো পৃথিবী সেরা ফাইটার পাইলট হলেন আমাদের দেশের সন্তান। বিশ্বে আকাশ যুদ্ধে অদ্যাবদি যত ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, আমার জানা মতে সে ইতিহাস সৃষ্টিকারীদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন আমাদেরই বাংলাদেশের এক ক্ষণজন্মা বীরপুরুষ ফাইটার পাইলট গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আযম, সিতারা-ই-জুরাত, যিনি ছিলেন আমাদের বাংলাদেশ বিমান বাহিনীরই অত্যন্ত গৌরাবান্বিত চৌকস অফিসার। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এত মেধাবী, শৌর্য্য-সৌম্যতা, দুঃসাহসী, নিঁখুত বৈমানিক দ্বিতীয় একজন আছে কিনা আমার জানা নেই। তিনি বিমান যোদ্ধাগনের সর্বোচ্চ উপাধি ‘লিভিং ঈগল’ নামেই বেশি পরিচিত।

২।  ১৯৪১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলার, ফরিদপুর থানার বনোয়ারিনগর ইউনিয়নের খাগরবাড়িয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবার তিনি জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা মরহুম আবুল ওহাব নূরুল আযম ছিলেন পুলিশ অফিসার, মা- সামসুন্নাহার। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রয়াত দারাশিকো, তৃতীয় ভাই জাহাঙ্গীর আযম, চতুর্থ ভাই ডাঃ আলমগীর আযম, পঞ্চম ভাই ডাঃ সেলিম আযম। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান এয়ার মার্শাল ফখরুল আযম হলেন তাঁর চাচাতো ও খালাতো ভাই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখে তিনি ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমী, রিসালপুরে জিডি ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং কৃতিত্বের সাথে প্রশিক্ষণ সমাপ্তি করে ১৯৬০ সালের ২৬ জুন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন।

৩।  সেসনা টি-৩৭ এয়ারক্রাফ্ট প্রশিক্ষন সম্পন্ন করে তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর আরিজোনার লুক এয়ার বেইজে এফ-৮৬ সেবর এয়ারক্রাফ্ট চালনায় প্রশিক্ষন লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে তাঁর বদলী হয় ঢাকা কুর্মীটোলা এয়ার বেইজে। অতঃপর তিনি টি-৩৩ ফাইটার প্লেনের প্রশিক্ষক হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের মৌরি এয়ার বেইজে বদলী হন। এখানে কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে তিনি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কয়েকটি বিমান, বহু সাঁজোয়া যান ও কামান ধ্বংস করে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসীকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেন। পাকিস্তান সরকার তাঁর এ বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘সিতারায়ে জুরাত’ খেতাবে ভূষিত করেন।

৪।  ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ও সাইফুল আযম পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফাইটার প্লেন হাইজ্যাক করে বাংলাদেশে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন । বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ফাইটার প্লেন হাইজ্যাক করার সময় শহীদ হন । কিন্তু সাইফুল আযম হাতে নাতে ধরা পড়ে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন । ইরাক ও জর্ডান সরকারের বিশেষ অনুরোধে মৃত্যুদন্ড হতে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং বাংলাদেশে ফেরত আসার আগ পর্যন্ত কনসেনেট্রশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় ছিলেন । দেশের জন্য জীবন বিপন্ন করার দুঃসাহসী এমন ব্যক্তি ইতিহাসে কয়জন পাওয়া যাবে !

৫।  বিশ্বের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ফাইটার পাইলট যিনি চারটি দেশের অর্থাৎ পাকিস্তান, ইরাক, জর্ডান ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চাকরী করার সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তিনি একাই চারটি ইসরাইলী যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করে বিশ্বের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেন এবং ইরাক ও জর্ডান বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ খেতাব যথাক্রমে ‘নওয়াত আল সুজাত’ ও ‘উইসাম আল ইসতিকলাল’-এ ভূষিত হন। সর্বোচ্চ সংখ্যক যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করার কৃতিত্বের জন্য তাঁকে অন্যতম খেতাব ‘লিভিং ঈগল’ প্রদান করা হয়। পৃথিবীর ২২ জন “লিভিং ঈগলের” মধ্যে তিনি হলেন অন্যতম। শুধু বিমান বাহিনীই নয়, তিনি বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে সর্বাধিক সম্মানজনক ও বীরত্বসূচক খেতাব অর্জনকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর কৃতিগাঁথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষণ সূচীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

৬।  স্বাধীনতার পর ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি অফিসার হিসেবে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। অতঃপর ‘ডিরেক্টর অব অপারেশন’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান এবং বিমান বাহিনীর ‘ঢাকা বেজ কমান্ডার’ হন। ১৯৮০ সালে তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং এ দেশ বঞ্চিত হয় বিশাল ব্যক্তিত্বের জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হতে শিক্ষা গ্রহন থেকে।

৭।  অবসরে আসার পর তিনি বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ ও চলচ্চিত্র উন্নয়ণ সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) থেকে পাবনা-৩ আসনের (চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করে তিনি ‘নাতাশা ট্রাভেল এজেন্সী’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন আগা-গোড়া অত্যন্ত ভদ্র-নম্র, মার্জিত, বিনয়ী ও অমায়িক গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্য, হীনমন্যতা ও হিংসা-বিদ্বেষের কারণে এ দেশ ও জাতি তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন ও সম্মানীত করতে পারেনি। নিখাঁদ দেশপ্রেমিক সাইফুল আযমকে আমাদের বিমান বাহিনী রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করলে হয়তো ভবিষ্যতে আমরা আরো সাইফুল আযম সৃষ্টি করে আগ্রাসী হায়েনা বাহিনীকে প্রতিহত করতে সমর্থ হবো ।

৮।  এ কিংবদন্তী তূল্য মহান ব্যক্তিত্ব গতকাল ১৪ জুন দুপুর ১ টায় ঢাকা সিএমএইচ-এ ইন্তেকাল করেন। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিঊন’। দেশ হারালো দেশের মুখ উজ্জ্বলকারী এক অসাধারণ বীর সেনানীকে। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী নিশাত আরা আযম, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে। -নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি এবং তাঁরই নিকট ফেরত যাবো। মহান ও পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁকে ক্ষমা করুন ও তার কবরকে প্রশস্ত করে দেন। তাঁর জীবনের সকল গুণাহ ক্ষমার মাধ্যমে নেক আমলসমূহ কবুল করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দান করুন এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের ধৈর্য্যধারনের তৌফিক দিন, আমীন।

লেখককর্ণেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অবঃ),সাবেক সেনা অফিসার এবং সামরিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!