DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বাংলাদেশের বেসরকারী ব্যাংকঃকৈ এর তেলে কৈ ভাজার কাহিনী।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা মিলেমিশে ব্যাংকঋণ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৩ শতাংশ নিয়েছেন এসব পরিচালক।

এছাড়া বেনামি ঋণসহ এই ঋণের পরিমাণ ২৫ শতাংশ ছাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৫১টি ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

তবে ব্যাংকগুলোর পরিচালকের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি হলেও বড় অঙ্কের ঋণ সুবিধা নিয়েছেন কয়েকশ’ পরিচালক। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিতর্কিত হিসেবে বেশ পরিচিত। মূলত তাদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাত্র ১০ শতাংশ আমানত ধারণ করে চালকের আসনে বসে আছেন উদ্যোক্তা পরিচালকরা। উপেক্ষিত সাধারণ আমানতকারীরা। অথচ তাদের ৯০ শতাংশ আমানতে সমৃদ্ধ পুরো ব্যাংকিং খাত। জনগণের আমানত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন ব্যাংকের মালিক দাবি করা এসব পরিচালক। সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় পরিচালনা পর্ষদে কথা বলার মতো কেউ নেই। উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছের লোক হওয়ায় স্বতন্ত্র পরিচালকরাও কখনও আমানতকারীদের পক্ষে কথা বলেন না। বরং আমানতকারীদের টাকা লুটপাটে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী- চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা। এটি বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া পরিচালকদের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার বেনামি ঋণ ভাগাভাগি করার অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  বলেন, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে নৈতিকভাবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত। দেখা যাচ্ছে- জনগণের টাকা আগে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। বাকি থাকলে কিছু ঋণ অন্যদের দেয়া হয়। এটা তো প্রকাশ্যেই ঘটছে। তবে তাদের বেনামি ঋণও থাকতে পারে। তিনি বলেন, পরিচালকদের নামে-বেনামে ঋণ ২৫ শতাংশ ছাড়াতে পারে। কারও বেনামি ঋণ ধরা পড়লে তার পরিচালক পদ বাতিল করা উচিত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের এমডি  বলেন, ব্যাংকিং খাতে পরিচালকদের বেনামি ঋণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। এটা খেলাপি ঋণের চেয়েও ভয়ঙ্কর। খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করলে তা আদায় করা যায়। কিন্তু বেনামি ঋণ কখনও দেয়ার উদ্দেশ্যে নেয়া হয় না। এখানে এমডিরা অসহায়। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে ১ লাখ ২ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। এছাড়া নিশ্চয়তার বিপরীতে ৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা, অঙ্গীকারের বিপরীতে ১৪৯ কোটি টাকা এবং পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ৪৯১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা  বলেন, আসলে ব্যাংকের ঋণ গিলে খাচ্ছে ব্যাংকের তথাকথিত মালিকপক্ষ। তাদের কাছে ব্যাংক কোনো সেবামূলক লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়।

কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেয়ার মেশিন হিসেবে ব্যাংক ব্যবস্থাকে তারা ধরে নিয়েছেন। এ কারণে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এক সময় বহু আমানতকারীকে পথে বসতে হবে।

আর ঋণ গ্রহণকারী ব্যাংকের পরিচালকরা পরিস্থিতি খারাপ দেখলে সপরিবারে বিদেশে সটকে পড়বেন। এমন আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে তারা বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। সেখানে বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনা থেকে শুরু করে নানা খাতে তারা বিনিয়োগ করছেন।

 

বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি প্রায় সব ক’টি ব্যাংকের পরিচালকরা পরস্পরের মধ্যে ঋণ দেয়া-নেয়া করেছেন। এর মধ্যে ইসলামী ধারার অনুসারী একটি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে।

বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ব্যাংকটির দেয়া ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা, যা পুরো ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ। ন্যাশনাল ব্যাংক দিয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাত হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা এবং এক্সিম ব্যাংক দিয়েছে তৃতীয় সর্বোচ্চ ছয় হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে পূবালী ব্যাংক চার হাজার ২০৬ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক চার হাজার ১০১ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক তিন হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক তিন হাজার ৬১২ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক তিন হাজার ৩২৫ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া তিন হাজার ২৮৪ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক তিন হাজার ২৪ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক দুই হাজার ১৪৫ কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংক এক হাজার ৯১০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।

 

সূত্র জানায়, পরস্পর ভাগাভাগি করে ঋণ দেয়া-নেয়ায় নতুন ব্যাংকও পিছিয়ে নেই। নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ দিয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ৭১২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটির পরিচালকদের বেনামি ঋণ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৬২৭ কোটি টাকা, মিডল্যান্ড ব্যাংক ৫৫৩ কোটি টাকা এবং মেঘনা ব্যাংক ৪৫৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি নতুন ব্যাংকের পরিচালক  বলেন, এক পরিচালকের তদবিরে অন্য পরিচালককে ঋণ দেয়া হয়েছে। এখন অনেকে টাকা ফেরত দিচ্ছেন না।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ বিতরণে পরিচালকদের হস্তক্ষেপ বেড়ে গেছে। এ কারণে ম্যানেজমেন্টে পেশাদারিত্ব কমে আসছে। দেখা যাচ্ছে- ম্যানেজমেন্ট ব্যবহার করে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে ঋণ দিচ্ছেন। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনিসংকেত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা  বলেন, সরকারকে অর্থনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে ব্যাংক মালিকরা। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হলেও অনেক ক্ষেত্রে ওপরের চাপে বা ইশারায় এসব বিষয় জেনেও চুপ থাকতে হয়।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের ১৩ শতাংশ পরিচালকদের নেয়া খুবই উদ্বেগের বিষয়।

নিজের ব্যাংক থেকে পরিচালকের ঋণ নেয়ার একটা সীমা আছে। বর্তমানে একজন পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে মূল শেয়ারের ৫০ শতাংশ ঋণ নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই।

তবে নজর রাখতে হবে পরিচালককে দেয়া ঋণ যেন খেলাপির প্রবৃদ্ধি না ঘটায়। এ কারণে পরিচালকদের ঋণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য এর জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা।

 

প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী  বলেন, প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালক কোনো না কোনোভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ব্যবসা সম্প্রসারণে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেই পারেন। ফলে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ দিতে আইনি কোনো বাধা নেই। তবে খতিয়ে দেখতে হবে অনিয়ম করে কোনো ঋণ দেয়া-নেয়া হয়েছে কিনা। সেটাই অপরাধ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক ব্যাংকের পরিচালক  বলেন, কোনো পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না। একই সঙ্গে গ্যারান্টার হওয়ার সুযোগও নেই।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি সাপেক্ষে মূল শেয়ারের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন, যা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এছাড়া এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের সঙ্গে সমঝোতা করে ঋণ নিতে পারবেন না।

তবে ব্যবসা উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো ভালো ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন। যদিও তিনি অন্য ব্যাংকের পরিচালক হয়ে থাকেন। তবে সার্বিকভাবে ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করে ঋণ দেয়া-নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

সূত্রঃদৈনিক যুগান্তর।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!