DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু ও মানবিক উর্মিঃ স্থাপন করলেন অনুকরনীয় দৃস্টান্ত

image_82135_0 ১৩ মার্চ, বিকেল ৩টা। নগরীর ২ নম্বর গেট সংলগ্ন মেয়র গলির পিচ ঢালা রাজপথ। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে রাস্তায় মানুষের ছোটখাটো একটা জটলা। ভিড়ে ঠেলে যেতেই দেখা গেল নর্দমার ময়লায় মাখামাখি এক নবজাতক। জীবিত কি না বুঝা যাচ্ছে না। শিশুটি এখানে কীভাবে এল তা কেউ জানে না। নর্দমার ময়লা থেকে তুলে রাস্তায় শুইয়ে দিয়েছে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী।



উৎসুক জনতা উপুর হয়ে দেখছে। ভিড় বাড়ছে। সবারই দরদ উছলে পড়ছে! মুখে আফসোসের চ্চ চ্চ শব্দ। কেউ আবার শিশুরটি অজ্ঞাত মায়ের উদ্দেশে খিস্তি খেউরও করছে। বুঝা যাচ্ছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুটির জন্য শুধু সমবেদনা অবশেষ আছে সবার কোমল হৃদয়ে। এর দায়িত্ব নেয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা বা মানবিকতা কারো মধ্যে বেঁচে নেই। উৎসুক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, আর সাথে ওই শিশুর বাবা-মা অথবা কুমারী মায়ের গুষ্টি উদ্ধার করছে সবাই।



তেমনি কৌতূহল নিয়ে ভিড় ঠেলে উঁকি দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তানজিলা আবছার উর্মি। তারপর কাজে ফিরে যাবেন বলে মুখ ঘুরিয়েছেন কিন্তু হঠাৎ ‘মৃত’ শিশুটি কেঁদে উঠায় আর পা বাড়াতে পারেননি…



এই বর্ণনা শুনা যাক উর্মির বয়ানে- ওই দিন বিকেল ৩টায় ল্যাপটপ নিয়ে বন্ধু ওমর ফারুকের ষোলশহরের মেয়র গলির বাসায় যাচ্ছিলাম। চশমা হিলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে আসতেই দেখলাম বড় ধরনের জটলা। কৌতুহল নিয়ে ঘটনা কী দেখতে গেলাম। দেখি একটি সদ্য জন্ম নেয়া কন্যা শিশুকে রাস্তায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার সারা গায়ে নর্দমার ময়লা। প্রথমে ভেবেছিলাম মরা বাচ্চা। এই ভেবে রওনা দেব, এমন সময়ই কেঁদে উঠল শিশুটি। অবাক হলাম যখন দেখি এতোগুলো লোক জীবন্ত একটি শিশুকে এভাবে নোংরা অবস্থায় রাস্তায় শুইয়ে রেখেছে। যেকোনো সময় মারা যেতে পারে শিশুটি। এরপরও লোকজনের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা শুধু শিশুটির মা-বাবাকে গালাগালি করছে।



এরপরের কাহিনী বর্ণনায় উর্মি বলেন- তখনই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম শিশুটিকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে। নিজেই কোলে তুলে নিলাম। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিশুটিকে নালা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী বাবুল। আমার এই কাণ্ড দেখে আবুলও সাহস করে নিজের গামছা দিয়ে শিশুটিকে মুড়িয়ে আমার সাথে পথ ধরলেন।



আমরা শিশুটিকে নিয়ে দ্রুত একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে রওনা দিলাম চমেক হাসপাতালের দিকে। পথে ফোন করি আমার দুই বন্ধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ওমর ফারুক ও ইংরেজি ৪র্থ বর্ষের ছাত্র বর্ষণ সিয়ামকে। এরই মধ্যে তারাও ছুটে এলেন হাসপাতালে।



প্রথমে জরুরি বিভাগে রাখার পর শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালের নতুন ওয়ার্ড নিওনেটোলজি বিভাগ ও পেয়িং ওয়ার্ডে। এ বিভাগে মুমূর্ষু নবজাতকদের নিবিড় চিকিৎসা দেয়া হয়। বিভাগের ডাক্তারদের অক্লান্ত চেষ্টায় শিশুটি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।



বৃহস্পবিার শিশুটিকে কুড়িয়ে পাওয়ার পর থেকে এখনো চমেক হাসপাতালেই রয়েছেন নগরীর আগ্রাবাদ অফিসার্স কলোনির বাসিন্দা ও চবি ছাত্রী উর্মি। তিনি বলেন, ‘হয়ত মেয়ে হয়েছিল বলেই শিশুটিকে তার মা-বাবা নালায় ফেলে দিয়েছিল। নাড়িটাও ঠিকমত কাটা হয়নি। শিশুটি তেমন রুগ্ন ছিল না। মনে হচ্ছে কোনো অবস্থাপন্ন ঘরের শিশু। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর সবসময় তার সাথেই আছি। রাতেও থাকছি হাসপাতালে। এখানে সবাই শিশুটিকে উর্মির বাচ্চা বলে ডাকে।’



সবাই শিশুটিকে উর্মির মেয়ে বলে ডাকলেও উর্মি তার নাম দিয়েছে ‘নিধি’ যার অর্থ সম্পত্তি। কুড়িয়ে পাওয়া এই শিশুটিকে অবিবাহিত উর্মি অমূল্য সম্পদ বলেই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবার চেয়েছিলাম নিধিকে বাসায় নিয়ে যেতে। কিন্তু এ ঘটনা শুনে পরিচিত নিঃসন্তান অনেক দম্পত্তি আমাকে ফোন করেছে। তাই ভাবছি তাদের মধ্যে কাউকে দিয়ে দেব নিধিকে। এতে কোনো এক দম্পত্তির সন্তানের আশা পূরণ হবে। আমিও নিধিকে যখন ইচ্ছা তখন দেখতে পারব। নিধি যে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, এটা দেখতেই আমার ভালো লাগছে।’



নিধিকে নর্দমা থেকে তুলে আনা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মী মো. বাবুল বলেন, ‘শিশুটিকে মেয়র গলির একটি নালার মধ্যে সিমেন্টের প্যাকেটের মধ্যে পেয়েছি। প্রথমে ভয়ে কিছু করিনি। কিন্তু উর্মি আপা এগিয়ে আসলে আমিও তার সাথে যাই। আমার সামর্থ্য থাকলে আমিই মেয়েটারে ঘরে নিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি গরিব মানুষ। তাই উর্মি আপার কাছেই তুলে দিছি।’



চমেক হাসপাতালের নিওনেটোলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. গৌরি সাহা বলেন, ‘শিশুটি এখন বিপদমুক্ত আছে। সময়মত নিয়ে আসার কারণে তাকে বাঁচাতে পেরেছি। যখন এখানে এসেছিল তখন অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। শরীরের তাপমাত্রা অনেক কম ছিল এবং শ্বাস নিতে পারছিল না। তবে নালার পানিতে থাকায় তার শরীরে ময়লা-আবর্জনা ঢুকতে পারে। ফলে সামনে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন হতে পারে। তবে আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!