DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ফেলে আসা জীবন আমারঃ নায়ক রাজ রাজ্জাক

razzak_bg_395968902দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিনোদনঃ চিমাই মোল্লার ছেলের নাম মো. আকবর হোসেন মোল্লা। আকবর মোল্লা একজন সাধারণ ব্যবসায়ী। টালিগঞ্জের নাগতলায় আট নম্বর বাড়িতে থাকতেন। কলকাতা শহরে তার অনেক জমিজমা ছিল পৈতৃক সূত্রে। চব্বিশ পরগনার বোড়াল গ্রামেও ছিল একটা বিশাল বাড়ি। আকবর মোল্লা প্রায়ই যেতেন তার গ্রামের বাড়িতে। তার উদ্যোগে গ্রামে বছরে তিনবার যাত্রাপালার আসর বসত। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। সপ্তাহে দু’বার স্ত্রী-পরিবারসহ সিনেমা এবং থিয়েটার দেখতে যেতেন। 



এই আকবর মোল্লার স্ত্রী নেছারুন নেছা ছিলেন রক্ষণশীল। স্বামী-সংসার নিয়েই তার নিত্যদিন কেটে যেত। রান্নাঘরের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার খুব একটা জানা নেই। তার জানার আগ্রহ তার স্বামী-সন্তান আর পরিবার। এতেই তিনি সুখী। 



আকবর আর নেছারুন নেছার বড় ছেলের নাম আবদুস শুক্কুর। তিনি গানের তালিম নিতেন তার এক মামার কাছে। মামা ভালো গজল গাইতেন। তিনি বড় বোন নেছারুন নেছার বাসায় থেকে ভাগ্নে-ভাগ্নিদের লেখাপড়া এবং গান শেখাতেন। দ্বিতীয় ছেলে আবদুস গফুর। নেছারুনের দুই মেয়ে সবরুণ নেছা ও তসিবুন্নেছা। সুন্দর সাজানো-গোছানো একটি সংসার। 



নেছারুন নেছা তখন পঞ্চম সন্তানের অপেক্ষায়। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি জাপানি বোমারু বিমানের আকস্মিক আক্রমণের আশঙ্কায় গোটা ভারতবর্ষ শঙ্কিত। কলকাতা শহর সন্ধ্যার পর একেবারে চুপ। অন্ধকার। গোটা শহর ভয়ে চুপ হয়ে থাকলেও টালিগঞ্জের নাগতলা পাড়ার আট নম্বর বাড়িটা ছিল সেদিন অন্য উত্তেজনায় উত্তেজিত। ব্যবসায়ী আকবর হোসেনের মনে ছিল শঙ্কা আর আনন্দের মিশ্র অবস্থা। সেই রাতের আকবর সাহেবের ঘরে জন্ম নিল তার পঞ্চম সন্তান। 



আকবর সাহেবের এই পঞ্চম সন্তানই আমি। ছোটবেলা থেকে আমাকে আদর করে সবাই রাজা বলে ডাকত। সারাদিন হৈচৈ করে গোটা পাড়া মাতিয়ে রাখতাম। একবার জেদ ধরলে কেউ আমাকে বশ মানাতে পারত না। আমার বয়স যখন সাত বছর তখন আমার ছোট্ট একটি বোন হলো। তার নাম রাখা হয় ছবি। আমি অহেতুক ছবিকে চিমটি কাটতাম। এ নিয়ে মা যে কত ধমকাতেন আমাকে তা বলে শেষ করা যাবে না। 



আমি কেমন জেদি ছিলাম তার একটা ঘটনা বলি। একদিন মায়ের কাছে আবদার করলাম, আমাকে বল কিনে না দিলে পড়ালেখা করব না! বাবাকে তিনি এ কথা জানালেন। একদিন বাবা ঘরে এসে আমাকে ডাকলেন। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে ভয় ছিল, না জানি কী বলেন। কিন্তু বাবা আমাকে অবাক করে দিয়ে তার জামার পেছনে লুকানো একটা ফুটবল আমার সামনে এনে ধরলেন। আর বললেন, ‘এই নাও তোমার বল। এবার ঠিকভাবে পড়াশোনা করবে। পড়াশোনা না করলে ফুটবল কিন্তু আলমারিতে তুলে রাখব।’



ঠিক আছে বলে আনন্দে লুফে নিলাম বলটা। তখন থেকেই দক্ষিণ কালীগঞ্জ ক্রীড়া সংস্থায় খেলতে শুরু করি। আমি ছিলাম আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় ও ভালো গোলকিপারদের একজন। এটা ১৯৫২-৫৩ সালের ঘটনা। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আমাদের ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। আর আমার ফুটবল খেলার সঙ্গী ছিল নান্নু, সুবোধ, লালজী, বদরুদ্দীন এবং এহসান এবং আরও কয়েকজন (অনেকের নাম মনে করতে পারছি না)। স্যার আমাকে ডেকে বললেন, হ্যাঁ রে রাজা নাটকে অভিনয় করবি? আমি অবাক হয়ে বললাম ‘নাটক! স্যার বললেন, হ্যাঁ নাটক। আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম কিসের নাটক? তিনি বললেন, কেন জানিস না প্রতি বছরের মতো এ বছরও আমাদের স্কুলে নাটক হবে। রবিঠাকুরের [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] বিদ্রোহী নাটক। আমি তোকে হেরম্বরের মতো বিদ্রোহী করে গড়ে তুলতে চাই। আমি বললাম, না স্যার, আমি অভিনয় করব না। স্যার বললেন, আরে বলিস কী রে বোকা ছেলে। নাটক করলে অনেক সুনাম হয়। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-মফস্বলে তোর নাম ছড়িয়ে পড়বে রে। তোকে সবাই চিনবে-জানবে। ওই দিন প্রস্তাবটা মেনে নিলাম। 



পরদিন সকালে রথীন বাবু আমাকে নিয়ে নাটকের মহড়া কক্ষে গেলেন। স্কুলের বার্ষিক নাটক। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন স্যার নিজেই। এই বিদ্রোহী নাটকই ছিল আমার অভিনীত প্রথম নাটক এবং জীবনের প্রথম অভিনয়। সেই নাটকের প্রদর্শনীর দিন প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। তিনি নাটকটি দেখে আমার অভিনয়ের বেশ প্রশংসা করলেন। 



রথীন বাবু আমাকে এমনভাবে নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে নিলেন যে অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে আমি নতুন পথের সন্ধান পেলাম। অভিনয়ের নেশা আমাকে পেয়ে যায়। স্কুলের নাটক ছাড়াও বাইরের মঞ্চে অভিনয় করছি মহল্লায়। পাড়ার ছেলেরা মিলে নাটকটি মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছিল। রঞ্জিত কুমার চৌধুরী নামে আমাদের পাড়ায় এক লোক ছিলেন। তাকে আমরা সবাই দাদা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন খুলনার শিমুলিয়া গ্রামের জমিদার বংশের সন্তান। তাদের নিজস্ব একটি নাট্যমঞ্চ ছিল। তিনি নিয়মিত নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং তার ডিরেকশনেই আমি নাটকটিতে অভিনয় করি। ওই সময় আমাদের পাড়ায় নাটকটি বেশ প্রশংসিত হলো। তখন থেকেই আমি নাটকের প্রতি একটু বেশি মনোযোগী হই। 



আর এর মধ্যে আমার ফুটবল খেলার প্রতি টান কমে গেল। কেন টান কমল সে গল্পটা বলে নেই একটু করে। একদিন মাঠে খেলছিলাম। যথারীতি আমার দায়িত্ব গোলকিপার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা ঢুকে পড়েছে গোলপোস্টের কাছাকাছি। খুবই বিপজ্জনক অবস্থা। সবাই গোলের আশায় করতালি দিচ্ছে। কিন্তু আমি প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা বলটা বুক দিয়ে ঠেকালাম। বলের তীব্র আঘাতে মাটিতে নুয়ে পড়ি তখনই। বন্ধুরা আমাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে যায় সেদিন। সেই বুকের আঘাত অনেকদিন ভুগিয়েছে আমাকে। এরপর থেকে ফুটবল খেলার প্রতি আমার আগ্রহে ভাটা পড়েছে। 



শুক্কুর, গফুর ও রাজ্জাক আমরা তিন ভাই তিনটি চরিত্র। আমাদের দৈহিক মিল ও আত্মিক মিল থাকলেও কারও সঙ্গে কারও কোনো চারিত্রিক মিল নেই। বড় ভাই শুক্কুর বাবার মতো হয়েছে। মেজ ভাই গফুর দুরন্ত দুর্বার চির ক্ষ্যাপা হলেও নরম দিলের মানুষ।



লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি যখন খেলাধুলায় মেতে থাকতাম তখন বড় ভাই শুক্কুর সংসারের চিন্তায় থাকেন। আমার মেজ ভাইটি খুবই ভীতু ছিল। আর আমি ছিলাম একেবারেই আলাদা। দুরন্ত ক্ষ্যাপা যাকে বলে। 



স্কুলের গণ্ডি পার হতে না হতেই নাট্যকার, নাট্যপরিচালক ও চলচ্চিত্র পরিচালক পীযূষ বসু আমাকে ডাকলেন তাদের নাটকের দল ‘রঙ্গসভা’য় যোগদানের জন্য। কোনো কথা না বলে রাজি হয়ে যাই। অভিনয়ের বিষয়ে তার কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ পাই আমি। ওই সময় এ নাটকের দলের সঙ্গে আরও জড়িত ছিলেন ছবি বিশ্বাস, সন্ধ্যা রায়, বলাই সেন, দিলীপ চক্রবর্তী, রসরাজ চক্রবর্তী। ছবি বিশ্বাস ছিলেন আমাদের দল প্রধান। দলে ছোটদের এবং বড়দের দুটি দল ছিল। আমি ছিলাম ছোটদের দলে। ‘রূপকথা’ নামে প্রথম নাটকে অভিনয় করি। এর কিছুদিন পরই আমি সুযোগ পাই বড়দের দলে। সেখানে ‘বোবা কান্না’ নামে একটি নাটকে প্রথম অভিনয় করি। 



দলের হয়ে কাজ করতে থাকি নিয়মিত। কাঁধে নাটকের পোস্টার, হাতে বালতি নিয়ে কলকাতা শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বেড়াতাম। এরই মধ্যে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ নাটকে আমিনার চরিত্রে অভিনয় করেছি। নিজের শ্রম আর মেধা দিয়ে অল্প দিনেই আমি দলের সবার কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠি। একের পর এক নাটকে অভিনয় করে যাচ্ছি। এদিকে ডাক এলো মিনার্ভা থিয়েটার থেকে। যেখানে সলিল সেন রচিত ‘মৌ চোর’ নাটকে অভিনয় করে বেশ প্রশংসা পেয়েছিলাম। ওই সময় নাটকের নেশা পেয়ে যায় আমায়। 



এরই মাঝে প্রবেশিকা পাস। কিশোর বয়সে আমার একটা অসম প্রেম হয়। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সব কিছু কেমন জানি লাগত। বেশ আনন্দেই ছিল দিনগুলো। কিন্তু এর মাঝে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয় আমাদের মাঝে। সম্পর্কটা টিকে থাকে না। হতাশা নেমে আসে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে চলে যাই। সেখানে ফিল্ম ইনস্টিটিউট ফিল্মালয়ে ছয় মাস থাকি। এক বছরের কোর্স ছিল। কিন্তু আমি মাস ছয়েকের মাঝেই হাঁফিয়ে উঠি। এরপর আবার ফিরে আসি কলকাতায়। এর সঙ্গে অভাব-অনটন লেগেই আছে। কিন্তু হতাশ হইনি। ভেঙে পড়িনি। আরও দ্বিগুণ মনোবল নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। নায়ক হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ঘুরতে থাকলাম বিভিন্ন প্রোডাকশন হাউসে। নির্মাতারা কেউ আশা দিলেন কেউ আবার নিরাশ করলেন। কিন্তু আমি নিরাশ হলাম না। চেষ্টা চালিয়ে গেলাম আমার মতো করে। পীযূষ বসু আমাকে সাহস দিলেন। তার কথায় আবার নাটকে অভিনয় শুরু করি। পীযূষ বাবুর সহযোগিতায় কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাই আমি। এর মাঝে অজিত ব্যানার্জি পরিচালিত ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ হয় আমার। 



এদিকে বড় দুই ভাই ও দুই বোনের বিয়ে হলো। বোনরা তাদের স্বামীর বাড়ি চলে গেল। দুই ভাই তাদের সংসার নিয়ে আলাদা। সবাই ব্যস্ত। আমার থাকার জায়গা নেই। আমি কখনও বড় ভাইয়ের কাছে, কখনও বোনদের কাছে। ভাসমান অবস্থায় ভাসতে থাকলাম। পরিবার থেকে কেউ চাইত না আমি অভিনয়ের লাইনে থাকি। তাদের ধারণা ছিল নাটক-ফাটক করে দুর্নাম কামাব। পরিবারের জন্য ঝামেলা তৈরি করব। তাই আমার দুই ভাই মিলে একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ব্যবসা ধরিয়ে দেবেন। মোটামুটি একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করা হলো। অনেকটা বাধ্য হয়ে আমি ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসার টাকা নিয়ে আমি বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখা, নাটক দেখা, আড্ডা— এসব করতে থাকলাম। বাড়ি থেকে ব্যবসার টাকা-পয়সার হিসাব চাইল। কিন্তু আমি হিসাব দিতে পারলাম না। কী আর করা। হিসাব না দিতে পেরে বাড়ি থেকে পালালাম আবার। 



বেশিদিন থাকতে পারিনি। ছয়মাস পর আবার বাড়ি ফেরা। ১৯৫৮ বা ’৫৯ সালের কথা। আমার জীবনের স্বপ্ন যেন পূর্ণ হতে লাগল। অজিত ব্যানার্জি পরিচালিত ‘রতন লাল বাঙালি’ ছবিতে ছোট্ট একটা দৃশ্যে পকেটমারের ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পাই। তাতেই আমি কী খুশি। ওই ছবিতে আরও অভিনয় করেছিলেন আশীষ কুমার ও সন্ধ্যা রায়। কাছাকাছি সময়ে মঙ্গল চক্রবর্তীর ‘পঞ্চ তিলক’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করি। সেখানে একটি কলেজের দৃশ্যে অনেক ছাত্রের মাঝে ছিলাম আমি। আমার তৃতীয় ছবির নাম ‘শিলালিপি’। এতে একটি গানের দৃশ্যে এক্সট্রা শিল্পীর ভূমিকায় কাজ করে ২০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলাম। ওটা ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিনয় করে সম্মানী পাওয়া। 



১৯৬২ সালের দিকে নাটক আর মডেলিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি। কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই। বাড়ি থেকে জানানো হলো তারা আমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছেন, আমাকে বিয়ে করতে হবে। নাটক করার শর্তে বিয়ে করতে রাজি হলাম আমি। ১৯৬২ সালের ২ মার্চ খায়রুন নাহার লক্ষ্মীকে আমার জীবনসঙ্গী করে নিলাম। আমার বাউন্ডেলে জীবন ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকল। হাজেরা রোডের এক বাড়িতে শুরু হয় আমার সংসার জীবন। সংসার চালাতে তো টাকা লাগে। সে টাকা আসবে কোথা থেকে? অভাব যেন পিছু ছাড়ছে না। আবার ব্যবসা শুরু করলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। তাই ব্যবসা ছেড়ে চাকরি নিলাম ঊষা ফ্যান কোম্পানিতে। চাকরি করতে থাকলাম। কিন্তু চাকরিতে মন নেই। সেই সময় ডাক আসে অজিত ব্যানার্জির কাছ থেকে। তার ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে এক্সট্রা চরিত্রে অভিনয় করি। তখন আমার স্ত্রী গর্ভবতী। আমাদের প্রথম সন্তান আসবে। প্রথম সন্তান বাপ্পা হলো। 



কিন্তু মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা অভিনয়ের নেশা আমাকে ছাড়ছে না। চাকরিতে মন বসে না। সংসারেও না। কী করি। পীযূষ দা বলেন বাংলাদেশে আসতে। ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল বন্ধু বদরুদ্দিনের কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা ধার নিয়ে মাতৃভূমি কলকাতা ত্যাগ করে বাংলাদেশে আসি। কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে নামি। কোনো কিছুই চিনি না। বাপ্পাকে কাঁধে নিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে থাকি। একটা সময় ক্লান্তি আসে। একটি অভিজাত এলাকার বাড়ির সামনে বউ-বাচ্চা নিয়ে শুয়ে পড়ি। পরে পুলিশ এসে আমাদের উঠিয়ে দেয়। ওখান থেকে বের হয়ে স্টেডিয়াম এলাকায় উদ্বাস্তু মানুষের সঙ্গে কাটিয়ে দিই কিছুদিন। এরপর মায়াকানন রোডে ছোট একটা বাসা ভাড়া নেই। 



পীযূষ বাবু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শব্দগ্রাহক মণি বোসকে একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। আর এদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা আবদুল জব্বারের সঙ্গে আমার মেজ ভাই গফুরের সুবাদে মৌখিক পরিচয় ছিল। ওই ভরসাতেই ঢাকায় আসা। ঢাকায় আসার কিছুদিন পর শান্তিনগরে অবস্থিত ইকবাল ফিল্মসে দেখা করি আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে। তিনি তখন ‘উজালা’ ছবিটি নির্মাণ করছেন। ছবির পরিচালক ছিলেন কামাল আহমেদ। 



ওই দিন জব্বার ভাইয়ের অফিসে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো এবং জব্বার ভাই আমাকে ‘উজালা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতে বললেন কামাল আহমেদের সঙ্গে। সেইদিন ইকবাল ফিল্মে চাকরি হলো আমার। 



একদিকে সংসার চালানোর টাকা জোগাড় করা, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ছোট্ট একটা ক্যারেক্টারের জন্য ছুটছি আমি। দেখা করলাম মণি বোসের সঙ্গে। এহতেশাম, মোস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, সৈয়দ আওয়ালসহ অনেকের সঙ্গে। কেউ পাত্তা দিলেন না। যখন আমি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলাম তখন বেশ কিছু পরিচালকের ছবিতে ছোট ছোট কিছু চরিত্রে অভিনয় করেছি। ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আখেরী স্টেশন’ ছবিটি যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ছবির স্টেশন মাস্টারের কথা। ওইটাই ছিল ঢাকায় আমার অভিনীত প্রথম ছবি। 



সেই ছবিতে কাজ করার সময় কামাল আহমেদের সহকারী আনিস এবং আমি কতগুলো ক্যান কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কাঁধে আমার ব্যথা ধরে যায়। আনিসকে বললাম আর পারছি না রে। আনিস আমাকে বলে, তুমি অভিনয় করো। সহকারী পরিচালকের কাজ তোমার না। 



ওই দিনই আবদুল জব্বার খান এসে জানালেন ‘উজালা’ ছবিতে আমাকে একটি চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। ‘উজালা’ ছবির পর ‘কার বউ’ ছবিতে ট্যাক্সি ড্রাইভার, ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে পাড়ার ছেলে মিন্টু, ‘ডাকবাবু’ ছবিতে কোর্টের কর্মচারী এবং ‘কাগজের নৌকা’ ছবিতে বাঈজী বাড়ির মাতাল কাস্টমারের চরিত্রে অভিনয় করি। ওই সময় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বেশ কিছু মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করি। ঢাকায় আমার অভিনীত প্রথম মঞ্চ নাটক ‘পাত্রী হরণ’, নাট্যকার ও পরিচালক ছিলেন আবদুস সাত্তার। 



এভাবেই জীবন চলে যায়। চেষ্টা করে যাচ্ছি। শ্রম দিচ্ছি। অভাবে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল। আমি তখন ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় থাকি। পয়সার অভাবে ফার্মগেট থেকে তখন হেঁটে ডিআইটি টিভি কেন্দ্রে যাতায়াত করি। টিভিতে সংবাদ পাঠ করার জন্য অডিশন দেই। সেই সময় অভিনেত্রী রেশমার স্বামী জামান আলী খান ছিলেন বিটিভির প্রযোজক। তার সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি তখন ‘ঘরোয়া’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেন। তিনি এই অনুষ্ঠানটির জন্য একটি নতুন মুখ খুঁজছিলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। আমি ওই অনুষ্ঠানে একটি নাটিকায় অভিনয় করি। তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল অনুষ্ঠানটি। এরপর আসকার ইবনে শাইখ রচিত ‘কারিগর’ ও ‘লালন ফকির’ নাটকেও অভিনয় করি। তখন আমি টিভি নাটকে অভিনয় করে মাসে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা সম্মানী পাই। মাসিক খরচ ছিল ছয়শ’ টাকার মতো। কিন্তু এত টাকা কোথা থেকে আসবে? টাকার যন্ত্রণায় বাঁচি না। সিনেমায় ট্রাই করে যাচ্ছি। সামান্য সুযোগ পেতে আপ্রাণ চেষ্টা। একটা সময় এসে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। ঠিক করে ফেলেছিলাম আমি আবার কলকাতায় ফিরে যাব। 



এর মাঝে বিটিভিতে ‘ঘরোয়া’র শুটিং চলছিল। জামান ভাই আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি জানান, জহির রায়হান আমাকে চিঠি পাঠিয়েছেন। আমি খবরটা শুনে অবাক হই। চিঠিতে জহির রায়হান আমাকে দেখা করতে বলেছেন। 



এদিকে ইকবাল ফিল্মের সহকারী পরিচালক হিসেবে আমার দ্বিতীয় ছবি ‘পরওয়ানা’র শতকরা আশিভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সহকারী পরিচালকের কাজ ছেড়ে দিয়ে আমি দেখা করলাম জহির রায়হানের সঙ্গে। প্রথম দিন দেখা করার পর জহির রায়হান আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন কিছুক্ষণ। জহির রায়হান আমাকে নায়ক হিসেবে নির্বাচন করলেন তার নতুন ছবি ‘হাজার বছর ধরে’র জন্য। খবরটা শুনে আমি কী যে খুশি। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কী। ছবিটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। এরপর জহির রায়হান তার ‘বেহুলা’ ছবির জন্য আমাকে নায়ক নির্বাচন করলেন। এটা ১৯৬৬ সালের ঘটনা। আমি তখন ওই ছবিতে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হলাম। কিন্তু আমাকে এ ছবির নায়ক করাতে নানা ধরনের ঝামেলা ও কথার মুখোমুখি হতে হয়েছিল জহির ভাইকে। 



আমি তো ভেবেছিলাম আমি বোধহয় কাজটি করতে পারব না। কী যে হয়। চিন্তায় ছিলাম। না শেষ পর্যন্ত আমরা শুটিং শুরু করতে পেরেছিলাম। বেহুলা ছবির শুটিং শুরু হলো ঢাকার সদরঘাট এলাকায়। সদরঘাটের মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িতে তখন ছবির শুটিং হতো। আমাকে সকাল ১০টায় শুটিংয়ে আসতে বলা হয়েছিল। আমি ঠিক সকাল ১০টায় হাজির হয়েছিলাম। আমি মেকআপ নিয়ে তিন দিন ধরে অপেক্ষায় আছি। কিন্তু আমার শুটিংয়ে ডাক পড়ছে না। আমি আয়নায় আমার মেকআপওয়ালা চেহারা দেখি কেবল। কেবলই মনে হচ্ছিল আমাকে শেষ পর্যন্ত বাদ দিয়ে দেবে কি-না। কিন্তু না, শুটিংয়ের ডাক এলো আমার। প্রথম দিন শুটিং করলাম সুচন্দার সঙ্গে। একটি গানের দৃশ্যের শুটিং করলাম। আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি গেয়েছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। 



ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম শর্টটাই ওকে হলো। জহির রায়হানের সঙ্গে ওই ছবিতে কাজ করে আমি অনেক কিছু শিখেছি। যা আমার পরবর্তী লাইফে কাজে লেগেছে। এখন আমরা শুটিংয়ে দেখি যাদের শুটিং আছে কেবল তারাই শুটিংয়ে থাকেন। কিন্তু তখন সবাই শুটিংয়ে থাকতেন। যেমন প্রথম দিন শুটিংয়ে আমি দেখা পাই ফতেহ লোহানী, সুমিতা দেবী, মুহাম্মদ জাকারিয়া। 



জহির রায়হান কথা কম বলতেন। তিনি যা চাইতেন তা না পাওয়া পর্যন্ত দৃশ্য ছাড়তেন না। যদি দেখতেন কোথাও ঝামেলা হচ্ছে, তাহলে শিল্পীদের নিয়ে বসে আলোচনা করতেন। দৃশ্যটা বারবার বোঝাতেন এবং তিনি কাজের বিষয়ে কোনো ছাড় দিতেন না। খুব কম সময়েই আমরা ছবিটির শুটিং শেষ করতে পেরেছিলাম। 



১৯৬৬ সালের ২৮ অক্টোবর ‘বেহুলা’ মুক্তি পেল। দর্শক ছবিটি নিল। একটি হলে রজত জয়ন্তী প্রদর্শনী হলো। সিলভার জুবিলিও হয়েছে। ‘বেহুলা’র পর জহির রায়হানের স্ত্রী সুমিতা দেবী সৈয়দ হাসান ইমামকে নায়ক করে তারই প্রযোজনায় ‘আগুন নিয়ে খেলা’ নামে একটি ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। জহির ভাই ওই ছবিতে আমাকে হিরো করতে বলেন। কিন্তু সুমিতা দেবী রাজি হন না। এ নিয়ে জহির রায়হান আর সুমিতা দেবির মাঝে তর্ক হয়। অনেকটা সুমিতা দেবীর ওপর রাগ করেই জহির রায়হান আমাকে নিয়ে শুরু করলেন ‘আনোয়ারা’ ছবিটির কাজ। একটা সময় এসে সুমিতা দেবী তার ভুল বুঝতে পেরে আমাকে নিয়েই ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবির কাজ শুরু করেন। 



পর্যায়ক্রমে শুরু হলো ‘জুলেখা’, ‘নিশি হলো ভোর’, ‘আবির্ভাব’ ও ‘বাঁশরী’ ছবির শুটিং। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পেয়েছে আমার অভিনীত ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘জুলেখা’ ছবিগুলো। সে বছর ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিটি সুপার হিট ব্যবসা করল। 



এরপর ধীরে ধীরে আমার কাজের সংখ্যা বাড়তে থাকল। ‘যোগ বিয়োগ’ ছবির শুটিং করতে গিয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বাসায় কবরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। এর কিছুদিন পরই আমি আবদুল জব্বার খানের পরিচালনায় ‘বাঁশরী ছবিতে কবরীর সঙ্গে জুটি হয়ে কাজ করি। ওই ছবির শুটিং করতে গিয়েই কবরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। 



এরপর একে একে বহু ছবিতে কবরীর সঙ্গে জুটি হয়ে কাজ করি। সুচন্দা, শাবানা, ববিতার সঙ্গেও আমি জুটি হয়ে কাজ করি। কিন্তু কবরীর সঙ্গে জুটিটা দর্শক জনপ্রিয় হয়। 



১৯৬৮ সালে আমার আর কবরী জুটির ‘এতটুকু আশা’ ছবিটি সুপার হিট হয়। ওই বছরই মুক্তি পায় আমাদের জুটির ‘নিশি হলো ভোর’ এবং ‘বাঁশরী’ ছবিটি। আমাদের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায় ‘ময়নামতি’ ছবিটি মুক্তির পর। ১৯৬৯ সালে কাজী জহিরের এই ছবিটিকে ময়নামতি সাল হিসেবে বলেন অনেকে। ‘মনের মত বউ’, ‘নীল আকাশের নীচে’ ওই বছর হিট হয়। কবরীর সঙ্গে আমার অভিনীত ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরী’, ‘ময়নামতি’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘রংবাজ’, ‘অনির্বাণ’, ‘মতি মহল’, ‘গুণ্ডা’ ও ‘বেঈমান’ ছবিগুলো সুপার হিট ব্যবসা করে। ১৯৭০ সাল ছিল আমার জীবনের অন্যতম একটি সফল বছর। ওই বছর আমি ২১টি ছবিতে অভিনয় করি। তার মধ্যে ৯টিই ছিল কবরীর সঙ্গে। 



কবরী এবং আমার মাঝে একটা ফ্রেন্ডশিপ ছিল, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। এটা সবাই জানে। আমি বহুবার বলেছি কবরী ওয়াজ মাই গুড ফ্রেন্ড। অভিনয় করতে করতে তার সঙ্গে আমার একটা সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আসলে যার সঙ্গে মানুষের বেশি বন্ধুত্ব থাকে তার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। আমার সঙ্গে কবরীরও তাই হয়েছিল। আমি কবরীকে খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করতাম এবং তার প্রতি সেই শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তার সঙ্গে যখন ঝগড়া হলো, ঝগড়ার কারণ আমিও হতে পারি। সেও হতে পারে আবার তার স্বামীও হতে পারে। যার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকে, প্রচণ্ড মনের মিল থাকে, তার সঙ্গে ঝগড়ার পরই মনে অনুশোচনা আসা স্বাভাবিক। কিন্তু কবরীর আসেনি। আমি বলব কবরী ভুল করেছিল। আমি ভুলই বলব। কারণ যে ব্যাপার নিয়ে আমাদের ঝগড়া হয়েছিল সেটা কিন্তু তার সঙ্গে আমার বিষয় না। তার পারিবারিক ব্যাপারে বুঝতে গিয়েছি এটাই আমার অপরাধ। তার নিঃসঙ্গ জীবনের জন্য আমার অন্তরে সহানুভূতি-সমবেদনা জন্মেছিল। তাই তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তোমার স্বামী ছাড়া উচিত নয়। তোমার ঘর করা উচিত। আমার কথাগুলো কবরী মেনে নিতে পারেনি। যার ফলে আমাদের দু’জনার সম্পর্কের এই পরিণতি হয়েছে। আমি আমার প্রতি ঘৃণা জন্মানোর মতো কিছু করিনি কিন্তু কবরীর মনে আমার ব্যাপারে ঘৃণা জন্মেছে। সে সাংবাদিকদের তখন বলেছে আমি তার জীবনে দুষ্টগ্রহ। এই ভুল বোঝাবুঝির সূত্র ধরেই আমাদের মাঝে সম্পর্কটা নষ্ট হয়। 



নায়করাজ উপাধি আমার মনগড়া নয়। এটা আমাকে সাংবাদিকরা দিয়েছেন। চিত্রালী থেকে আমি এই উপাধি পেয়েছি। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে উপযুক্ত মনে করেছেন বলেই এ উপাধি দিয়েছেন। এর জন্য আমি গর্ববোধ করি। কিন্তু তাই বলে আমার আচরণ রাজের মতোই হবে এটা ঠিক নয়। আমি এটা শ্রদ্ধার সঙ্গে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিয়েছি। এই উপাধি দিয়ে সাংবাদিকরা আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আমি আমার অবসর নেওয়া পর্যন্ত পালন করে যাব। সিনেমার নায়ক বা নায়িকা উঁচু স্তরের লোকের কাছে জনপ্রিয় না এটা ভুল। সেই উঁচু স্তরের লোকেরা তা শুধু বলার জন্য বলে এটা তাদের মনের কথা নয়। ও রাজ্জাক নাম শুনেছি? তার ছবি-টবি দেখিনি এ রকম একটা ভাব। উঁচুতলার মানুষের একটা ধারণা, আমরা যেন যাত্রাপালা এবং ঘেটু দলের শিল্পী। এখন এই মাধ্যমের গুরুত্ব অনেক। হয়তো তারা যেভাবে বড়লোক হয়েছে আমরা হইনি। আমাদের মতো কষ্ট তাদের করতে হয়নি। যারা আমাদেরকে অবহেলার চোখে দেখেন বা ডিনাই করতে চান তারা এটা ইচ্ছা করেই করেন। 



আমি মাঝে মাঝে রেগে যাই। উত্তেজিত হয়ে পড়ি। আমার কাজে আমাকে প্রায়ই টেনশনে থাকতে হয়। দিনরাত্রি পরিশ্রম করি। দিনের পর দিন আউটডোর, বাড়িতে এসেও হয়তো শান্তি পেতাম না। আমার নেশার প্রতি কিছুটা টান থাকলেও ভায়োলেন্সের প্রতি অতটা নেই। খুব বেশি মেজাজ গরম না হলে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না। আর নেশা, ওটার প্রতি আমি কোনো বাড়াবাড়ি করি না। হতাশ হয়ে বা কষ্ট পেয়ে আমি নেশা করি না। আমার কোনো যন্ত্রণা নেই যার জন্য আমাকে নেশা করতে হয়। হ্যাঁ মাঝে মাঝে পান করি। এক সময় হয়তো বেশি পান করতাম।



নারীতে আসক্ত আমি ছিলাম না। এটা আমি সম্পূর্ণ অস্বীকার করি। আমার প্রেম আছে তবে তা নিঃস্বার্থ। আমি তাকে কখনও বলি না আমি তোমাকে বিয়ে করব। এই প্রেমে কোনো শর্ত নেই। আমি প্রেমে বিশ্বাস করি কিন্তু মেয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না। প্রতিটি নায়িকা ছিল আমার কাছে সহজ, তারা আমাকে বিশ্বাস করে। 



এভাবেই কাটতে থাকে আমার ফিল্মের জীবন। অভাব দূর হয়। আমি নিজের বাড়ি করি ঢাকাতে। টাকার চিন্তা না থাকলেও সারাক্ষণ শুধু কাজের চিন্তা থাকত মাথায়। একটা সময় মনে হলো আমার সিনেমা প্রযোজনা করা দরকার। তাই আমি ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন’ গড়ে তুলি। আমি নিজে প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনায় নামি ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিটি দিয়ে। একটা ছবি পরিচালনার ইচ্ছা আমার ছিল। কিন্তু ক্যারিয়ারের এত তাড়াতাড়ি ওটা করতে চাইনি। ‘অনন্ত প্রেম’র গল্প আমার ভালো লেগেছে। তাছাড়া বশির হোসেন সাহেব আমাকে স্নেহ করেন। ছবিটি পরিচালনার জন্য তিনিও আমাকে বিশেষভাবে বলেন। গল্পটা আমাকে এমন নাড়া দেয় যে, আমি ছবিটি নির্মাণের জন্য উৎসাহবোধ করি। আমার প্রথম ছবি নির্মাণের পর বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো পরিচালকের পক্ষে সুস্থ মস্তিষ্কে সুস্থভাবে ছবি করা সম্ভব নয়। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যারা ভালো ছবি বানাতে পারেন। শুধু পরিবেশ প্রতিকূলতার কারণে কিছু করে উঠতে পারছেন না। 



আমি এরপর ‘মৌ চোর’, ‘বদনাম’, ‘অভিযান’, ‘সৎ ভাই’, ‘চাঁপা ডাঙার বউ’, ‘প্রেম শক্তি’, ‘প্রফেসর’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘সন্তান যখন শত্র’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘জ্বীনের বাদশা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিগুলো আমি নির্মাণ করি। এর মাঝে ‘জ্বীনের বাদশা’ এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছাড়া বাকি সবকটি ছিল রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের ছবি। শুধু ছবি নির্মাণ নয়, অনেকে জানেন না ‘অগ্নিশিখা’ ছবিতে ‘দুনিয়ার চক্কর, কার আছে কোথা ঘর’ এবং ‘জ্বীনের বাদশা’ ছবিতে ‘কাজল কাজল মেয়েটির রাঙা দুটি আঁখির কোলে’ শিরোনামের গানগুলো কিন্তু আমার গাওয়া। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!