DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

সরকারের অদৃশ্য হাতের কারসাজি নয় তো? কেনো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন জেল ফেরত বিএনপি নেতারা?

বিএনপি-লোগোবিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার হঠাত্ ‘চুপ’ হয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে দলের ভেতরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কেন তারা সরকারবিরোধী ‘মুভমেন্ট’ থেকে দূরে থাকছেন তা নিয়ে গুঞ্জনের ডালপালাও ছড়িয়েছে। কেউ বলছেন, সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত।

অনেকের ধারণা, কারাগারের নিঃসঙ্গতা ও ‘কষ্ট’ এড়াতেই এই কৌশল। জানা গেছে, সরকারের নানা কৌশলের জালে আটকা পড়েছেন বিএনপির ওই নেতারা। একটি অংশকে দিয়ে পৃথক দল গঠনের একটি চেষ্টা চলছে। এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো সফলতা দেখা যায়নি। তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়েছেন।এমতাবস্থায় বিএনপির মধ্যম সারীর ত্যাগী ও মেধাবী নেতাদের নেতৃত্ব নিয়ে আসা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বেগম জিয়ার হাতে।

বিভিন্ন মামলার জালে ফেলে নেতাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত রাখা সম্ভব হয়েছে। বিএনপি থেকেও অভিযোগ করা হচ্ছে, সরকার তাদের দল ভাঙার নানা ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু এতে কাজ হবে না। ইম্পাত কঠিন ঐক্যে দল সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এ সব নিয়ে বিএনপির ভেতরে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও অধিকাংশ নেতাকে সন্দেহ করেন।

দলের মধ্যে কেউ সরকারের এজেন্ট, কেউ বিশেষ সংস্থার লোক বলে বলাবলি হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে  বলেন, ‘বিএনপিকে দুর্বল করতে সরকার সব ধরনের অপকৌশল ব্যবহার করছে। মামলার পর মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বিভেদ সৃষ্টিরও চেষ্টা করছে।’

তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও সরকার বিএনপি এবং ১৯ দলীয় জোটের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। এখনও তীরের নিশানা আমাদের দিকে তাক করানো আছে। দল এ সব বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক আছে। এর আগেও বিএনপিতে ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। কখনও সরকারের চাপে, কখনও বা দলের ওপর রুষ্ট হয়ে পৃথক দল করেছেন কয়েকজন নেতা।

ভাঙা-গড়ার এই খেলা বারবারই বিএনপির ওপর এসে পড়ে। সর্বশেষ ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল ভাঙ্গা-গড়ার এই খেলা মূলত স্বৈরাচার এরশাদের আমল থেকে শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দফায় দফায় ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপি।

প্রথমে হুদা-মতিন, দ্বিতীয়বার শাহ আজিজ, তৃতীয়বার কেএম ওবায়দুর রহমান, চতুর্থবার অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, পঞ্চমবার কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং ষষ্ঠবার আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি।

তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন রকম। চলতি বছরের শেষের দিকে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে যাবে বিএনপি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি হবে সরকারের উত্খাতের আন্দোলন। এর আগে বিএনপিকে দমিয়ে দেয়ার কৌশল হাতে নিয়েছে সরকার— এমন অভিযোগ উঠেছে। তারই অংশ হিসেবে দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে নানা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে মনে করেন দলের নেতারা। তারা বলেন, কখনও রাজনৈতিক মামলায়। আবার কখনও দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় কারাগারে যাচ্ছেন নেতারা।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির একটি অংশের নেতাদের ভাগিয়ে এনে পৃথক দল থেকে নির্বাচন করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ফাঁদে পা দেননি নেতারা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী যোগাযোগ করে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করেছিলেন।

তাতে সফল হয়নি সরকার। সম্প্রতি দলের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে দুই নেতা প্রকাশ্যে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন। তারা হলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। রাজনীতির মাঠে অপ্রকাশ্যে দুজন একে অপরকে সরকারের ‘দালাল’ বলে নানা বিতর্ক ছড়ান।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। ওই সময় ঢাকা মহানগর বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে বৈঠক হয় এক প্রতিনিধির। তাকে দিয়ে দল ভাঙার চেষ্টা করা হলেও তিনি রাজি হননি। তবে আন্দোলন থেকে বিরত ছিলেন তিনি। বিষয়টি দলের ভেতর জানাজানি হলে ওই নেতাকে খালেদা জিয়ার কাছে জবাবদিহি করতে হয়।

নির্বাচনের আগে ওই বৈঠকের সূত্র ধরে নানা খবরে খালেদা জিয়াও নিশ্চিত হয়েছেন, জ্যেষ্ঠ এই নেতার সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ রয়েছে। তখন তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিন্তু শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার এবং আন্দোলনের সময় দলে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন খালেদা জিয়া।

সম্প্রতি দুদকের একটি মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কারাগারে আছেন। তার গ্রেফতারের বিষয়টিও ওই কৌশলের অংশ বলে জানা গেছে। কারাগার থেকে বের হতে হলে তাকে সমঝোতায় যেতে হবে। থাকতে হবে নিষ্ক্রিয়। নইলে কারাগারেই থাকতে হবে।

এ বিষয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘কোনো সরকার যখন স্বৈরাচারী হয়ে যায়, তখন বিরোধী মতকে দমিয়ে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও তাই করছে। সরকারের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।’

জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে দিয়ে পৃথক দল গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল। গত বছরের ৮ নভেম্বর গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারে তার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তির বৈঠকের কথা শোনা যায়। ওই সময় তাকে নতুন দল গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হয়। তাতে রাজি হননি এই নেতা। তবে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তিনি দলীয় কার্যক্রমে একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

আগে বিএনপির সব কর্মসূচিতে বেশ সক্রিয় থাকতেন মওদুদ আহমদ। বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কর্মসূচিতে প্রায়শ তাকে প্রধান অতিথি হিসেবে দেখা যেত। প্রেসক্লাবে বিএনপি সমর্থক নানা সহযোগী সংগঠনের কর্মসূচিতে থাকতেন নিয়মিত।

মিডিয়া কভারেজ খুবই পছন্দ করেন— তার সম্পর্কে এমন কথাও বলা হয়ে থাকে। সেই মওদুদ আহমদ এখন একেবারেই আড়ালে। কেন এই অবস্থা? এমন প্রশ্নের উত্তর মওদুদের কাছে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মিডিয়াকে একেবারেই এড়িয়ে চলছেন তিনি। বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে ফোন ধরেন তার সহকারীরা। তারা বলেন, ‘স্যার আপাতত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।’ জানা গেছে, সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলে মওদুদ আহমদের গুলশানের বাড়িটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এ জন্য তিনি একেবারেই চুপসে গেছেন।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান মওদুদ আহমদ। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকও করেন তিনি। কিন্তু দলের কর্মসূচিতে থাকেন না তিনি। একই দিন গ্রেফতার হওয়া স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এম কে আনোয়ারও একেবারেই চুপচাপ। গ্রেফতার হওয়ার আগে দলের কর্মসূচিতে নিয়মিত থাকতেন তিনি। সরকারবিরোধী বক্তব্য সব সময় সোচ্চার ছিলেন সাবেক এই আমলা।

মুক্তি পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায়নি। সর্বশেষ ১৯ ও ২০ মার্চ বিএনপির লং-মার্চেও যাননি তিনি। অথচ কর্মসূচির একদিন আগে তাকে লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে।

একই অবস্থা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের ক্ষেত্রে। সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়ে গ্রেফতার হওয়া এই নেতাকে আগের মতো সোচ্চার দেখা যাচ্ছে না।হাতেগোনা কয়েকটি অনুষ্ঠানে দেখা গেলেও আগের সেই ভূমিকায় নেই বলে অনেকে মনে করছেন।

একটি মামলায় কারাগারে আছেন যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান। নির্বাচনের আগ থেকে তিনিও নিষ্ক্রিয়। এর মধ্যে একাধিকবার কারাগারে গিয়ে আবার মুক্তি পেলেও কখন তিনি বের হলেন, কখন জেলে গেলেন— টেরই পাওয়া যায়নি। কারাগারে আসা-যাওয়ার মধ্য থেকে তিনি যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!