কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে নির্বাচন!

ক্যাপ্টেন (অবঃ) মারুফ রাজুঃ বিশ্বনন্দিত ব্যক্তি হলেও অধ্যাপক ইউনূস রাজনীতির মাঠে বেশ আনাড়ি। তবে আলোচনার টেবিলে কিংবা মাইকের সামনে তার জুড়ি মেলা ভার। মবস্টারদের প্রভাব, বিভিন্ন চক্রান্ত মোকাবিলার ব্যর্থতা কিংবা যে কারণেই হোক তিনি রাজনীতির মাঠে ইতোমধ্যেই অনেক গুবলেট পাকিয়েছেন। তবে আলোচনার টেবিলে প্রফেসর ইউনূস আবারো প্রমাণ করলেন তার দক্ষতা কতটা গভীর ও দূরদর্শী। 

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠক এবং আলোচনার কৌশল দেখে অনেকটাই পরিষ্কার—যেখানে অন্যরা রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের খেলায় ব্যস্ত, সেখানে ইউনূস আলোচনার মাধ্যমে হিসাব কষে আগাচ্ছেন। ঈদের আগে যে এপ্রিল মাসে নির্বাচন আয়োজনের এক ধরনের ইঙ্গিত সরকার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, সেটাকে সাধারণ কেউ মনে করলেও, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক চক্র জানে—এটা ছিল দরকষাকষির কৌশল। 

আমি শুরুতেই বলেছিলাম এই সময়টা কোনভাবেই চূড়ান্ত নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্ধারিত ছিল না। বরং এটা ছিল এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ টেস্টিং’। প্রফেসর ইউনূস সেই সময়কালকে বেছে নিয়েছিলেন সম্ভাব্য সব রাজনৈতিক সিনারিও সামনে রেখে। তিনি জানতেন, বিএনপি তখন নির্বাচন মেনে নেবে না। তখনই দরকষাকষির আসল খেলা শুরু হবে। তারপর তিনি তার হিসাব অনুযায়ী বাজি ধরে সুযোগ মতো বাজিমাৎ করে দিতে পারবেন। বাস্তবতা বলছে এখানে তিনি বাজিমাৎ করেছেন এবং বিএনপিও কিছু হারায়নি। 

একবার ভেবে দেখুন, অধ্যাপক ইউনূস যদি তার প্রথম পাবলিক স্টেটমেন্টেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের প্রস্তাব দিতেন, তাহলে বিএনপি কৌশলগতভাবে ডিসেম্বরের দাবি তুলে ধরত। এতে সরকারের দরকষাকষির জায়গা কমে যেত। ডিসেম্বর সামনে আসলেই সরকারকে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে হতো এবং একবার তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত।

লন্ডনে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠক থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে—সরকার এখন বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। জামায়াত ও এনসিপি এপ্রিলের নির্বাচনকে স্বাগত জানালেও, সরকার তাদের বক্তব্য কিংবা রাজনৈতিক মতামতকে বড় করে দেখছে না।

বিশেষ করে জামায়াত চেয়েছিল রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে, কিন্তু পারেনি। আর এনসিপি, যেহেতু এখনো তরুণ দল, তারা রাজনৈতিক ইগো গেমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং, সরকার শুধুমাত্র বিএনপির দাবির মুখেই নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে নমনীয়তা দেখিয়েছে—যদিও শর্তসাপেক্ষে। আর এই শর্তও অনেকটা বিএনপির পক্ষ থেকে যেটুকু ছাড় দেওয়া হবে তার সঙ্গে সম্পর্কিত। 

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন—ফেব্রুয়ারিতে সত্যিই কি নির্বাচন হবে? সরকার তার বিবৃতিতে অনেকগুলো ‘ইফ’ ও ‘বাট’ জুড়ে দিয়েছে। এটা তাদের কৌশল—দায় ভবিষ্যতে বিএনপির ঘাড়ে ফেলার প্রস্তুতিও বলা যেতে পারে এগুলোকে। তবে আমি মনে করি বিএনপিকে আলোচনায় ও সংস্কারে আগের চেয়ে বেশি আন্তরিকতা দেখাতে হবে। যদি তারা সেটা করতে না পারে তখন সরকার আবার ল্যাং মারার চেষ্টা করলে তাতে নতুন করে অবাক হওয়ার কিছু নাই। 

আমার ধারণা সেক্ষেত্রে কথিত সেই নির্বাচনবিরোধী গ্যাংটা আবার বলবে—‘দেখুন, আমরা প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু ওরা সময় নষ্ট করেছে।’ এপ্রিলের নির্বাচন ঘোষণার মাধ্যমে সরকার বিএনপিকে আলোচনার সুযোগ দিয়েছিল যাতে পরবর্তীতে শর্ত আরোপ করা যায়। এজন্যই আমার হিসাবে এই কৌশল সরকারের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক পরিকল্পনারই অংশ। কারণ অন্যসব সরকারের মতো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও অন্তত রাজপথে বিএনপিকে চরম ভয় পায়। 

শেখ হাসিনা যেমন নির্বাচন বাদ দিয়ে অন্যসব রাস্তায় হেঁটেছেন। কারণ তার হিসাবে মিডিয়া কিংবা গায়ের জোরে বিএনপিকে নাই করা গেলেও রাজপথের বিএনপি কিংবা ব্যালটের লড়াইয়ের বিএনপিকে মোকাবিলা করার সক্ষমতা আওয়ামী লীগ কেন বাংলাদেশে কারও নেই। এজন্যই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও চাইছে, বিএনপি রাজপথ ছেড়ে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসুক। কারণ, টেবিলে এনে আলোচনা করলেই বিএনপিকে সহজে ‘হ্যান্ডেল’ করা সম্ভব।

সবার কাছে প্রশ্ন রয়ে গেছে, ঐ বৈঠকে আসলে কি কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে? সংস্কারের বাইরেও কি এমন কিছু আলোচনা হয়েছে যা আমরা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শুনতে পাইনি? এগুলো সময়ই বলবে। তবে একটা কথা নিশ্চিত—বিএনপি এই আলোচনায় জয় পায়নি, কিন্তু হেরেও যায়নি। বরং একধরনের কৌশলগত জটে আটকে গেছে। এখন তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, তারা এই আলোচনা থেকে কীভাবে কৌশলগত সুবিধা আদায় করে। আর তার পুরোটাই নির্ভর করছে একান্ত বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ এবং অনলাইন অফলাইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারা কিংবা না পারার উপর। 

বর্তমান এই বৈঠক আরেকটা বিষয়ও পরিষ্কার করেছে—প্রফেসর ইউনূস ক্ষমতায় যেতে চান না। কিন্তু তিনি কিছু কাঠামোগত সংস্কার নিশ্চিত করে যেতে চান। তিনি চাইছেন যাতে করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও সহনশীল ও স্থিতিশীল হয়। এখন বিএনপির কৌশল হবে—কীভাবে প্রফেসর ইউনূসের চাওয়া ও নিজেদের রাজনৈতিক পরিকল্পনাকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে ফেলা যায়। সেজন্য তাদের আরও সময় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগাতে হবে। 

আমি খোলা চোখে দেখছি এই বৈঠকে বিএনপি আপাতত তেমন কিছু পায়নি, তবে তারা কিছু হারায়নি। কারণ রাজপথে তীব্র আন্দোলন করেও আদায় করে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই—কমপক্ষে প্রফেসর ইউনূসের হাবভাব দেখে তা-ই বোঝা যাচ্ছে। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যাদের বিএনপি অপসারণ চায়, তাদের হাত তিনি ছাড়ছেন না। উনার স্পষ্ট বার্তা এক্ষেত্রে যে নিজের লোকদের হাত তিনি ছাড়ার বান্দা নন। সেই লোক কাজের হোক, অপদার্থ হোক আর ভাদাইম্যাই হোক। তিনি তার শক্তিশালী নেটওয়ার্কিং এবং নেতৃত্বের কৌশল হিসেবে এটা মানেন বলেই কি না বিশ্বজুড়ে এত বন্ধু তার। 

মাঠে এবং অনলাইনে এ মুহূর্তে বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—নিজের অবস্থান ধরে রাখা, আলোচনার মাধ্যমে সংস্কার নিশ্চিত করা। পাশাপাশি রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করা। কারণ, মাঠের খেলা এখন টেবিলেই খেলতে হবে এবং সেটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। পাশাপাশি মাঠের রাজনীতির বেফাঁস মন্তব্য করা বুমার বেকুবদের সতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করতে হবে। সেটা করতে না পারলে প্রতিনিয়ত জেনজির ট্রলের শিকার হয়ে অপদস্ত হওয়া লাগবে। 

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী, ইউনূসপন্থি গোষ্ঠী, বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটি জটিল ও দ্বিমুখী অবস্থান তৈরি হয়েছিল। তার একটি কূটনৈতিক এবং আপাতত শান্তিপূর্ণ সমাধান আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকের বৈঠকের পর থেকে।

বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা। তারেক রহমান ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠক এই সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই আলোচনা প্রমাণ করে, জাতির নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা চাইলে রাজনৈতিক সংকটও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারেন—শুধু সদিচ্ছা ও বাস্তববোধ থাকলেই সেটা সম্ভব।

এই বৈঠক কেবল দুই ব্যক্তির মধ্যে যোগাযোগ নয়, বরং এটি ছিল সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি বার্তা—রাজনীতি মানেই সংঘর্ষ নয়, এর ভেতরে আলোচনার শক্তিও আছে। এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পেলাম, নেতারা যখন চান, তখন ব্যক্তিগত ও দলগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় সংকট সমাধানে এক হতে পারেন।

এই প্রক্রিয়ার সফল বাস্তবায়নে যাদের অবদান রয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো একান্ত কর্তব্য। তারেক রহমানের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং অধ্যাপক ইউনূসের শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রতি আস্থাই এই উদ্যোগকে কার্যকর করে তুলেছে। 

পশাপাশি সেনাবাহিনী প্রধানের নীরব তৎপরতা ও মধ্যস্থতা এই আলোচনা সার্থক হতে সাহায্য করেছে। অনেকেই পর্দার আড়ালে থেকেও এই সমঝোতার পথে কাজ করেছেন—তাদের ভূমিকা অমূল্য। তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতার চেয়ে টেবিলের চারপাশে বসে আলোচনা করাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বেশি কার্যকর এবং সম্মানজনক পথ।

বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে কয়েকজন ব্যক্তি এবং বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তারা উভয় পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন এবং আলোচনাকে কার্যকর করে তুলেছেন। খলিল গং নিয়ে যে উচ্চারণ চারদিকে শোনা যাচ্ছিল আপাত দৃষ্টিতে তাদের নিষ্ক্রিয়ই মনে হচ্ছে। 

একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, এই সংলাপের সাফল্য যেন একটি টেকসই রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করে। সামনে যে নির্বাচন আসছে, সেটি যেন হয় শান্তিপূর্ণ, সর্বজনগ্রহণযোগ্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। কোনো পক্ষ যেন সহিংসতা বা ষড়যন্ত্রের পথে না যায়।

এই আলোচনাকেন্দ্রিক সমাধান আমাদের আরও একবার বুঝিয়ে দিল, সংঘাতের মুখে কূটনীতি ও মানবিক সংলাপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, বাংলাদেশ আবার গণতন্ত্রের পথেই ফিরুক—যেখানে মতের ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু সহিংসতা থাকবে না। এই প্রচেষ্টা সফল হোক—এই কামনা সবার।

Share this post

scroll to top