DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ঢাকা বিমানবন্দর শুল্ক গুদাম থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ন লোপাট নিয়ে তুলকালাম

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের গুদামের লকার থেকে ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা চুরি ঘটনায় ঊর্ধ্বতনরা দায়িত্বে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে না জানিয়েই ভল্টে রাখা হয় বিপুল সোনা। উদ্ধার করা সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান পালিত হয়নি। চার জনের সইয়ের পর মেলে ভল্ট খোলার অনুমতি।

এদিকে চার জন সিপাহিসহ মোট আট জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে থানা পুলিশ। বিমানবন্দরে সাধারণত তিন ক্যাটাগরিতে সোনা উদ্ধার হয়। এক. চোরাচালানি, দুই পরিত্যক্ত ও তিন ঘোষণা দিয়ে আনা। পরে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ট্যাক্স পরিশোধ না করার কারণে অনেক সোনা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সোনার বিস্কুট আনতে পারে যে কোনো ব্যক্তি। আর সোনাসহ যাদের গ্রেফতার করা হয়, তাদের বিষয়টি আদালতে বিচারকার্য সমাপ্তির পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সোনা জব্দ করে লিস্ট করে গুদামে রাখা হয়। জব্দকৃত তালিকার একটি কপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দিতে হয়। এরপর গুদামে রক্ষিত সোনা প্রতি মাসে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কাস্টমস কমিশনার জব্দকৃত তালিকা অনুযায়ী ঠিক আছে কি না তদারকি করে দেখবেন। সেই তদারকির একটি প্রতিবেদন এনবিআরের কাছে পাঠাতে হবে। জব্দকৃত সোনার মধ্যে যেগুলোর মামলা নেই, তা অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা গেছে, এসব নিয়মের কোনো কিছুই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মানেনি। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এত বড় চুরির ঘটনা ঘটেছে। এজন্য তারা দায়ী বলে বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা এমন তথ্য জানান। 

তাদের মতে, নিয়মিত যে তদারকি বিধান রয়েছে, তা করলে এই ধরনের সোনা চুরির কোনো সুযোগ ছিল না। তাই এর দায় তারা এড়াতে পারেন না। কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, বড় বড় চালান অনেক সময় ধরা পড়লেও গুদামে তা জমা না দিয়ে নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যান।

কাস্টমসে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইত্তেফাককে জানান, অনেক সময় দীর্ঘদিন ভল্টে সোনা ফেলে রাখা হয়। এতে নিরাপত্তার ঘাটতির সৃষ্টি হয়। ২০১৯ সালে বেনাপোলে ১৫ কেজি সোনা ধরা পড়ে। সেটি দীর্ঘদিন ধরে অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছিল। পরে তা গায়েব হয়ে যায়। এই ঘটনার পর এনবিআর কর্তৃপক্ষ সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দেয়। সেখানে বলা হয়, সোনা উদ্ধার হওয়ার পর লিস্ট করে গুদামে রাখতে হবে। যারা সোনা উদ্ধার করবেন, তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানিয়ে দেবেন। ঊর্ধ্বতন এসব কর্মকর্তা প্রতি মাসে কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই একবার তদারকি রিপোর্ট করবেন। সেই রিপোর্ট এনবিআরের কাছে জমা দিতে হবে। যেসব চোরাচালানি মামলা হয়, সেক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হয়। তবে পরিত্যক্ত সোনা ধরা পড়ার পরই বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫৫ কেজি সোনার ক্ষেত্রে এসব রিপোর্ট করা হয়নি। নিয়ম না মেনে গুদামে রাখা হয় দীর্ঘদিন। এ কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর দায় এড়াতে পারেন না। এছাড়া কোটি কোটি টাকার সোনা ধরা পড়লেও একশ্রেণির কর্মকর্তা তা জমা না দিয়ে নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেন—এমন অভিযোগ রয়েছে।

৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা উধাও হওয়ার ঘটনায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বিমানবন্দর থানায় মামলা করেছে। থানা পুলিশ গোডাউনের দায়িত্বে থাকা শিফট কর্মকর্তা, কাস্টমস কর্মকর্তা ও সিপাহিসহ আট জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের কাছ থেকে কোনো সন্তোষজনক উত্তর রাত ১০টা পর্যন্ত পায়নি বলে পুলিশ জানায়। তবে এই ঘটনার সঙ্গে তারাই জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা নিশ্চিত যে চার সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক রাখা হয়েছে, তাদের স্বাক্ষর ছাড়া ওই ভল্ট খোলার কোনো উপায় নেই। অপরাধ হিসেবে পেনাল কোডের ৩৮০ ধারায় গোডাউন থেকে স্টিলের আলমারির লকার ভেঙে সোনার বার ও স্বর্ণালংকার চুরির মামলা দিয়েছে কাস্টমস। ঢাকা কাস্টমস হাউজের এয়ারপোর্ট প্রিভেন্টিভ টিমের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় রবিবার রাতে মামলাটি দায়ের করেন। 

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আপাতত মামলাটি থানা তদন্ত করছে। পরে চিন্তা করবো কি করা যায়। বিমানবন্দর থানার ওসি আজিজুল হক ভূঁইয়া বলেন, ভল্টের নিরাপত্তায় যারা ছিল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২ সেপ্টেম্বর কাস্টমস হাউজের গুদাম কর্মকর্তা মাসুদ রানার মাধ্যমে যুগ্ম-কমিশনারকে জানানো হয়, বিমানবন্দর লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডস-সংলগ্ন ট্রানজিট গোডাউন টিজিআর-১-এর গুদামের ভেতরে প্রবেশ করে তিনি দেখতে পান, মূল্যবান পণ্য সংগ্রহের জন্য গুদামে রাখা একটি স্টিলের আলমারির দরজার লক ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। এ সময় তিনি আরও জানান, ২ সেপ্টেম্বর রাতে প্রতিদিনের মতো আটক করা পণ্য টিজিআর ১-এ জমা করে কাজ শেষে আনুমানিক রাত ১২টা ১৫ মিনিটে গোডাউনে তালা বন্ধ করে চাবি নিয়ে চার কর্মকর্তা একসঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমস এলাকা ত্যাগ করেন। গোডাউন কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে বিমানবন্দরের দায়িত্বরত যুগ্ম-কমিশনার গোডাউন পরিদর্শন করেন। তিনি বিষয়টি কাস্টমস হাউজ ঢাকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। 

মামলার এজাহার সূত্রে আরও জানা যায়, যুগ্ম-কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও কমিশনার গোডাউন পরিদর্শনে গিয়ে ভেতরে একটি স্টিলের আলমারির লক ভাঙা অবস্থায় দেখতে পান। একই সঙ্গে গোডাউনে কর্মরত এ বি সি ও ডি এইচ—চার শিফটের কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা, মো. সাইদুর রহমান শাহেদ, মো. শহিদুল ইসলাম ও আকরাম শেখ, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম মোহাম্মদ, মোজাম্মেল হক, মো. আফজাল হোসেন ও সিপাই পদে কর্মরত নিয়ামত হাওলাদারকে লক ভাঙার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় তারা কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে কমিশনারের মৌখিক নির্দেশনায় গোডাউনে রাখা মূল্যবান বস্তু, স্বর্ণ বা স্বর্ণালংকার চুরি হয়েছে কি না তা যাচাই করার জন্য গোডাউন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। নির্দেশনা পাওয়ার পর কর্মকর্তারা রেজিস্টার পর্যালোচনা করে ও প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর জানান, আলমারির মধ্যে রাখা ৪৮টি লকারের মধ্যে প্রায় ৮ দশমিক শূন্য দুই কেজি এবং ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময় আটককৃত ৪৭ দশমিক ৪৯ কেজি অর্থাৎ সর্বমোট ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা পাওয়া যাচ্ছে না। ২ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১৫ মিনিট থেকে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের মধ্যে যে কোনো সময় কে বা কারা সোনার বার ও স্বর্ণালংকার গোডাউন থেকে স্কিলের আলমারির লকার ভেঙে চুরি করে নিয়ে যায় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। চোরাইকৃত সোনার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ইনভেন্ট্রি কার্যক্রম পরিচালনা চলমান রয়েছে। তবে চূড়ান্ত ইনভেন্ট্রির পর একত্রে সোনার পরিমাণ নিশ্চিত করা যাবে।

এদিকে বিমানবন্দরে দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, বিমানবন্দরের একশ্রেণির কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি হয়ে আসতে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। পাশাপাশি থাকে শক্তিশালী তদবির। এসব ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসে চোরাচালানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। গুদামে রক্ষিত সোনা পাচারের সঙ্গেও এই চক্র জড়িত। কর্মকর্তারা বলেন, প্রবাদ আছে, যে বেড়া খেত খায়, সেখানে বেড়া দিয়ে লাভ কী?

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!