DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

মিল্টন সমাদ্দারের যত ‘অপকর্ম’

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ রাস্তার পাশে প্রতিবন্ধি, ভবঘুরে ও অসুস্থ বৃদ্ধদের খোঁজ পেলেই রবিন হুডের মতো ছুটে যান মিল্টন সমাদ্দার ও তার দল। ফেসবুকে এ রকম ভিডিও দিয়ে মানুষের কাছে অর্থ সহায়তা চান তিনি। মিল্টনের হিসাবে প্রতি মাসে সহায়তা হিসেবে জমা পড়ে গড়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

এসব টাকায় রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ায় গড়ে তুলেছেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার। বর্তমানে সেখানে ২০ জনের মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আশ্রিত রয়েছেন বলে জানান মিল্টন সমাদ্দার। আর সাভারে কেনা জমিতে নির্মাণ করেছেন ছয়তলা ভবন। যেখানে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ পুরুষদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে থাকছেন দুইশত পয়তাচল্লিশ জনের মতো।

মিল্টন সমাদ্দারের দেয়া তথ্য যাচাই করতে সাভারের আশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো আশ্রিত রয়েছেন। এছাড়া, দুটি শাখায় মোট ৬০ থেকে ৭০ জন কর্মচারী রয়েছেন। তবে বিভিন্ন সময় ফেসবুক লাইভে মিল্টন দাবি করেন, তিনি আশ্রমের দুইটি শাখায় ৮ থেকে ৯শ’ মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মিল্টন সমাদ্দার এসব কর্মকাণ্ডের আড়ালে অন্যের জমি দখল করছেন। এমনই একজন শামসুদ্দিন চৌধুরী। মিল্টনের সাভারের আশ্রমের পাশের জমির মালিক তিনি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটির অভিযোগ, বহুদিন ধরে এই জমির দিকে মিল্টনের নজর রয়েছে। ঈদুল ফিতরের আগের দিন পরিবারসহ জমি দেখতে গেলে মিল্টনের সাথে কথা কাটাকাটি হয় তার। একপর্যায়ে মিল্টন আশ্রমের মধ্যে পরিবারের সবাইকে আটকে নির্যাতন করে।

ভুক্তভোগী শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, জমিতে যাওয়ার রাস্তা আটকানোর কথা জানতে চাইলে মিল্টন ও তার বাহিনী পরিবারের সবাইকে আটকে নির্যাতন করে। ভয়ভীতি দেখিয়ে জমিটি দখল করার জন্যই মিল্টন এটি করেছে।

আশ্রম পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারাও মিল্টন সমাদ্দারের ভয়ে তটস্থ। গনমাধমের উপস্থিতি টের পেয়ে কেউ কেউ মুখ খুলেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, আশ্রমের কর্মচারীরা মিল্টনের লাঠিয়াল বাহিনীর মতো কাজ করে। স্থানীয় কয়েকজন জানান, মিল্টন জমি দখলের জন্য অনেকেই ভয়ভীতি ও নির্যাতন করেছে।

মিল্টনের এমন আচরণ অনেক পুরোনো। নিজের বাবাকে মারধরের অভিযোগে বরিশালের উজিরপুর থেকে তাকে এলাকাছাড়া করা হয়।

উজিরপুর এলাকার এক বাসিন্দা জানান, ২০০৫ সালে মিল্টন তার বাবাকে মারধর করে। পরে এলাকা থেকে পালিয়ে সে ঢাকায় বসবাস শুরু করে। এখন দেখা যায় সে মানবতার ফেরিওয়ালা। বিষয়টি আশ্চর্যজনক।

অপরদিকে, মিল্টন সমাদ্দার ও তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ার বাসিন্দাদের স্পর্শকাতর একটি অভিযোগ রয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, আশ্রমে দুই থেকে তিনদিন পরপরই মানুষ মারা যেতো। পরে গোসলের জন্য তাদের পার্শ্ববর্তী বায়তুস সালাহ মসজিদে নিয়ে যাওয়া হতো। মসজিতে গোসলের কাজে নিয়োজিতরা মরদেহের শরীরের সন্দেহজনক কাটাছেঁড়া দেখতে পান। এতে মসজিদ কর্তৃপক্ষ শরীর থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চুরির সন্দেহ করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, প্রত্যেকটি মরদেহেই কাটাছেঁড়া থাকে। এ কারণে গোসলের কাজে নিয়োজিত একজন গোসল করাতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলে মরদেহ সেখানে পাঠানো বন্ধ করে দেয়া হয়।

স্থানীয় আরেকজন জানান, মিল্টন কিছু ছেলেপেলেকে পুষতো। কিছুদিক আগে তার আশ্রমে কবুতর যাওয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় দুইজনকে আটকে নির্যাতন করে সে।

দখল ও প্রতারণায় মিল্টন সমাদ্দারের আরও পুরোনো ইতিহাস রয়েছে। নিজ এলাকা বরিশালের উজিরপুরে ‘চন্দ্রকোনা খ্রিষ্টান মিশনারি চার্চ’ নামে একটি চার্চ রয়েছে। এটি দখলের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিল-স্বাক্ষর জাল করে চার্চের নতুন কমিটি গঠন করে সে। পরে বরিশাল জেলা প্রশাসককে একটি চিঠিও দেন তিনি। ওই কমিটিতে মিল্টন সমাদ্দারকে সভাপতি করা হয়। কমিটির বাকিরা তার স্ত্রী ও ভাই।

পরে বিষয়টি চার্চের যাজকদের নজরে আসলে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন তারা। মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি বলে তাদের জানানো হয়।

যাজকরা জানান, চার্চটিকে দখল করতে তারা ব্যপক চেষ্টা চালায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে তাদেরকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলেও জানান তারা।

এসব স্পর্শকাতর নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিটি অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী। মিল্টন সমাদ্দার বলেন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার যে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো কোন হাসপাতালে বিক্রি করা হয়েছে এর প্রমাণ দেখাতে হবে।

তার স্ত্রী কিশোর বালা জানান, তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউট হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত। এমন পেশায় থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারেন না তিনি।

মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছিল সমাজসেবা অধিদফতর। কিন্তু সেখানে সরকারি নিয়মের কিছুই মানা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ট্রাস্টি বোর্ড করা হয়নি। দান হিসেবে কোটি কোটি টাকা পেলেও কখনোই আয়-ব্যয়ের হিসাবের কোনো অডিট করা হয়নি। এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গত ২৫ মার্চ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সমাজসেবা অধিদফতর।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!