DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বিদেশী কুটনিতিকদের মুখ বন্ধ করতে হাসিনা সরকারের কড়া চিঠি!

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি’ কঠোর ভাবে মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে মিডনাইট হাসিনা সরকার।

ঢাকার সব দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে এ সংক্রান্ত অভিন্ন নোট ভারবাল পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই চিঠির একটি কপি পেয়েছে গনমাধ্যম। যেখানে ১৮ই জুলাই ডেটলাইন রয়েছে। অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার একাধিক কূটনৈতিক মিশন সূত্র বলছে, নোট ভারবালটি বিদায়ী সপ্তাহেই মিশনে মিশনে পৌঁছেছে। চিঠিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আমরা সকলকে সম্মানের সঙ্গে এটা স্মরণ করাতে চাই যে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বা কাজে কূটনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তদের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার নীতি পুরোপুরি মেনে চলা উচিত। বিদেশি কূটনীতিকদের শিষ্টাচার মেনে চলার তাগিদ দিয়ে প্রায়শই এমন নোট পাঠানোর দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। নোট ভারবাল পাঠানোর আগে এবং পরে একাধিকবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপেও তিনি বিদেশিদের তৎপরতায় উষ্মা প্রকাশ করেন। কিন্তু বিদেশিদের মুখে কুলুপ আঁটতে মিশনে মিশনে চিঠি পাঠানোর এমন নজির বাংলাদেশে খুব একটা নেই বলে মনে করেন পেশাদার কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। 

জাতীয় নির্বাচন মুক্ত, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারে কূটনৈতিক অংশীদারদের সক্রিয় হয়ে ওঠায় তাদের চাপে ফেলার কৌশল নিয়েছে সরকার। গতকাল বুধবার ২০১৮ সালের রাতে ভোট গ্রহণের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জাপানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এ নিয়ে কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী ও একজন নির্বাচন কমিশনার। সবার বক্তব্যেও মূল সুর ছিল এক ও অভিন্ন।
সরকারের কূটনীতিকদের অনানুষ্ঠানিকভাবে বার্তা দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক কুষ্টিয়ায় এক অনুষ্ঠানে গতকাল এ প্রসঙ্গে কড়া বক্তব্য রেখেছেন। কৃষিমন্ত্রী বুধবার মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে জাপান কেন, কোনো রাষ্ট্রদূতের নাক গলানো আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না। তাদের আবারো সতর্ক করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা এ দেশকে স্বাধীন করেছি। ফলে কারো কাছে পদানত হওয়া অথবা দেশের আত্মমর্যাদা রক্ষায় আমরা কাউকে ছাড় দেবো না।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিদেশী কূটনীতিকদের মধ্যে শিষ্টাচার থাকা উচিত বলে উল্লেখ করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বুধবার সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে বলেছেন, কূটনীতিকদের শিষ্টাচারবহির্ভূত কথা বলার পেছনে বিএনপিই বেশি দায়ী। কেননা তারা বারবার তাদের কাছে গিয়ে কথা বলাতে বাধ্য করে। কূটনীতিকদের পায়ে পানি ঢালে।
একই দিন বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের করা মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচন কমিশনার মো: আনিছুর রহমানও। তিনি বলেন, বিদেশী কূটনীতিকদের আচরণ জেনেভা কনভেনশন (প্রকৃতপক্ষে ভিয়েনা কনভেনশন) দ্বারা সীমাবদ্ধ, তাদের এর মধ্যে থাকাই ভালো। বুধবার নির্বাচন ভবনে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
তিনি বলেছেন, কেবল জাপানের রাষ্ট্রদূত নয়, সম্প্রতি অন্যান্য দেশের কূটনীতিকরাও নির্বাচন নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। তারা কোন প্রেক্ষাপটে কী বলেছেন, এটা তারাই ভালো জানেন। এ বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্তব্য করতে চাই না। এটা কূটনীতিকদের নিজস্ব এখতিয়ার। সেটি সত্য কি মিথ্যা তারাই জানেন ভালো।
কূটনীতিকদের মন্তব্যে ইসির প্রতি অনাস্থা আরো প্রকট হয় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আস্থার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। কী ছিল বা আছে, আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। আপনারা দেখেছেন, বিভিন্ন সময় আমাদের সাথে ছিলেন। ভোটের (জাতীয় নির্বাচনের) আগে আমরা আরো আস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করব। মানুষ এখন বোঝে অনেক কিছুই। ভালোমন্দের বিচার তারাই করে থাকে। আমরা যদি খারাপ করে থাকি, আমরা ইচ্ছা করলেও অনাস্থা ফিরিয়ে নিতে পারব না।
বিদেশীদের সহযোগিতাও লাগবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিদেশীরা কি ভোটে সরাসরি কিছু করতে পারে? তাদের অভ্যন্তরে আমরা কিছু বলতে পারি কি না। সে অনুযায়ী তাদের কথাগুলো বলার কথা। আমাদের ওপর কোনো দিক থেকেই কোনো চাপ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক কূটনীতিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সরকার সম্ভবত কূটনীতিকরা সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করায় তাদের উল্টো চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে। তার মতে, দু’টি কারণে সরকার এটি করে থাকতে পারে। প্রথমত, মুক্ত, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে চাপে রাখতে চাইলে সরকার বিপরীত বৈশ্বিক শক্তি বলয়ে যাওয়ার বিষয় বিবেচনায় রাখতে পারে এমন বার্তা তাদের দেয়া। দ্বিতীয়ত, কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেসামরিক ও নিরাপত্তা প্রশাসনকে সরকারের সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মর্মে বার্তা দেয়া। বিশেষত বিরোধী পক্ষের আন্দোলনের মুখে এ ধরনের বার্তা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করতে পারে সরকার পক্ষ।
জাপানের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব : জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। গতকাল ফেসবুক পেইজে দেয়া এক পোস্টে প্রতিমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের অ্যাম্বাসেডরকে ডেকেছিলাম। তাকে যা যা বলা দরকার আমরা বলেছি। সবকিছু বিস্তারিত গণমাধ্যমে বলার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তাই এই বিষয়ে গণমাধ্যমে আমরা আর কোনো বক্তব্য দিতে চাই না।’
তিনি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন জাপান সফরে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো গভীর হবে। আশা করি, এই সফর বাংলাদেশ এবং জাপানের সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে।
গত সোমবার রাজধানীতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক আলোচনায় জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, আমি শুনেছি ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশ কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। অন্য কোনো দেশে আমি এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। আশা করব, আগামী নির্বাচনে তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না। পুলিশ কর্মকর্তারাও আরো সতর্ক হবেন।
রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্য ক্ষমতাসীন দলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরদিন বেসরকারি একটি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য অনাকাক্সিক্ষত। বিদেশী কূটনীতিকরা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করলে সরকার কঠোর হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশী বন্ধুদের পরামর্শের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বন্ধুদেশের রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য সরকার আশা করে না। গত চার বছরে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ জাপান সরকার করেনি। রাষ্ট্রদূত নাওকির মন্তব্যের ব্যাখ্যা চাইবে সরকার।
জাপানের রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যারা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন তাদের নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শাহিরয়ার আলম। তিনি বলেন, এর পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে তা খতিয়ে দেখা হবে। আগামী ২৯ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে যাবেন। এই সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রদূত নাওকিকে গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকেছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
জাপানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গত সোমবার শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, পারস্পরিক সম্মান না থাকলে পারস্পরিক আস্থা থাকে না। গণমাধ্যমে বাংলাদেশের কয়েকটি বিদেশী মিশন প্রধানদের যেসব বক্তব্য আসছে, তা ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। তারা কি মিয়ানমারে গণহত্যা ও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বহিষ্কার নিয়ে কিছু বলেন বা করেন? জাপান কি মিয়ানমারে বিনিয়োগ, দ্বিমুখী নীতি বন্ধ করবে?
উল্লেখ্য, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাষ্ট্রদূতদের বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৮ জুলাই ঢাকার সব বিদেশী দূতাবাস, জাতিসঙ্ঘ কার্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়েছিল। চিঠিতে ভিয়েনা কনভেনশনের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং কনসুলার নীতি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। এরপরও এ ধরনের বৈঠক নানা অবয়বে অব্যাহত রয়েছে।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!