কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু, দেশজুড়ে প্রতিবাদ

এস এম মাঈন উদ্দিন (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১)

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেয়। তারা শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি তোলে।

কে এই লেখক মুশতাক ও গ্রেপ্তারের কারণ কি ?

মুশতাক আহমেদ ছিলেন একজন লেখক, উদ্যোক্তা এবং সমাজ-রাজনীতি সচেতন নাগরিক। তার লেখা ‘কুমির চাষের ডায়েরি’ বইটি বেশ জনপ্রিয়। তিনি “মাইকেল কুমির ঠাকুর” নামে একটি ফেসবুক পেজ পরিচালনা করতেন, যেখানে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করতেন। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন।

২০২০ সালের মে মাসে র‍্যাব কর্তৃক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন মুশতাক আহমেদ ও জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল:

  • ফেসবুকে করোনাভাইরাস নিয়ে “গুজব ও মিথ্যা তথ্য” ছড়ানো

  • জাতির জনকের প্রতিকৃতি, জাতীয় সংগীত, ও জাতীয় পতাকা অবমাননা

এই মামলায় মুশতাকের জামিন আবেদন ৬ বার নাকচ হয়। তিনি দীর্ঘ ৯ মাস কারাগারে ছিলেন।
 

মৃত্যুর পর প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া

মুশতাকের মৃত্যুর পর তার পরিবার, সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি ওঠে। তার ভাই ডা. নাফিছুর রহমান বলেন, “মরদেহে তেমন কোনো সমস্যা চোখে পড়েনি, তবে ময়নাতদন্ত ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না।”

গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. অসিউজ্জামান চৌধুরী সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং জানান, প্রাথমিকভাবে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে এসআই সৈয়দ বায়েজীদ জানান, “মুশতাকের পিঠে ও ডান বাহুতে লালচে-কালো দাগ দেখা গেছে।”

ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শাফি মোহাইমেন বলেন, “বাহ্যিক কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।”
 

সুশীল সামাজিক প্রতিক্রিয়াঃ

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ তার ফেসবুকে লেখেন:

“মুশতাক কীভাবে মারা গেছেন তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে তিনি রাষ্ট্রের হেফাজতে ছিলেন… এই মৃত্যুর দায় সরকারের।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন:

“মুশতাক জেলে মারা গেছে। তার অপরাধ ছিল লেখালেখি করা, অন্য কিছু নয়।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারো মানুষ #JusticeForMushtaq হ্যাশট্যাগে প্রতিবাদ জানায়। ছাত্র অধিকার পরিষদ, নাগরিক সমাজ, ও রাজনৈতিক কর্মীরা শাহবাগে মশাল মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।

 

তদন্ত ও সরকারি অবস্থান

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গাজীপুর জেলা প্রশাসন, ও কারা অধিদপ্তর পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন:

“তিনটি তদন্ত কমিটির অভিমত—মুশতাক আহমেদের মৃত্যু স্বাভাবিক। তিনি বাথরুমে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়।”

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই তদন্তকে “অস্বচ্ছ” বলে অভিহিত করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানায়।
 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিতর্ক

মুশতাকের মৃত্যুর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। ডিএসএ ভিকটিমস নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে বলে:

“এই মৃত্যু কার্যত রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারাগুলো বাতিল করতে হবে।”

তারা আরও দাবি করে, “নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনেও পুরনো মামলাগুলো বহাল রয়েছে, যা জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে।”

মুশতাক আহমেদের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের অপব্যবহার, এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।

অনেকে এখনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী। অনেকে জামিন পেলেও মামলার ঘানি টানছেন। এই ঘটনা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিকে আরও জোরালো করেছে এবং নাগরিক সমাজকে নতুনভাবে সংগঠিত করেছে।

Share this post

scroll to top