DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

কি হচ্ছে শ্যুটিং ফেডারেশনের অভ্যন্তরেঃ বৈধ অন্ত্র নিয়ে চলছে অবৈধ কার্যক্রম?

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  বাংলাদেশ শ্যুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের (বিএসএসএফ) বেশ কিছু অস্ত্র গুলি গুদাম থেকে গায়েব হওয়ার ভয়ংকর তথ্য পাওয়া গেছে। আবার রেজিষ্ট্রারে উল্লেখিত গোলাবারুদের চাইতে কিছু গোলাবারুদ বেশি পাওয়া গেছে। শ্যুটিং ফেডারেশনের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য শুটিং সরঞ্জাম সংরক্ষণাগার যাচাই প্রতিবেদন এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অস্ত্র রেজিস্ট্রারে আছে গুদামে নেই আবার গুদামে আছে রেজিষ্ট্রারে নাই।

তদন্ত কমিটির দেওয়া তথ্য মতে বিএসএসএফের সেইফ কাস্টডিতে একটি ট্রাঙ্ক রয়েছে। যার মালিক বিএসসএফের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। ট্রাঙ্কটি খুলে দেখানোর জন্য তাকে বার বার চিঠি দেওয়া হলেও তিনি সেটা দেখাননি। এছাড়া শ্যুটিং ফেডারেশনের অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে গঠিত অপর একটি কমিটি তুলে ধরেছে শ্যুটারের লাগেজে করে সাত টি প্রাণঘাতিঅস্ত্র অবৈধভাবে নিয়ে আনার তথ্য। আর এসব অভিযোগের তীর পুরোটাই শুটিং ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর বিরুদ্ধ। তবে তিনি বলেন এসব অভিযোগ সঠিক নয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন শুটিং ফেডারেশনের এসব অস্ত্র গোলাবারুদ সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের হাতে চলে যেতে পারে। যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করবে। তারা আরও বলেন, ‘১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন অনুযায়ী সরকারি বেসরকারি যেকোন দপ্তরের অস্ত্রের হিসাব নিকাশ ও এর রক্ষনাবেক্ষণ সঠিকভাবে রাখা বাধ্যতামূলক।অনুমোদনের বাইরে কোন অস্ত্র রাখা ও কোন গুলি খরচ করা ফৌজদারী অপরাধ।’

বিএসএসএফের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য শুটিং সরঞ্জাম সংরক্ষনাগার যাচাই কমিটির চার সদস্যের প্রতিবেদনে বেশ কিছু অস্ত্র গুলি গায়েব থাকা ও কিছু অস্ত্র বাড়তি থাকার বিস্ময়কর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।ওই কমিটির সদস্য ছিলেন জিয়া উদ্দিন আহমেদ, আহমেদ কবির, নাজিয়া নওশাদ জুয়েল ও মোহতাসিম মেহেদী।

কমিটি সম্প্রতি সরেজমিনে অস্ত্র গোলাবারুদ ও অন্যান্য শুটিং সরঞ্জাম যাছাই-বাছাই একই সঙ্গে স্টক রেজিস্ট্রার, আমদানী ও বরাদ্দের কাগজপত্র যাচাই করে। কমিটি প্রতিবেদনে বলে, ‘শ্যুটিং সরঞ্জাম, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও টার্গেট পেপার শুধু স্টকে লেখা রয়েছে, কিন্তু বিক্রি ও স্টক সমন্বয় করা হয়নি কারণ স্টক কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহারের আগে অর্থৎ ২০১৫ সালের আগে রেজিস্টার হালনাগাদ করা হয়নি।

গোডাউনে রহস্যময় ট্রাঙ্ক: বিএসএসএফের সেইফ কাস্টডিতে মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর মালিকানায় একটি ট্রাঙ্ক রয়েছে। সেই ট্রাঙ্কটি খুলে দেখানোর জন্য অস্ত্রাগার যাচাই বাছাই কমিটি তাকে কয়েদ দফা চিঠি দেন। কিন্তু তিনি কোনভাবেই ট্রাঙ্কটি খুলে দেখাতে রাজি হননি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ট্রাঙ্কটি অবৈধ অস্ত্রে ভর্তি করা রয়ছে।

যা শ্যুটিং ফেডারেশনের গুদামের মতো নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়েছে। বিএসএসএফের কার্য নির্বাহী কমিটি ট্রাঙ্কটি খুলে না দেখালে সেটি, সেখান থেকে নিয়ে যেতে অপুকে নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি ট্রাঙ্কটি সরিয়ে নেননি। পরবর্তীতে কমিটি এবিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে অবহিত করেছে। ফেডারেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, অপু জার্মান থেকে শুটারদের লাগেজ ব্যাবহার করে বেশ কিছু অস্ত্র নিয়ে আসেন। ওইসব অস্ত্রসহ আরও অবৈধ অস্ত্র ট্রাঙ্কে রাখা হয়ে থাকতে পারে।

বিদ্যুত সংযোগ নষ্ট থাকায় মূল্যবান অস্ত্র নষ্ট: প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্র গোলা বারুদ এবং অন্যান্য শ্যুটিং সরঞ্জাম গুদামে যাচাই ও স্টক দেখা হয়। বিএসএসএফের হিসাবরক্ষক আব্দুল বারেকের তত্ত্বাবধানে গুদামগুলি পরিচালিত হয়। গুদামের দেওয়াল স্যাঁতস্যাঁতে হওয়ার কারনে এর রং ঝরে গেছে। গুদামের বৈদ্যুতিক সংযোগ নষ্ট থাকার কারনে আদ্রতা চুষে নেওয়ার যন্ত্র অচল ছিল। আদ্রতা চুষে নেওয়া যন্ত্র বিকাল থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে শুটিং ফেডারেশনের বহুমূল্যবান অস্ত্র ও গুলির মান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অস্ত্রগুলি কাংখিত ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়।

সেইফ কাস্টডিতে অন্যের অস্ত্র: বিএসএসএফের সেইফ কাস্টডির আওতায় আকরামী আলী একটি শর্টগান, একটি পিস্তল ও একটি রাইফেল, ইন্তেখাবুল হামিদ একটি শর্টগান, (তদন্ত কমিটি তার ট্রাঙ্ক খুলে দেখতে পারেনি), আলিয়া আহমেদ একটি ৭ মিমি মাউসার রাইফেল, কাশেম হুমায়ন একটি পয়েন্ট ২২ রাইফেল ও একটি পিস্তল, আনোয়ার করিম ২টি শর্টগান ও আসগর করিম দুটি অস্ত্র রাখেন। এর বাইরে বিএসএসএফের গুদামে ফেডারেল রাইফেল ক্লাবের গুলি রক্ষিত আছে।

প্রতিবেদনে অসমঞ্জস্যতা: স্টক লিস্টের বাইরে অনেক এয়ার রাইফেল, পিস্তল ও পয়েন্ট ২২ বোর রাইফেল পাওয়া গেছে। যা ২০১২ সালের আগে বিভিন্ন ক্লাব থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। গুদামে ৬০টি ফায়ার ওয়ার্কস ১২ বোর নষ্ট গুলি আছে কিন্তু স্টক রেজিষ্ট্রারে সেগুলো দেখা যায়নি। সাইবার বার্ড বিএসএফের স্টক লিস্টে থাকলেও সেটি পাওয়া যায়নি। আব্দুল বারেক কমিটিকে বলেন, এই অস্ত্রটি বিকেএসপিতে আছে।

পিস্তল রাইফেল গায়েব: ‘পয়েন্ট ১৭৭ এয়ার পিস্তল হামারলী এপি-২০ এর স্টক প্রতিবেদেনে ৩ টি থাকলেও গুদামে পাওয়া যায় ২টি। একইভাবে পয়েন্ট ১৭৭ এয়ার রাইফেল হামারলী এআর-২০ স্টক প্রতিবেদনে ৬টির স্থলে ৫টি পাওয়া গেছে। এবিষয়ে কর্মকর্তারা তদন্ত কমিটিকে বলেন ২ জন শ্যুটার সেগুলি ব্যবহার করছেন। কিন্তু এর কোন বরাদ্দ তারা দেখাতে পারেনি।

প্রতিবেদনের তথ্য মতে এয়ার পেলেট স্টক ২০১৫ সালের ১ জুলাই সমন্বয় করা হয়েছে। রেজিষ্ট্রার ও স্টকের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে ফাইনাল ম্যাচ রাইফেল, পিস্তল, ডায়াবোলো, আর-১০ রাইফেল, মেইস্তার রাইফেলসহ কয়েকটি অস্ত্রের স্টক মিলেনি।

গুলি কম : বিএসএসফের গুদামে রেমিংটন নং ৬, ৩৬ গ্রাম ৬০টি গুলি স্টকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে আরসি নং ৬, ৩৬ গ্রাম ৬০টি গুলি। পিস্তলের ম্যাগাজিন এরমা ১০ শর্ট ২টির স্থলে পাওয়া গেছে ৪টি, এস অ্যান্ডডব্লিউ পিস্তল ম্যাগাজিন নং ৬৫২ এর ৫টির স্থলে পাওয়া গেছে ৩টি। ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল ১০ এক্স স্কাই ইলি গুলি রেজিষ্ট্রারে দেখানো আছে ১৩ হাজার ৭২০টি। নতুন রেজিষ্টারে আছে ১৩ হাজার ২৭০।

২০১২ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর নতুন পরিষদের দায়িত্ব নেওয়ার পর রেজিষ্ট্রারে লাপুয়া প্লিস্কার গুলি স্টক দেখায় ১২২৮টি, পরের বছর ৩০ জুনের স্টক দেখায় ১২শ’টি। এসময় ২২৮টি গুলির কোন হিসাব দেখানো হয়নি। লাপুয়া র‌্যাপিড ফায়ার শর্ট দেখানো হয়েছে ৫০০ পরের বছর ৩০ জুন দেখাননো হয় ৩০০। এসময় ২০০টি পাপুয়া র‌্যাপিড ফায়ার শর্ট গুলি বিক্রি দেখানো হয়নি।২০১৭ সালের ১ জুলাই আরসি-৪ স্পেশাল ৩৩ গ্রাম গুলির রেজিস্টারে দেখায় ৫৪৯৫টি। কিন্তু কম্পিউটার সফটওয়্যারে গননা করা হয় ৫৪৭৫টি। ২০টি গুলির হিসাব পাওয়া যায়নি।২০১৭ সালের ১ জুলাই আরসি মাগনাম নং ০, ৪২ গ্রাম গুলির স্টক দেখায় ১৭ হাজার ৭৫টি। কিন্তু কম্পিউটারে গননা করা হয় ১৭ হাজার পিস। ৭৫ পিস গুলির হিসাব মিলেনি।

গুলি বেশি : ২০১২ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর লাপুয়া সুপার গুলির পারম্ভিক স্টক দেখায় ৩০০ পরের বছর ৩০ জুন দেখায় ১৪২৪। এসময় ১১২৮গুলি কিভাবে যুক্ত হলো তার বিবরণ দেওয়া হয়নি। ১২ বোর নং ৬, ৩৬ গ্রাম গুলি রেজিষ্ট্রারে না থাকলেও বিক্রি দেখানো হয়েছে ৪০টি।

প্রতিবেনে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালের ২৯ মে এলসি নং ০৩৪৬৪০১০০০৫-এ আমদানী করা অস্ত্র স্টক রেজিষ্ট্রারে ক্রমিক লেখা হয়নি। এলসি নং ০৩৬৪১৫০১০০০২ এর মাধ্যমে ৬০ হাজার পিস পয়েন্ট ২২ ইলি গুলি আমদানী করা হয়। কিন্তু স্টক রেজিষ্ট্রারে লেখা রয়েছে ৬০ হাজার ২০০। কিন্তু আগের কোন রেজিষ্ট্রারে ২০০ গুলির স্টক রেজিষ্ট্রার দেখা যায়নি।

আমদানী করা যন্ত্রাংশের তথ্য নাই: এলসি নং ০৩৪১৪০১০০০৬-এর অনুকূলে আমদানী করা যন্ত্রাংশ স্টক রেজিষ্টারে লেখা নাই।

অনুশীলনের এত গুলি নিয়ে রহস্য : ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অ্যাডভান্স অনুশীলন ক্যাম্প থেকে ২৪ হাজার ৬০০টি পয়েন্ট ২২ বোর ইলি ক্লাব গুলি ফেরত দেখানো হয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক গুলি অনুশীলন ক্যাম্প থেকে ফেরত দেওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হয়েছে এবং অনুশীলন ক্যাম্পে এত বিপুল সংখ্যক গুলি মওজুদ থাকার কথা নয়। ২০১৭ সালের জুন মাসে ১০০ পিস পয়েন্ট২২ রেমিংটন এলআর গুলি ফেরত দেখানো হয়েছে। কিন্তু ফেরতের বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া য়ায়নি। ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল ৯৫০টি পয়েন্ট ২২ বোর ইলি সাবসনিক হোল পয়েন্ট গুলি অনুশীলন ক্যাম্প থেকে ফেরত দেখানো হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলেন, আমাদের জানামতে সাবসনিক গোল পয়েন্ট গুলি দিয়ে কোন শুটিং অনুশীলন সম্ভব নয়। ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট জাতীয় শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় ১০০০টি ১২ বোর স্কীট গুলির চাহিদার বিপরীতে সরাবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৬টি। অতিরিক্ত ৩৬ গুলি নেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রহীতার স্বাক্ষর দেওয়া হয়নি।

ট্যালেন্ট হান্টে অনিয়ম: প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ট্যালেন্টহান্ট প্রোগ্রামের জন্য গুলির চাহিদাপত্রে মহাসচিবের স্বাক্ষর নেই। বিভিন্ন স্টক জার্নাল লিখে স্টকের সঙ্গে গুলি যোগ বিয়োগ করে সমন্বয় করা হয়েছে। বিভিন্ন অনুশীলন ও প্রতিযোগিতা থেকে অব্যবহৃত গুলি এভাবে সমন্বয় করা হলেও এর পক্ষে কোন প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি।

চাহিদার অধিক সরবরাহ: প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় ১২ বোর স্কীট গুলির ১০০০ চাহিদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ করা হয়েছে ১০৩৬টি। ওই চাহিদাপত্রের মহাসচিবের স্বাক্ষর নেই এবং ৩৬টি গুলি দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রহিতার স্বাক্ষর নেই। একই বছর ১ মার্চ পয়েন্ট ২২ বোর গুলি এক হাজারের স্থলে রেজিস্ট্রারে ২০০০ লেখা রয়েছে।২০১৬ সালের ৫ মার্চ ২ হাজারটি ১৭৭ পেলেট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা রেজিষ্টারে লেখা নাই। একই বছর ৩০ জুলাই স্লাভিয়া এয়ার রাইফেল ৫.৫ পিরোজপুর এয়ার রাইফেল ক্লাবকে বরাদ্দ পত্রে মূল্য লেখা আছে ৩৫ হাজার টাকা কিন্তু ডেলিভারী চালানে লেখা ৩০ হাজার টাকা। ২০১৬ সালের ১ মার্চ নেত্রোকোনা রাইফেল ক্লাব পয়েন্ট ২২ বোর গুলি কিনে ১ হাজার পিস। কিন্তু স্টক বইতে তাদের বরাদ্দ দেখানো হয় ২ হাজার পিস। ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল ৮ম বাংলাদেশ গেমস উপলক্ষ্যে ১০০টি ১২ বোর ৭.৫ , ২৮ গ্রাম গুলি বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু গুলিগুলো স্কীট প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৪ সালের ২০ মে ২০ হাজারটি এয়ার পেলেট বরাদ্দ করা হলেও স্টক বইতে সমন্বয় করা হয়নি। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এক হাজার এয়ার পেলেট বরাদ্দ হলেও স্টক বইতে দেখানো হয় ১২০০টি। পয়েন্ট ২২ এলআর১৯২২ গুলি ১৫০টি বরাদ্দ দেওয়া হলেও স্টকে দেখানো হয় ২৫০টি। এভাবে শ্যুটিং ফেডারেশনে অস্ত্র ও গুলির হিসাবে ব্যাপক গড়মিল পাওয়া যায়।

ঘোষণা ছাড়াই আসে প্রাণঘাতি অস্ত্র : শ্যুটিং ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ জার্মান থেকে ফেরার পথে শ্যুটারদের লাগেজ ব্যবহার করে কোন ধনের স্ক্যানিং ও ঘোষণা ছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ভিআইপি গেইট ব্যবহার করে ৭ টি এনসুজ এয়ার রাইফেল নিয়ে আসেন। তার বিরুদ্ধে নামে বেনামে আরও বহু অভিযোগ জমা হয় শ্যুটিং ফেডারেশনে।পরবর্তীতে বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের মহাসচিবের দুর্নীতি ও নানা অনিয়ম তদন্তের জন্য বিএসএসএফ সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী গত বছরের ৯ আগস্ট একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির আহবায়ক ছিলেন হোসনে আরা। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন ইয়াসমিন গফুর ও জিয়াউদ্দিন আহমেদন। কমিটি গত এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে।

অস্ত্র আনা শ্যুটারের বক্তব্য : তদন্ত প্রতিবেদনের ১৭ নম্বর পাতায় মাহফুজা জান্নাত জুঁই নামে একজন শ্যুাটার তার স্বাক্ষ্যে উল্ল্যেখ করেন ‘২০১৭ সালের মে মাসে আইএসএসএফ (ইন্টারন্যাশনাল শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন) ওয়ার্ল্ড কাপ অংশ নিতে যাই। আমার সঙ্গে ছিলেন সুরাইয়া, দিশা, আর্মিন, টমাস, রিসালাত, মুন্না, বাকী, আনোয়ার ও শালিক। আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন কোচ ক্লাউস মার্কো ও ফেডারেশনের মহাসচিব ইনতেখাবুল হামিদ অপু।

শ্যুটিং স্থলের পাশে বিভিন্ন কোম্পানীর দোকান বা মেলা ছিল। প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর আমাদের উপস্থিতিতে ফডারেশনের ইনতেখবুল হামিদ অপু ৬টি ওয়ালথার এলজি ৪০০ মডেলের রাইফেল কিনেন। বাংলাদেশে পৌঁছার পর বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট দিয়ে আমরা বের হয়ে ওই অস্ত্রগুলোসহ শুটিং ফেডারেশনে আসি। ৩-৪ মাস পর আমি ব্যক্তিগতভাবে ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় কেবিএ ২০৬৯ এলজি ৪০০ ওয়ালথার অস্ত্রটি কিনে নেই। ফেডারেশনের হিসাবরক্ষক বারেকেরে নিকট থেকে অস্ত্র বুঝে নেই। অস্ত্রটির সঙ্গে আমাকে টাকার কোন রশিদ বা কাগজপত্র দেওয়া হয়নি। অন্য অস্ত্রগুলোর মধ্যে রিসাল, মুন্না ও দিশা একটি কওে পেয়েছেন। অন্য দুটি অস্ত্রের বিষয়ে আমার জানা নাই।’

অবৈধ অস্ত্র আনার তদন্তে শুল্ক গোয়েন্দা: বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট ব্যবহার করে ঘোষণা ছাড়াই প্রাণঘাতি অস্ত্র আনার বিষয়টি তদন্ত করছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধবতন কর্মকর্তা বলেন, ‘শ্যুাটারদের লাগেজ ব্যবহার করে কোন ধরনের ঘোষণা ছাড়াই অস্ত্রগুলো অবৈধভাবে আনা হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। তদন্ত প্রতিবেদনে এবিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। এর বাইরে ওই কর্মকর্তা কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। ’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, শুটিং ফেডারেশনের একজন কর্মকর্তা শ্যুটারদের লাগেজ ব্যবহার করে বেশ কিছু অস্ত্র অবৈধভাবে এনেছেন বলে আমরা তদন্তে জানতে পেরেছি। যাদের লাগেজে করে এসব অস্ত্র আনা হয়েছে ওইসব শ্যুটাররাও এর দায় এড়াতে পারেন না।’

ওইখানে অস্ত্রের সংখ্যা কত ছিল জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দার এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কোন কোন শ্যুটার স্বাক্ষ্যে ৬ টি, কেউ আবার ৭টি বলেছেন। আমাদের মনে হচ্ছে বিদেশ থেকে আনা অস্ত্রের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। যেহেতু তারা কোন ঘোষণা দেয়নি এবং বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট দিয়ে তাদের লাগেজ নিয়ে আসায় তল্লাশী হয়নি; তাই অবৈধভাবে আনা অস্ত্রের সঠিক সংখ্যা আমরা পাইনি।’

কাজের নামে মহাসচিবের হরির লুট : শুটিং ফেডারেশনের অপর এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘সংস্থাটির মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘ডেলকো’ শুটিং ফেডারেশনের ১০ মিটার শ্যুটিং রেঞ্জার স্থাপন করে। প্রতিটি রেঞ্জারের দাম নিয়েছে ২৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ফেডারেশন একই টার্গেট চেঞ্জার ভিশন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ক্রয় করে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ১২৪ টাকায়।’

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ফেডারেশন ভবন আধুনিকায়নের জন্য ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা, রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের বিদেশি খোলোয়াড়দের ডরমেটরি সংস্কারে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। যার সবই করা হয়েছে মহাসচিব ইনতেখাবুল হামিদের প্রতিষ্ঠান থেকে।

তদন্ত কমিটির মতামত: তদন্ত কমিটি মতামতে উল্লেখ করেছে সংস্থাটির মহাসচিব ইনতেখাবুল হামিদ অপু ও তার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তি ফেডারেশন থেকে নানা সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও নিজেদের দায়িত্ব পালন করেননি। শীর্ষ কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় গঠনতন্ত্র মেনে কাজ না করা থেকে বিরত রাখতে কোন ভূমিকা রাখেনি। ফেডারেশনে জবাবহিহিতামূলক দক্ষ প্রশাসনিক আর্থিক ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়।

মহাসচিবের বক্তব্য : অবৈধভাবে অস্ত্র আনা ও নানা অনিয়মের বিষয়ে বিএসএসএফ মহাসচিব ইনতেখাবুল হামিদ অপুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফেডারেশনের কোন অর্থ লোপাট হয়নি। বিদেশ থেকে আনা অস্ত্র গুলির হিসাব নেই এই অভিযোগ বানোয়াট।আমি তদন্ত কমিটিকে ১০ পৃষ্টার লিখিত বক্তব্য দিয়েছি। সেটা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।

প্রতি মন্ত্রী বললেন আমি বিব্রত: জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছি। এয়ারগান থেকে একটু উন্নত কিছু অস্ত্র; যেগুলো দিয়ে মানুষ মারা যায়; এরকম কিছু অস্ত্র শ্যুটারদের লাগেজে করে নিয়ে আসার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। সেগুলো কোন ঘোষণাপত্র বা শুল্ক দেওয়া হয়নি। পরে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) থেকে বিষয়টি তদন্ত করছে এবং সেগুলোর প্রয়োজনীয় শুল্ক পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। আমি বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও অবহিত করেছি। তিনিও বিষয়টি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।’

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘শ্যুটিং ফেডারেশনের মহাচিব ইনতেখাবুল হামিদ অপু সাড়ে ৬ লাখ টাকা দামের টার্গেট চেঞ্জার কিনেন প্রায় ২৬ লাখ টাকা করে। ১০টি টার্গেট চেঞ্জার কেনা হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ সেটির বাজার মূল্য সাড়ে ৬ লাখ টাকা। শ্যুটিং ফেডারেশনের সামগ্রিক অনিয়মের বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। আমাদের তদন্ত মাঝপথে আছে। তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে আমাদেরকে ফেডারেশনের কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটির করে দিতে বলেছে।’

সভাপতির বক্তব্য : বিএসএসএফ সভাপতি নাজিম চৌধুরীর কাছ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মহাসচিব আনতেখাবুল হামিদ অপুর বিরুদ্ধে আমাদের কাছে বেনামে বেশ কিছু অভিযোগ আসে। আমরা সেটা তদন্তে একটি কমিটি গঠন কওে দেই। কমিটি তাদরে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা মহাসচিবের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছি। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নির্বাহী কমিটি সেই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি। আমরা সেটা সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়িছি। সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!