DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বিডিআর ট্রাজেডির রায়ঃ বিচারকের পর্যবেক্ষনে রোমহর্ষক নৃশংসতার বর্ননা।

আলাউদ্দিন আরিফঃ  ২০০৯ সালের ২৫-২৬শে ফেব্রুয়ারীর পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহের নামে গনহত্যার মর্মান্তিক ঘটনায় একটি সুশৃংখল বাহিনী তাদের কমান্ডিং অফিসারদের প্রতি এমন বর্বর ও অসভ্য আচরণ ইতিহাসে বিরল।

২০০৯ সালে পিলখানা ট্রাজেডির এমন বর্বর বহু ঘটনার চিত্র উঠে এসেছে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর পর্যবেক্ষণে।

আজ মঙ্গলবার সেই বর্বর পিলখানা ট্রাজেডির ১১ বছর। দিবসটি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবির পক্ষে থেকে শহীদরে কবরে পুষ্কপস্তবক অর্পণ, নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলসহ নানা কর্মসুচি হাতে নেওয়া হয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পুর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ে অপরাধের ধরণ, অপরাধ, ঘটনার ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক পেক্ষাপটসহ নানা বিষয়ে তুলে ধরা হয়। এছাড়া আদালত রায়ের ওপর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ওই রায় দেন।

রায় ঘোষণার দুই বছরের বেশি সময় পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ব্যবহারিক ও প্রয়োগিক আইনের ব্যাখ্যা পর্যালোচনাসহ ১৩৯ জনের মৃতুদ-, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- ও অপর আসামীদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী উল্লেখ করেন, বিডিআরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিভাগীয় গোয়েন্দাসহ সরকারের অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নজরে আসা সত্বেও তারা বিদ্রোহ প্রশমনে কার্যকর ও উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণে সম্পুর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে যা দু:খজনক ও চরম দায়িত্বহীনতার শামিল।

দায়িত্বপাপ্তদের উদাসীসনতার কারনে বিদ্রোহীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখ সকালে অস্ত্রগার ও ম্যাগাজিন ভেঙ্গে নিজেদের মধ্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভাগাভাগি করে নেয়। বিদ্রোহীরা সেনা অফিসারদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; মৃত দেহ থেকে পশু-পাখির চামড়ার মতো খুলে ফেলে। মৃত দেহ বেয়নেট, চাকু, ছুরি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে যখম করে করে। মৃতদেহ যাতে চেনা না যায় সেজন্য অঙ্গছেদ, শরীর থেঁতলানো, নিহত ব্যক্তির দাঁত ভেঙে ফেলার মতো গর্হিত অপরাধ ঘটায়। কোন কোন ক্ষেত্রে শরীর কেরোসিন ও পেট্রোল জাতীয় দাহ্য পদার্থ দিয়ে ঝলসে দেয়। মহিলাদের শরীরের কিছু অংশ আবৃত রেখে পুরো শরীর অনাবৃত করে রেখে দেয়। কোন কোন মৃত দেহের খুলি উড়িয়ে দেয়; যার কারনে মগজ বেরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তাদের এসবের উদ্দেশ্য ছিল যাতে কেউ মৃতদেহ সনাক্ত করতে না পারে। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া সুবেদার ইউসুফ আলী ও সুবেদার মনোরঞ্জনের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের একটি অংশ মরচুয়ারি, ট্রাক ও পিকআপে থাকা ডিজিসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ ক্রাসিং মেশিনে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। ক্রাশিং মেশিন (ইট ভাঙার মেশিন) অকেজো হয়ে পড়ায় তারা সেনা কর্মকর্তাদের লাশ পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে। তার মরচুয়ারি ও এমটি গ্যারেজের পাশে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ গণকবর দেয়। গণ কবরের ওপর ইট, কাঠ, গাছের শুকনা ডাল পাতা ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করে। পর্যবেক্ষণে আর বলা হয়েছে, তারা বিডিআরের নেতৃত্বে থাকা সকল সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

প্রেষণে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেনা কর্মকর্তাদের মেস, বাসা বাড়িতে তল্লাশীর নামে মূল্যবান সম্পদ লুটতরাজ করে। মেজর মোহাম্মদ মাকসুম-উল হাকিম জীবনের ভয়ে দরবার হলের টয়লেটের বেসিনের ভিতর পালিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে তাকে বের করে এনে গুলি করে হত্যা করে।

বিডিআর জওয়ান সেলিম রেজার নেতৃত্বে সশস্ত্র সৈনিকরা ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সরকারি বাস ভবনে হামলা করে। গার্ড কমান্ডার বাবুল মিয়া বাঁধা দিলে তাকে গুলি করে আহত করে। বাস ভবনে প্রবেশ করে ডিজির স্ত্রী নাজনীন শাকিল শিপু, গৃহকর্মী কল্পনা, জিজির অতিথি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল দেলওয়ার, তার স্ত্রী রৌশনী ফাতেমা আক্তার লাভলীকে পাশবিক নির্যাতনে হত্যা করে। তারা পুরো বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। ভবনে আসবাবপত্র ভাংচুরসহ লুটতরাজ করে। বাড়িঘর লুণ্ঠন ও সরকারি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পিলখানায় হত্যাকান্ডের ঘটনার ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ এবং কারা জড়িত তা উদঘাটন করতে সুপারিশ করেছে হাইকোর্ট।

এ জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছেন আদালত। আইনজ্ঞরা জানান, দেশের ফৌজদারি আইনের ইতিহাসে এই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা সবচে বেশি। একই সঙ্গে পৃষ্ঠা সংখ্যার দিক থেকে বড় রায় এটি। এর মধ্যে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী একাই ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন। পিলখানা ট্রাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যৃদ- বহাল (বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ- হয়েছিল ১৫২ জনের) রাখে। এছাড়া রায়ে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন সাজা (বিচারিক আদালতে ১৬১ জন) দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ ২০০ জনকে (বিচারিক আদালতে ২৫৬ জন) দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। আর হাইকোর্টের রায়ে ৪৫ জন খালাস পান। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায় হয়। পর্যবেক্ষণে বিচারপতি সিদ্দিকী বলেন, ওই ঘটনায় ইন্ধনদাতা গোষ্ঠী দুই দিনব্যাপি স্বত:স্ফুর্তভাবে বিদ্রোহীদের উৎসাহ যুগিয়েছে।

 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে এরা কারা? পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সরকার চলমান থাকলে এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে কারা বা কোন গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হতো? তাহলে কি সরকার পতনে যাদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তারাই এরূপ ভয়াভহ ঘটনার পিছনে ছিল? গবেষনা ও বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিডিআর বিদ্রোহে সরকারের পতন হলে একটি স্বার্থন্বেষী মহলের লাভবান হওয়ার বিষয়টিই স্পষ্টভাবে সর্বাগ্রে দৃশ্যপটে চলে আসে। বিচারপতি পিলখানা ট্রাজেডির আটটি মূল লক্ষ্য থাকার বিষয় উল্লেখ করেন।

সেহগুলো হেচ্ছ সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যেকোনো মূল্যে দাবি আদায় করা, বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এই সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা। প্রয়োজনে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিডিআরে প্রেষণে কাজ করতে নিরুসাহিত করা, সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪৮ দিনের নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে অস্থিতিশীলতার মধ্যে দেশকে নিপতিত করা, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিডিআরের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় দেশের অন্যান্য বাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত করা। বিডিআর আইনে অপরাধের তুলনায় দোষীদের নগণ্য শাস্তির বিধান থাকায় আইন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন-২০১০ পাশ হয় এবং ওই বছর ২১ ডিসেম্বর বিলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেন। এরপরই বিডিআরের নাম হয় বিজিবি। এছাড়া একই ঘটনায় বিষ্ফোরক আইনের মামলাটি বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

প্রতিবেদকঃ দৈনিক দেশ রুপান্তরের সিনিয়র সাংবাদিক।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!