DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বাংলাদেশের গভীর সংকটের সমাধান আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাতেই করতে হবেঃ ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন।

 

ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনঃ স্বাধীন দেশে যদি প্রশাসন জনগণের না হয়, তাহলে দেশ তো পরাধীন আমলের মতোই থেকে যায়। জনজীবনের গভীরে অন্যায়-অবিচার বাসা বাঁধার মূল কারণ আমাদের প্রশাসনে স্বাধীনতার মূল্যবোধের অভাব। দেশ ও জাতির ক্ষতি সাধনে আমরা নিজেরাই অনেক সময় নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে থাকি।

দুর্নীতির সুযোগ বহাল রাখার জন্যই ভোট ডাকাতির ব্যাপারে প্রশাসনের সব স্তরের সহযোগিতা পাওয়া সহজ হয়েছে। জনগণকে তাদের পছন্দমতো সরকার গঠনের শাসনতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। সরকারকে বিভ্রান্ত করার জন্যও লোকের কোনো অভাব নেই।

প্রকাশ্যে নির্বাচনে ডাকাতির পর স্বাধীন জাতি হিসেবে অহঙ্কার করার মতো আমাদের আর কতটা কী অবশিষ্ট আছে তাই নিয়ে ভাবছি। আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে- জাতীয়ভাবে, দলীয়ভাবে নয়। নির্বাচনে কোনো দলেরই জয়-পরাজয় হয়নি।

জাতির অসহায়ত্বকেই দেখানো হয়েছে বিশ্বের কাছে। এভাবে ভোটাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে শুধু জনগণের শাসনতান্ত্রিক মৌলিক অধিকারই হরণ করা হয়নি। জনগণ কিছু নয়। তাদের ভোটও কিছু নয়। এর নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়।

৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়লাভ করা সমকালীন পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে প্রায় অচিন্তনীয়। আর অতিলোভীদের দোষ এটাই। কতটা হজম করা যাবে সেটাই বুঝতে চায় না। ভোট ডাকাতির সাক্ষ্য-প্রমাণ তারা নিজেরাই রেখে দিয়েছে।

পুলিশি মামলা দিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে বিচারব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে ফেলা হয়েছে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতাটিও কম লজ্জাকর নয়। এটি সত্য যে, টেলিভিশন টকশোতে আমি বহুবার নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক শক্ত কথা বলেছি। এজন্য অনেকেই বলেছেন, আপনি বিপদে পড়বেন।

আমি তো সংঘাত-সংঘর্ষের বিরুদ্ধে বলেছি। যুক্তির বাইরে কিছু বলিনি। কোনো দলের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য রাখিনি। দেখা গেল নির্বাচনের আগে আমাকে জেলে পাঠানো হল একটি খোঁড়া অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে।

যে পরিপ্রেক্ষিতেই হোক, আর প্রশ্নটি যতই অশোভন হোক, ৭১ টিভির টকশোতে যে মহিলাটিকে আমি চরিত্রহীন বলতে চেয়েছি তাতে তার মানহানি হলে তিনি মামলা করতে পারেন। তিনি কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেননি।

শব্দটির ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে মনে করে পরদিন ফোন করে আমি তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করি। ৭১ টেলিভিশনকেও আমি লিখিতভাবে জানিয়েছি। তারা আমার চিঠির বিষয়বস্তু সম্প্রচারও করেছে। তারপর প্রকাশ্যে আর কী করার থাকতে পারে?

আশ্চর্য হলাম যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই এক প্রেস কনফারেন্সে সবাইকে বললেন আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে। তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, তিনি তাদের সঙ্গে আছেন। মহিলাটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কী সম্পর্ক বুঝতে পারলাম না।

সাধারণ মানহানির বিষয়টি এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার হয়ে গেল! মানহানির মামলা যে তৃতীয় পক্ষের কেউ করতে পারে না তা-ও চিন্তা করতে হয়নি। হবেই বা কেন? আইনকানুন তো নেই। আসলে সমগ্র বিষয়টি ছিল সাজানো। সরকারি আইনজীবীদেরও তো আমার জামিনে বাধা দেয়ার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না।

‘পবিত্র চরিত্রের’ অধিকারী আওয়ামী লীগের কিছু অতিউৎসাহী সমর্থকও নেমে পড়লেন এ অভিযোগ নিয়ে যে, মহিলাটিকে চরিত্রহীন বলে আমি সমগ্র নারী জাতির অবমাননা করেছি। তাদের দাবি, আমাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। সরকারের কাছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করতেও বিশেষ উৎসাহ দেখা গেছে। বি

ষয়টির ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা বুঝে ওঠার আগেই সন্ধ্যায় ডিবির লোকজন তৃতীয় পক্ষের এক মানহানির মামলায় আমাকে গ্রেফতার করে। সরকারের ডিটেকটিভ শাখার ব্যস্ততা দেখানোরই বা যুক্তি কোথায়? আমার নিরাপত্তা নিয়ে একদল পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে দেখলাম।

তাদের ধারণা আওয়ামী লীগ ‘কর্মীরা’ আমাকে আক্রমণ করতে পারে! রংপুরে কোর্ট চত্বরে তা-ই হল। এ হল আমাদের দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কর্মী!

আওয়ামী লীগের মহিলা কর্মীরা উপরের নির্দেশমতে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয় না, তবুও একটি-দুটি নয়, ২২টি মানহানির মামলা করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলে বিচারব্যবস্থায় নিশ্চয়ই এরকম মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করতে দিত না।

আশার কথা যে, দু-একজন ম্যাজিস্ট্রেট এ ধরনের মামলা গ্রহণ না করার সাহস দেখিয়েছেন। মামলা হয় না, তবুও মামলা দেয়া হল, মামলা নেয়াও হল এবং আইনত জামিনযোগ্য মামলা হলেও জামিন হল না। আমাকে তাই তিন মাসেরও বেশি জেলে থাকতে হল।

মোটকথা, নির্বাচনের সময় আমাকে বাইরে থাকতে দেয়া হবে না। সবার জানা আছে, আমি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছি। দলীয় রাজনীতি করি না বলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। তবে আমি ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে ছিলাম।

আমার বিরুদ্ধে শুধু মামলা করার নির্দেশই দেয়া হয়নি। শুনেছি, আমার যাতে ‘অসুবিধা’ হয় সেই নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। সুযোগ পেয়ে অন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন মহিলা সাংবাদিক আমাকে চরিত্রহীন রাজনীতিবিদ বলে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধাবোধ করলেন না।

ভালো কথা, তাহলে তাদের যুক্তিতে নিশ্চয়ই তিনি সব রাজনীতিবিদকে চরিত্রহীন বলেছেন। তাতে কিন্তু কোনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদের মানহানি হয়নি! প্রধানমন্ত্রী মানহানির কোনো মামলাও করতে বলেননি!

আমার কোনো দল নেই। তাই সরকারদলীয় মামলা-হামলার মোকাবেলায় বিশেষভাবে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা অন্য আইনজীবীদের সঙ্গে মিলে আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দেশে-বিদেশে অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন। আমি তাদের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।

যাই হোক, অসুবিধা সৃষ্টির ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে আমাকে জেলে নিয়ে দু’দিন সাধারণ আসামিদের সঙ্গে রাখা হল। আমাকে ডিভিশন দেয়া হল না। কিন্তু আসামিদের মধ্যে যে সুন্দর মন ও মানবিক গুণাবলীর পরিচয় পেলাম তাতে মুগ্ধ ও অবাক হয়েছি।

কীভাবে আমার থাকাটা কিছুটা হলেও সহনীয় করা যায় তার জন্য তারা অস্থির হয়ে পড়লেন। জেলের বিভিন্ন স্থান থেকে আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কিছুটা উঁচুমানের খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী আনা হতে থাকল।

অর্থাৎ জেলের অনেকেই জানতে ও বুঝতে পারেন আমাকে অসুবিধায় রাখা হয়েছে। যারা সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, তাদের কাউকেই আমি চিনতাম না। তাদের ব্যবহারে আমার কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়।

যারা জেলে আছে তাদের বেশিরভাগই সত্যিকার কোনো ভয়াবহ মামলার আসামি নয়। দেখেই বোঝা গেছে তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতির গন্ধ খোঁজা হয়েছে, না হয় ড্রাগস সম্পর্কিত মামলা হয়েছে। আসলে চাইলেই মামলা করা যায়। অপরাধ তো প্রমাণ করার দায় নেই। বিচার ত্বরান্বিত করার কোনো আগ্রহও নেই।

জামিন না দিয়েই জেলে আটক রাখা যাচ্ছে মাসের পর মাস। এসব আসামির অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্ব দেখে আমিও কষ্ট কম অনুভব করিনি। অনেকের কোর্ট-আদালতে ছোটাছুটি করার কোনো লোকও নেই। এমনও কিছু আসামি আছে যাদের আত্মীয়স্বজনরা কেউ জানে না তারা কোথায় আছে।

শাসনতন্ত্রে বলা আছে, একজন আসামি আইনজীবীর সাহায্য নিতে পারবে। কিন্তু একবার জেলে ঢোকাতে পারলে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগই দেয়া হয় না। কোনো আইনজীবী যোগাযোগ করলে তবেই সে তার সাহায্য নিতে পারে। শাসনতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্পর্কে পুলিশ ও জেল কর্তৃপক্ষকে অধিকতর সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু করবে কারা? রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো নেই।

বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছে, জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি যেন তাদের আইনগত সাহায্য করি। কতটুকু তাদের জন্য করতে পারব জানি না। জেলে পুরলেই সমস্যার সমাধান হয় না। যারা অন্যায়কারী তাদের শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু বিনা জামিনে, বিনা বিচারে পুলিশ দিয়ে জেলে পাঠানোর রাজনীতি তো নির্যাতন। পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার। এ

কটি সুন্দর দেশ গড়তে উদার মনের নেতৃত্ব ও সুন্দর মনের মানুষের প্রয়োজন। আমি আশান্বিত হলাম এটা দেখে যে, তরুণদের মধ্যে এখনও সুন্দর মন মরে যায়নি। জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও যথেষ্ট সম্মান ও সহযোগিতা পেয়েছি। নিজের দেশে এটাই তো আশা করি। যারা মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য তাদের অবশ্যই মর্যাদা দিতে হবে।

আমার এ লেখাটির মূল লক্ষ্য একটি সাধারণ মানহানির মামলা নিয়ে আমার প্রতি যে নোংরা আচরণ করা হয়েছে সেটা নয়। দেশব্যাপী রাজনীতিতে পুলিশি মামলার যে ছড়াছড়ি, তার বিপজ্জনক দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

জনগণের ওপর মামলা-হামলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা পুলিশের দায়িত্ব নয়। ফরমায়েশি পুলিশি মামলার ভয়ে সারা দেশের মানুষ ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে আছে। পুলিশ তো হবে জনগণের বন্ধু। রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদরা।

পুলিশে এখন অনেক ভদ্র, শিক্ষিত লোক যোগ দিয়েছে। তাদের দিয়ে রাজনীতি করাতে গিয়ে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অর্থাৎ একটি যোগ্য, সৎ পুলিশ বাহিনী যে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য সে প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে না।

কমপক্ষে জেলের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বন্দি রাজনৈতিক মামলার শিকার। একেকজনের বিরুদ্ধে ২৫-৩০টি করে মামলা দেয়া হয়েছে। মামলার সত্যতা কোনো বিষয় নয়, জামিনে মুক্তি পাওয়াকে অসম্ভব করতে পারলেই হল।

গুরুতর মামলা হলে তো একটিই যথেষ্ট। এসব বিষয় নিয়ে ভাববার লোক দুর্লভ। কারাগারগুলোতে ঠাঁই নেই। অথচ বেশিরভাগ বন্দিকে ছেড়ে দেয়ার, জামিন দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের প্রতি চরম অন্যায় করা হচ্ছে।

অবশেষে হাইকোর্টের নির্দেশে আমাকে ডিভিশন দেয়া হল। আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল হোসেনের ল’চেম্বারে আমি তার জুনিয়র ছিলাম। তিনি কোর্টে আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘মানিক মিয়ার ছেলেকে জেলে ডিভিশন পেতে হাইকোর্টে আসতে হয়!’

মানিক মিয়ার ছেলে ছাড়া আমার নিজেরও তো কিছু অর্জন আছে। আমি বঙ্গবন্ধুর সময় সংসদ সদস্য ছিলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ছিলাম। নিজে একজন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী।

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলাম। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছি। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রেস কমিশনের রিপোর্ট তৈরিতে আমি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলাম।

স্বাধীন দেশে মানুষের সাহস জোগায় বিচারব্যবস্থা। এজন্য জনগণ শাসনতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে বিচার বিভাগের ওপর। এর অর্থ জনগণের অধিকার ও শাসনতন্ত্রসম্মত শাসনের ব্যাপারে জনগণ রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা না রেখে আস্থা রেখেছে বিচার বিভাগের ওপর।

বিচার প্রক্রিয়ায় ভয়ভীতির স্থান থাকতে পারে না। মানুষের অধিকার নিশ্চিত না হলে স্বাধীনতা অর্থহীন। বর্তমানে মানুষ তাই বড় অসহায়। জামিনের আবেদনের ভিড়ে সুপ্রিমকোর্টে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সুপ্রিমকোর্ট এখন জামিনের আবেদন নিয়ে মহাব্যস্ত। সুপ্রিমকোর্টের অস্তিত্ব ও সাহস না থাকলে দেশের বিচারব্যবস্থা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ত।

আমরা নিশ্চয়ই একটি সুস্থ, সভ্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালানোর যোগ্যতা রাখি। সেই শিক্ষাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আমাদের শিখিয়ে গেছেন।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বাঙালিদের উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বেই তদানীন্তন পাকিস্তানে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মানিক মিয়াসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই তখন জাতি গঠনে নীতি-আদর্শ ও সততার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মুখেই শুনতে হয়েছে, তারা কল্পনাও করতে পারেননি যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এত নির্লজ্জভাবে ভোট ডাকাতি হবে। তারা ছোটাছুটি করতে থাকলেন সাক্ষীগোপাল নির্বাচন কমিশন অফিসে।

এমনকি তারা জনগণের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ রক্ষা করেননি। ভেবেছিলেন জনগণ তো সরকারের বিপক্ষে, তাই জনগণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীকেই ভোট দেবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপির মতো একটি বড় দল রাজনৈতিক দল হতে পারছে না। শুধু নির্বাচনের আশায় ব্যস্ত থাকার কারণে। এখন তো নির্বাচনও গেল।

দীর্ঘদিনের সংগ্রাম শেষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ অবস্থায় বৈরুত থেকে আব্বার কাছে লেখা এক পত্রে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন, আমরা যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য লড়াই করছি তারা ব্যর্থ থেকে গেলাম।

পরবর্তী সময়ে যে রাজনীতি দেখা দেবে তা হবে ভয়াবহ নৈরাজ্যিক চরিত্রের। শহীদ সাহেব এ বক্তব্য যখন রাখেন তখন দেশে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। পরবর্তী সময়ে কী ধরনের ভয়াবহ হিংসা-বিদ্বেষ দেশে চলেছে তা তো সবাই দেখেছি।

মনে হচ্ছে ১৮ কোটি লোকের এ দেশে এত শিক্ষিত, যোগ্য ও সৎ লোক থাকা সত্ত্বেও আমরা দেখাতে পারছি না যে, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের কোনো গঠনমূলক ভূমিকা আছে বা আমরা জাতির কোনো উপকারে আসছি।

আপস ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে সচেষ্ট ছিলাম। কোনো সমঝোতা নয়, আমলা সাহেবদের ভোট ডাকাতির ষড়যন্ত্রই সহজ পথ মনে করা হল। এ হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই আমাদের মতো কিছু লোককে হয়তো বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। বোবা হয়ে থাকাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।

নির্বাচনে কারচুপি এত বিশালভাবে হয়েছে যে, সংশ্লিষ্টরাই তার প্রমাণ রেখে গেছে। আমলাদের বুদ্ধিতে এটা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু তারা সমাধান দিতে পারবে না। ভোট কারচুপি হয়েছে জাতির বিরুদ্ধে।

তাই সংকটের সমাধানও হতে হবে জাতীয়ভাবে, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়। ভোটাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা সর্বজনীন মানবাধিকার লঙ্ঘন। কোনো স্বাধীন জাতি ভোটাধিকারহীন হয়ে থাকতে পারে না। আমরাও থাকব না। পুলিশি মামলা-হামলার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। জনগণের ভোটের শাসনতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাই নিরাপদ, সহনশীল রাজনীতির পথ।

লেখকঃ প্রখ্যাত আইনজীবি,তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেস্টা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!