DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

শেয়ার বাজারে আবার অশনী সংকেতঃ ১০ টাকার শেয়ারের মূল্য বেড়ে ৪২১০

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃমাত্র ১০ টাকার শেয়ারের বাজারদর ছাড়িয়েছে চার হাজার টাকা। কথাটি শুনতে বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই সত্য। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মুন্নু জুট স্টাফলার্স এই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছে।

কোম্পানিটির শেয়ারের এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্তে নেমেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না, শেয়ারের দাম বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেন শেষে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২১০ টাকায়।

এক কোটি টাকারও কম পরিশোধিত মূলধনের এই কোম্পানির শেয়ারের দাম সাড়ে তিন মাস ধরে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের ২৯ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৭৮৭ টাকা। সেখান থেকে টানা বেড়ে চার হাজার ২১০ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে তিন হাজার ৪২৩ টাকা বা ৪৩৫ শতাংশ।

অন্যভাবে বলা যায়, সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে মুন্নু জুট স্টাফলার্সের শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৫ গুণ। অর্থাৎ একজন বিনিয়োগকারী ২৯ মার্চ কোম্পানিটির ১০ লাখ টাকার শেয়ার কিনে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ধরে রাখলে সাড়ে তিন মাসেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। সেই হিসাবে ১০ লাখ টাকা সাড়ে তিন মাস খাটিয়ে লাভ পাওয়া গেছে ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

কোম্পানিটির শেয়ারের এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে গত সাড়ে তিন মাসে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে কোম্পানিটিকে একাধিকবার নোটিশ পাঠানো হয়েছে। আর বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে চারবার সতর্কবার্তা প্রকাশ করেছে ডিএসই।

ডিএসই থেকে মুন্নু জুট স্টাফলার্সকে যতবার নোটিশ দেয়া হয়েছে ততবারই কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, তাদের কাছে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। কিন্তু ডিএসইর নোটিশের উত্তর দেয়ার কিছুদিন পরই কোম্পানিটি দু’টি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করেছে।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুন্নু জুটের শেয়ারের দাম যেভাবে বেড়েছে এবং কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ যেভাবে পরপর দু’টি বড় মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে এখানে ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে। এ ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের পেছনে এক শ্রেণির অসাধু বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কোম্পানির কর্মকর্তারা জড়িত আছেন।

ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, মুন্নু জুট স্টাফলার্স যে মানের কোম্পানি, তাতে এর একটি শেয়ারের দাম কিছুতেই এক হাজার টাকা অতিক্রম করতে পারে না। অথচ বর্তমান বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম চার হাজার টাকার ওপরে। এটা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। এর পেছনে নিশ্চয়ই এক শ্রেণির অসাধু চক্র আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মুন্নু জুটের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে ৩ এপ্রিল ডিএসই থেকে নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশের জবাবে ৪ এপ্রিল কোম্পানিটি ডিএসইকে জানায়, শেয়ারের দাম বাড়ার জন্য তাদের কাছে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

 

তবে দুই সপ্তাহের পরই কোম্পানিটি বোর্ড সভায় ঘোষণা দেয় এবং বোর্ড সভা শেষে ৩ মে কোম্পানিটি ডিএসইর মাধ্যমে তৃতীয় প্রান্তিকের (২০১৮ সালের জানুয়ারি-মার্চ) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় বড় ধরনের উলম্ফন হয়েছে।

ওই আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পালে আরও হাওয়া লাগে। অস্বাভাবিক হারে ছুটতে থাকে মুন্নু জুট। ফলে মে মাসের মাঝামাঝি সময় আবারও ডিএসই থেকে কোম্পানিটিকে নোটিশ পাঠানো হয়। আগের মতো এবারও কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কাছে অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদশীল তথ্য নেই। সেই তথ্যের ভিত্তিতে ১৭ মে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে তথ্য প্রকাশ করে ডিএসই।

কিন্তু তাতেও কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। এরপর জুনের ৩ তারিখে আবার নোটিশ পাঠায় ডিএসই। আগের মতো মুন্নু জুট আবারও জানায়, অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে তাদের কাছে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদশীল তথ্য নেই। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ৪ ও ৭ জুন বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে তথ্য প্রকাশ করে ডিএসই।

অবশ্য ২০ জুন ডিএসইর মাধ্যমে বড় ধরনের মূল্য সংবেদশীল তথ্য প্রকাশ করে মুন্নু জুট। কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ জানায়, মুন্নু জুটের অনুমোদিত মূলধন এক কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা করা হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান এ প্রসঙ্গে   বলন, ‘১০ টাকার একটি শেয়ারের দাম চার হাজার টাকা- এটি কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। তাও আবার এমন একটি কোম্পানির যার চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে মুনাফা হয়েছে মাত্র ১৩ লাখ টাকা।’

তিনি আরও বলন, ‘এটা স্পষ্ট যে, মুন্নু জুট স্টাফলার্সের শেয়ারের ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে। এর সঙ্গে কোম্পানির এক শ্রেণির কর্মকর্তারা জড়িত। যারা আগেই কোনো বিশেষ চক্রের কাছে তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির উচিত দ্রুত এমন দাম বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখে এর সঙ্গে করা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’

৪৬ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের প্রতিষ্ঠান মুন্নু জুট স্টাফলার্সের শেয়ারের সংখ্যা চার লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে ৫৫ দশমিক ৯০ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ৩৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং বিদেশিদের কাছে আছে দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ শেয়ার।

কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে (২০১৭ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত) ব্যবসা পরিচালনা করে মুনাফা হয়েছে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ফলে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে মুনাফা দাঁড়িয়েছে দুই টাকা ৯৫ পয়সা।

১৯৮২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মুন্নু জুটের লভ্যাংশের বিষয়ে ডিএসই মাত্র দু’টি বছরের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। ফলে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে শেয়ারহোল্ডাররা এক টাকা করে লভ্যাংশ পায়। পরের বছর ২০১৭ সালে লভ্যাংশ হিসাবে দেয়া হয় ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার।

যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান  বলেন, ‘মুন্নু জুট স্টাফলার্সের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

মুন্নু জুট স্টাফলার্সের পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ ফয়েজ মাহফুজ উল্লাহ  বলেন, ‘বর্তমানে শেয়ারের যে দাম তা মার্কেটের ব্যাপার। এটি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, এটা আমরা বলতে পারব না। তবে এটা বলতে পারি যে, আমরা গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে নাজুক অবস্থায় ছিলাম অনেক দিন। এজন্য আমাদের অনেক কল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন আমরা গ্যাসও পাচ্ছি, এলপিজিও পাচ্ছি। সবমিলিয়ে আমরা আমাদের গ্রুপটাকে টার্ন করে নিচ্ছি।’

ডিএসইর নোটিশের জবাবে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই জানানো হলেও কিছুদিন পরই বড় ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ব্যবসায়িক টেকনিক। আমি ব্যবসা করব অবশ্যই আমার টেকনিক অ্যাপলাই করে। মার্কেটে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া কোনো ব্যবসা নেই। ব্যবসায় যে টেকনিক আমরা অ্যাপলাই করব সেটি গোপনীয় বিষয়। যেটুকু জানানো দরকার আমি সেটুকুই জানাব, যা জানানোর দরকার নেই সেটা তো জানাব না।’

কোম্পানি থেকে মূল্য সংবেদশীল তথ্য আগেই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যতদূর গোপন রাখা যায় চেষ্টা করি। আমার অজান্তে যদি কিছু হয়, সেটা তো আমি ট্যাকেল দিতে পারব না।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!