DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

হলি আর্টিজানে হামলা করে আইএস,এক্ষেত্রে অসত্য তথ্য দেয় হাসিনা সরকারঃইন্টারপোল।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়েছিল আইএস, দেশীয় জঙ্গিরা নয়। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হামলাকারীদের প্রসঙ্গে অসত্য তথ্য দিয়েছেন।


ঢাকায় পুলিশ প্রধানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে জঙ্গিবাদ নিয়ে এক উপস্থাপনায় এসব কথা বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের (আইসিপিভিটিআর) পরিচালক রোহান গুণারত্নে।


গতকাল রোববার সকাল থেকে তিন দিনের এ সম্মেলন শুরু হয়েছে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে।

বাংলাদেশ পুলিশ ও পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল যৌথভাবে সম্মেলনটির আয়োজন করেছে।

এতে ১৪টি দেশের পুলিশের প্রতিনিধিরা ছাড়াও ফেসবুক, ইন্টারপোল গ্লোবাল কমপ্লেক্স ফর ইনোভেশন (আইজিসিআই), যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), আসিয়ানাপোল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ট্রেনিং অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামসহ (আইসিআইটিএপি) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিচ্ছেন।


সম্মেলনে ‘ডিরেডিকালাইজেশন অব মিলিট্যান্টস: অ্যান অ্যাপ্রোচ ফর ডিজএনগেজমেন্ট অ্যান্ড রিইন্টিগ্রেশন ইনটু সোসাইটি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ রোহান গুণারত্নে।

তাঁর প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরভিত্তিক আইসিপিভিটিআর গত বছরের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনা ও পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। হামলাকারীদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগের বিষয়টিও তখনই নজরে আসে বলে জানান রোহান।

রোহান গুণারত্নে বলেন, সন্ত্রাস দমনে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলিষ্ঠভাবে সেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটেছে। তবে হলি আর্টিজানে হামলা কারা করেছিল, তা নিয়ে তাঁর ভিন্নমত আছে।

তিনি বলেন, ‘হলি আর্টিজানে যারা হামলা চালিয়েছিল, তারা জেএমবি কিংবা স্থানীয় জঙ্গী নয়, তারা আইএস। এটি সেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, যারা নিজেদের ইসলামিক স্টেট বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ওই হামলা সম্পর্কে সত্য বলেননি।’


রোহান তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে বলেন, বাংলাদেশে আইএসের উত্থান হয়েছে জেএমবি থেকেই। কিন্তু জঙ্গিগোষ্ঠীটি আর নিজেদের জেএমবি বলছে না। গোষ্ঠীটি নিজেদের আইএস বলছে এবং সিরিয়া ও ইরাকের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের প্রভাবিত করেছে।

আইএস তাদের প্রকাশনা ‘দাবিক’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত হামলাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই হামলাকারী দলটিকে জেএমবি বলা এবং তাদের ‘হোম গ্রোন’ বা দেশীয় বলা ভুল।

যে গোষ্ঠীটি হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়েছে, তারাই ইতালি ও জাপানের নাগরিককে হত্যা করেছে। এই মতাদর্শের সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। এই মতাদর্শ বিদেশি। তারা হলি আর্টিজানে হামলার ধরন দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়েছে।


সিঙ্গাপুরভিত্তিক এই গবেষণা কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ হলো হলি আর্টিজানে হামলার তিনটি পর্ব ছিল। প্রথম পর্বে কিছু মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়, ঠিক যেভাবে পশুদের গাদাগাদি করে রাখা হয়। তারপর তাদের জবাই করা হয়। জিম্মিদশা শুরুর ১৫ মিনিটের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে যায়।

দ্বিতীয় পর্যায় ছিল প্রচারণার। এ সময় হামলাকারীরা এ দেশে যারা আইএসের সদস্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও হত্যাকাণ্ডের ছবি পাঠায়।

তৃতীয় পর্ব ছিল ‘শোডাউন’ পর্ব।


রোহান গুণারত্নের বক্তব্যের পরপরই গণমাধ্যমে পাঠানো পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হলি আর্টিজানে আইএস হামলা চালিয়েছে বলে রোহান গুণারত্নে যে মন্তব্য করেছেন, তা তাঁর নিজস্ব মত।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশের বক্তব্য হলো, হামলা চালিয়েছিল নব্য জেএমবির সদস্যরা। তারা ‘হোম গ্রোন’।


গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারি এবং ও’কিচেন রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা হয়। জঙ্গিরা ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গেলে জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর এক পাচক নিহত হন। হামলার রাতেই অনলাইনে নৃশংসতার ছবি প্রকাশ করে ঘটনার দায় স্বীকার করে আইএস। যদিও বাংলাদেশ সরকার তা নাকচ করে দেয়।


তবে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১২ জুন পর্যন্ত পুলিশ বেশ কয়েকজনকে আইএস-সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে এবং তদন্ত শেষে মামলার অভিযোগপত্রও দেয় আদালতে। ২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যার পর প্রথম আইএসের নামে দায় স্বীকারের খবর বের হয়।

তখন থেকেই সরকার ও পুলিশ এই দাবি নাকচ করে আসছে। বাংলাদেশ সরকার বলছে, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই, দেশীয় জঙ্গি সংগঠন ‘নব্য জেএমবি’।


গতকাল পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে রোহান গুণারত্নে বলেন, ‘আইএসের জঙ্গিদের মতো বাংলাদেশের জঙ্গিরাও পাঁচটি জিনিসে বিশ্বাস করে। তারা যদি হামলার সময় মারা যায় তাহলে তারা সরাসরি বেহেশতে যেতে পারবে, আল্লাহকে দেখতে পাবে, তাদের সমস্ত পাপ ধুয়েমুছে যাবে, তারা ৭০ জন আত্মীয়কে বেহেশতে নিতে পারবে এবং ৭০ জন সুন্দরী নারী পাবে বলে বিশ্বাস করে।’


জঙ্গিবাদের সমস্যা মোকাবিলা করতে সমস্যার মূলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সমস্যার মূলে যেতে হবে। উটপাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে থাকার কোনো মানে হয় না।
কমান্ডোর জন্য অপেক্ষা করা ছিল ভুলঃ
রোহান গুণারত্নে মনে করেন, হলি আর্টিজানে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে ১২ ঘণ্টা সময় নেওয়া ছিল ভুল।

তিনি বলেন, সাধারণ অপরাধী ও জঙ্গিদের দমনের পদ্ধতি আলাদা। একজন জঙ্গি তার গল্প বলতে চায়। কোন বিশ্বাস থেকে সে এ পথে এসেছে, তা-ও বলতে চায়। একজন সাধারণ অপরাধীকে যখন পুলিশ ধরার চেষ্টা করে, তখন সে পালানোর চেষ্টা করে। কারণ সে বাঁচতে চায়। কিন্তু একজন জঙ্গি বাঁচতে চায় না। জঙ্গিবাদ হলো আদর্শিক চরমপন্থার সহিংস প্রকাশ। ঢাকায় হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের উপস্থিতি বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের অভিযান চালানো প্রয়োজন ছিল।


রোহান বলেন, এখনকার দিনের জঙ্গিদের কাজের ধরন আগেকার চেয়ে আলাদা। আগে জঙ্গিরা জিম্মি করত, তারপর দাবিদাওয়া আদায় করত। হলি আর্টিজানের জঙ্গিরা কি সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কোনো দাবি জানিয়েছিল? তাহলে কেন কমান্ডো বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করা হলো? এটা ছিল ভুল কৌশল।


পুনর্বাসনে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশঃ
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ দমনে ভালো করলেও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে বলে মনে করেন রোহান গুণারত্নে।

তিনি বলেন, কারাগারগুলোতে ডির্যােডিকালাইজেশন বা জঙ্গি মতাদর্শ থেকে ফিরিয়ে আনার কাজটি করতে হবে। প্রথমে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো যাঁরা, তাঁদের যুক্ত করতে হবে। পুলিশের মধ্যেও অনেকে আছেন, যাঁরা ধর্ম সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখেন। তাঁদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সবচেয়ে বড় ১০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তাদের কর্মমুখী শিক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। তাদের এদেশীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। নইলে কারাগার থেকে ফিরে এই জঙ্গিরা নতুন করে আরও জঙ্গি তৈরি করবে।


মাদ্রাসাশিক্ষার দিকে নজর দেওয়ার কথাও বলেন রোহান। তাঁর পরামর্শ হলো, যারা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে, তাদের জাতীয় জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া যায়। তারা দেখুক বাংলাদেশের সংস্কৃতি কত সমৃদ্ধ।


বাহিনীগুলোর মধ্যে সহযোগিতার যে সম্পর্ক, তা জঙ্গিবাদ দমনে যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন রোহান গুণারত্নে। অসংগতির জায়গাগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পুলিশ জঙ্গিদের জন্য আলাদা তথ্যভান্ডার গড়েছে, ডিজিএফআই (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) আলাদা আলাদা তথ্যভান্ডার। সবার জন্য অভিন্ন তথ্যভান্ডার থাকা দরকার এবং সব বাহিনী যেন সেই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশিক্ষণ নিতে হবে একসঙ্গে এবং প্রেষণে এক বিভাগের কর্মকর্তাদের অন্য বিভাগে চাকরির ব্যবস্থা থাকা জরুরি।


উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের অবস্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ তার ব্যাখ্যায় মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের হামলার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হলো অমুসলিম জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দুটি দেশ ভারত ও মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী প্রধানত অমুসলিম। এ ছাড়া আইএস-অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে যারা ফিরে আসবে, তারাও এখানে নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!