DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

জনগনের ম্যান্ডেটহীন এই সরকার কি ক্রমেই রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছে?

image_90308_0দৈনিক প্রথম বাংলাদেশঃ  জনগণের দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের আইন মেনে চলা, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা তেমনি রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা। শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়াও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যখন প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে তখন জননিরাপত্তা নিয়ে আর রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না। ফলে নাগরিকরাও পড়ে অসহায় অবস্থায়। দেশে বর্তমানে সেরকমই একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।জনগনের ম্যান্ডেট বিহীন এই সরকারের যেনো জনগনের প্রতি কোন দায় দ্বায়ীত্বই নেই,তাদের সমস্ত দায়বদ্ধতা হচ্ছে তাদের অবৈধভাবে ক্ষমতারোহনের সহায়ক শক্তি সমূহের প্রতি।



গুম, অপহরণ, খুন ও বিচারবহির্ভুত হত্যা আওয়ামী লীগের ২য় শাসনামল থেকেই  চলে আসছে। দেশে-বিদেশে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং ব্যক্তি বা বিশেষ কর্তৃপক্ষের প্রভাবে অপরাধিরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। কোনো ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে সাত অপহরণ ও খুনের ঘটনার পর এই দিকগুলো নতুন করে সামনে আসছে।



বিশিষ্টজনরা বলছে, আমাদের প্রজাতন্ত্রে নাগরিকের জানমালের নিশ্চয়তা দিয়েছে সংবিধান। সংবিধানে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অংশে নাগরিকদের এ ধরনের অধিকারগুলো ভোগ করার যেমন নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, তেমনি আইন অনুযায়ী অপরাধীদের বিচারের দায়িত্বও নিয়েছে রাষ্ট্র। আবার কোন ঘটনায় কে দোষী বা নির্দোষ কিংবা সে দণ্ডিত হবে না অব্যাহতি পাবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব রাষ্ট্র দিয়েছে আদালতকে।



আদালতের সহায়ক সংগঠন হিসেবে কাজ করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু প্রচলিত এই ব্যবস্থার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে কাউকে দণ্ডিত করা যেমন: আটক রাখা, হত্যা কিংবা অন্য যে কোনো সাজা দেয়ার দায়িত্ব কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা সংস্থা নিতে পারে না। আর যদি নিয়ে থাকে তখনই রাষ্ট্রশক্তির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আসে।



কোনো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আইন দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করলে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। অপর কেউ তা করলে বা করতে থাকলে তা রাষ্ট্রশক্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।



তিনি তার ‘গুম ও অপহরণ: নাগরিক উদ্বেগ ও করণীয়’ শীর্ষক এক নিবন্ধে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন, বাংলাদেশে এখন গুম ও অপহরণ এক সর্বনাশা মাত্রা লাভ করেছে। শুধুমাত্র এ বছরের প্রথম চার মাসে অপহরণ হয়েছে ৫৩ জন। যারা এ ধরনের গুম, অপহরণের সাথে জড়িত তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আর নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অপরাধ শনাক্তকরণে প্রধান বাধা বলে ধারণা করা হয়।



অভিযোগ রয়েছে আইনপ্রযোগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা এ ধরনের ঘটনার জন্যে প্রধানত দায়ী। ক্ষেত্র বিশেষে এসব ঘটনার সঙ্গে তাদের মধ্যে কারো সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ রয়েছে। মনে করা হয়, এমনই ঘটেছে আবু বকর সিদ্দিক (বেলার নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানার স্বামী) ও পহেলা মে নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত অপর একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বোধ্য নিষ্ক্রিয়তার শিকার সে শহরেরই সাত জন মানুষ- এমনটা বললে ভুল হবে না। এমন নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আইন মেনে না চলার প্রবণতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।



দেশে প্রচলিত দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি ও আইনের শাসনের অভাবেই প্রতিনিয়ত অপহরণ, খুন ও গুমের মতো ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ)।



বাংলাদেশে নিয়োজিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হান্না বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বিরাজমান গুম-খুন, অপহরণ ঠেকাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।’



এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এএসএম শাজাহান বলেন, ‘যে সমাজে আইনের শাসন নেই, সেখানে সমস্যারও সমাধান নেই। আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে বেআইনি কাজ করছে তাতে এক সময় এটা মহামারী আকারে জাতির ধ্বংস বয়ে আনবে। আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতা ও কালো টাকার যে অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে এসে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নইলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।’  

     

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করছেন বর্তমান সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলেছে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ‘অস্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার গঠিত হওয়ায় তারা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনীতির ওপর এ সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।’



অপহরণের মতো অপরাধের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বাহিনীতে ভর্তির সময় ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে রাজনৈতিক পরিচয়কেই প্রাধান্য দেয়া হয়। অতিদলীয়করণের মাধ্যমে নিয়োগের ফলেই তারা সহজেই অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে।’



অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণেই দেশে এসব গুম-খুন হচ্ছে এবং এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে বলে মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।



নারায়ণগঞ্জে সাত জন অপহরণ ও খুনের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘তিনজন র‌্যাব কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়ার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে র‌্যাব এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সেইসাথে সরকার এ হত্যা সম্পর্কে জানে বলেই ওই তিনজনকে অতি দ্রুত অব্যাহতি দিয়েছে।’



তিনি বলেন, ‘এ সরকার জনগণের ভোটে নয়, র‌্যাব-পুলিশের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় এসেছে। তাই তারাও সরকারের ঘাড়ে চড়ে ফায়দা লুটবে এটাই স্বাভাবিক।’ তবে দেশের নাগরিক সমাজ এক হয়ে এ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে এমন পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক।  



সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ সরকার অন্যায় কাজে ব্যবহার করেছে বলেই তারা আজ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে।’



র‌্যাবের কার্যক্রম সম্পর্কে  তিনি বলেন, ‘র‌্যাব গঠিত হয়েছে বিশেষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। কিন্তু র‌্যাবকে আজ সর্বক্ষেত্রে, সকল কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা কখনোই কাম্য নয়।’ পুলিশ বাহিনীকে উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে র‌্যাবের ব্যাবহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তিনি।



সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিচারবিভাগকে অকার্যকার করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন বিচারপতি কাজী এবাদুল হক। বিচার হচ্ছে না বলেই এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রতিনিয়ত খুন, গুম, অপহরণ চলছে অথচ বিচারকরা সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে তারা কোনো বিচার করতে পারছে না। এমন অবস্থায় বিচারবিভাগ থাকা আর না থাকা সমান কথা।’



সবকিছুর দায় সরকারের কাঁধে দিয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই দেশে অপহরণ, গুম-খুনের এসব ঘটনা ঘটছে। তাই সরকারকে এর দায় নিতে হবে। সেই সাথে সরকারকেই এমন পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।’



উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। এর তিনদিন পর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন আরো একজনের লাশ নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।



এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ডিসি, এসপি, র‌্যাবের সিও এবং সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানার ওসিসহ ৭ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ ওঠার পর তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!