DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বিশ্ব অর্থনীতিতে বেক্সিট এর প্রভাব এবং ইইউ এর ভবিষ্যৎ।

bexit copy

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  বৃটেনের গনভোটের আগে  ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির নেতা নাইজেল ফ্যারাজ উৎসাহী সমর্থকদের বলেছিলেন, ২৩শে জুন হতে যাচ্ছে বৃটেনের স্বাধীনতা দিবস।

তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষে বৃটেনের ভোটে আর্থিক বাজারে যে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তা ততোটা আনন্দদায়ক নয়।

শুধু তাই নয় বৃটেনের এই গনভোট ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোস্টির সমন্ময়ে গঠিত ইউরোপিয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎকেও এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলা যায়।ইতিমধ্যেই পোল্যান্ড,নেদারল্যান্ড সহ কয়েকটি দেশে এই আদলে গনভোট আয়োজনের দাবী উঠেছে।

গনভোটের ফলাফল প্রকাশের পর এশিয়ার বাজারের লেনদেন শুরু হলে পাউন্ডের দাম ডলারের বিপরীতে কমেছে ১০ শতাংশের বেশি, যা গত ৩১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ইয়েনের বিপরীতে এর অবস্থান আরও করুণ।

বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ইউরোপের বাজারেও এশিয়ার বাজারের মতো দরপতন হতে থাকে এবং ১০ শতাংশের মতো দরপতন ঘটে।

বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তাকে ঘৃণা করেন এবং গণভোটের ফলাফল এই অনিশ্চয়তাকেই বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এশিয়ার তারল্য বাজারের দরপতন দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর প্রভাব নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আগাম মন্তব্য হয়ে যাবে। অবশ্যই বাজার কখনও কখনও একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে।

বিশ্বের মোট উৎপাদনের মাত্র ৩.৯ শতাংশ বৃটেনের। তাই আমেরিকা বা চীন যেভাবে বিশ্ববাজারে ফেলতে পারে ততটা সক্ষমতা বৃটেনের নেই। আবার আমেরিকার অর্থনীতি সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটাই মন্থর হয়ে পড়েছে এবং চীনও তাদের বিশাল অঙ্কের ঋণের বোঝা কতটা সামর্থ্যের সঙ্গে বহন করতে পারে তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।

বৃটেনের অর্থনীতির গভীর প্রভাব রয়েছে ইউরোপের ওপর, যেখানে বৃটেন একটি গ্রহণযোগ্য ভোক্তা দেশ। এবং ইউরোপীয় প্রবৃদ্ধিতে যেকোনো ধরনের বাধাকে এখন সুনির্দিষ্টভাবেই স্বাগত জানানোর সুযোগ নেই।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কাল সকালে বলেছে, এর জন্য তাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। ব্যাংকটি হয়তো এখন তার মূল সুদের হারের মাত্রাকে কমাবে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে হয়তো তাদের পরিমাণগত সহায়তা কর্মসূচিকেও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।

বৃটেনের অর্থনীতিতে তাই মন্দার আশঙ্কাই রয়েছে। বৃটেনের একক বাজারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যোগসূত্রে অন্য অঞ্চলের বাজারগুলোতে প্রবেশগম্যতার অনিশ্চয়তায় কর্পোরেট বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অস্থিতিশীল সময়ে ব্যবসায় খরচের পরিমাণ যেকোনো পরিমাণেই কম হয়ে থাকে। ভোক্তাদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।

যারা ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই মনে করতে পারেন যে ব্রেক্সিট ভোটের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা মূলত ভোটারদের ভীত করার একটি কৌশল। যদি তাই হয়, তারা তাদের খরচের পরিমাণ রাতারাতি কমিয়ে দিবে না। কিন্তু অর্থনীতিতে কালো ছায়ার আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বড় বড় খরচের খাত সম্ভবত সঙ্কুচিত হতে যাচ্ছে।

পাউন্ডের পতনের ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে, যা প্রকৃত আয় কমিয়ে দিবে। কিছু কর্মসংস্থান বাদ যাবে। কর্মঘণ্টা ও বেতনের প্রবৃদ্ধি কমবে। এবং বৃটেনের এমন একটি মন্দা ইউরোপের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখতে সক্ষম।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, বৃটেনের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে যতটুকুই হ্রাস হোক না কেন ইউরোপের অর্থনীতি তার অর্ধেক হারে কমবে। ব্রেক্সিট অন্যভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বড় একটি আশঙ্কা হলো, আর্থিক ঝুঁকি থেকে পশ্চাদপসরণের সীমা বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির ফাঁকফোকড়গুলোকে প্রভাবিত করবে, বিশেষ করে চীন ও দক্ষিণ ইউরোপকে।

অক্টোবরে ইতালির নিজেদের সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে একটি গণভোট রয়েছে। ইতালির সংস্কার-মনস্ক প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজি বলেছেন, ওই গণভোটে তার বিরুদ্ধে ফলাফল এলে তিনি পতদ্যাগ করবেন। ব্রেক্সিট গণভোট সেই সম্ভাবনারই পক্ষে সহায়ক হবে। দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এমন আরও ভোটের কারণ হতে পারে।

ইউরোপীয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক বন্ড কিনে সেই উদ্বেগের লক্ষণকে ভাসিয়ে দিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু তারা দুর্বল প্রবৃদ্ধির অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলো নির্মূলে খুব বেশি কিছু করার নেই তার। ব্রেক্সিট থেকে চীন পর্যন্ত সংযোগ রেখা টানা অত্যন্ত কঠিন। ইউরোপের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়লে তা অবশ্যই চীনের রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সম্ভবত আরও বড় একটি ঝুঁকি হলো ডলারের শক্তিশালী অবস্থান; ইউরোপের মুদ্রা দুর্বল হতে থাকলে তা ইউয়ানকে নতুন করে আরও বেশি চাপের মুখে ফেলতে পারে। এমনকি যদি কিছু বিনিয়োগকারী বাজারে আস্থাও রাখেন, পুঁজিবাজারের পড়ন্ত অবস্থা দীর্ঘমেয়াদি শঙ্কারই প্রতিফলন।

মুক্ত বাণিজ্যের দীর্ঘদিনের সমর্থক বৃটেন যদি আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দিতে পারে, বৈশ্বিক ব্যবসায়গুলো অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চুক্তির ওপর আর কতটা আস্থা রাখতে পারবে? বৃটেনকে বাদ দিয়ে খর্ব ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি উদার বৈশ্বিক ব্যবস্থার জন্য সমস্যারই পূর্বলক্ষণ।

অন্যান্য দেশের জাতীয়তাবাদী, জনপ্রিয়তাবাদী ও সংরক্ষণবাদীরা ব্রেক্সিটের দ্বারা উৎসাহিত হবেন। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন সম্প্রতি সতর্কবার্তা দিয়েছে যে জি২০ দেশগুলোতে সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যের পরিমাণ বহুগুণে বাড়ছে, যার গতি ২০০৮ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগে ব্রেক্সিট ভীতিকর কোনো প্রভাব রাখবে না, সেটা বিস্ময়কর হবে। এটা শ্রমিকদের অভিবাসনের সংখ্যা আরও খানিকটা কমিয়ে দিবে, যা ব্যবসায়ের জন্য খরুচে হয়ে পড়বে।

এবং দুর্বল মুদ্রার মাধ্যমে ইউরোপের এই দুর্দশা যদি কিছুটা হলেও এশিয়া ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে মূলধনের প্রবাহেও প্রতিবন্ধকতার চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। বৃটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কীভাবে এবং কত দ্রুত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করতে পারে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে।

বৃটেন যদি তার একক বাজারে প্রবেশগম্যতায় বড় ধরনের ছাড় না দিয়েই দ্রুত চুক্তিতে আসতে পারে, বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর ভয়াবহতার আশঙ্কা হয়তো নাও পড়তে পারে। কিন্তু এমন অবস্থাতে বাজার আস্থা রাখছে না বলেই মনে হচ্ছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!