DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

নতুন সম্প্রচার আইনে মন্ত্রী–কমিশনের পূর্ন দায়মুক্তিঃ যাওয়া যাবে না আদালতেও

sat1 copy

 ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে জেল-জরিমানার বিধান থাকলেও আইনটির কারণে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সরকারি কর্মচারী বা সম্প্রচার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন না। দায়িত্বশীলদের  এই অভুতপূর্ব  দায়মুক্তি দিয়ে সম্প্রচার আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।

গত বুধবার আইনের খসড়াটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

আগামী ৪ মের মধ্যে এই খসড়ার ওপর মতামত বা পরামর্শ দেওয়া যাবে। অংশীজনদের নিয়ে ৫ মে খসড়াটির ওপর মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সম্প্রচার আইন বা প্রবিধানের আদেশ, নির্দেশ বা সরল বিশ্বাসে করা কোনো কিছুর কারণে সংক্ষুব্ধ হয়ে মন্ত্রীসহ পদস্থদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন না।

এ প্রসঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি কর্মচারীরা পদাধিকারবলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এ জন্য তাঁদের ব্যক্তিগত দায় থাকা উচিত নয়। মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাধারণত মন্ত্রীর কথা সুনির্দিষ্টভাবে আইনে উল্লেখ থাকে না।

আইনটির খসড়া তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেন আইনজীবী তানজীব উল আলম।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দায়মুক্তি না থাকলে নির্ভয়ে কেউ দায়িত্ব পালন করতে চাইবে না। আইনে মন্ত্রীর কথা উল্লেখ থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ বলতে পারে ওনার (মন্ত্রীর) নির্দেশে এটা করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রীকে জড়ানোর সুযোগ থাকে। এ জন্যই হয়তো মন্ত্রীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৪ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার গেজেট প্রকাশিত হয়। এরপর গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দিকনির্দেশনামূলক এই নীতিমালায় জাতীয় সম্প্রচার কমিশন করার কথা ছিল। সেই কমিশন গঠনের জন্য আইনের খসড়া প্রণয়নে ৪০ সদস্যের কমিটি গঠন করে তথ্য মন্ত্রণালয়।

জরিমানার সুরক্ষা: আইন লঙ্ঘন করে সম্প্রচারমাধ্যম পরিচালনা করলে লাইসেন্স বাতিল ছাড়াও সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে। প্রশাসনিক আদেশ বা নির্দেশে এই জরিমানা আদায় করা যাবে। তবে প্রশাসনিক আদেশ বা নির্দেশে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ লাভের প্রাধিকার পাবেন না। এমনকি এমন দাবি আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে উত্থাপন করতে পারবেন না।

আইনে বলা আছে, যদি কেউ এমন দাবি উত্থাপনও করেন, তাহলে আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ তা সরাসরি বাতিল করতে পারবে। আইনের ২৪ এর ৫ ধারায় এ কথা বলা আছে। ২৪(৪) ধারায় আছে, লাইসেন্স বাতিল, সংশোধন বা স্থগিত করার ক্ষমতা কমিশনের হাতে থাকবে। যদিও কমিশন লাইসেন্স দেওয়ার মালিক নয়। কমিশন লাইসেন্স প্রদানে সরকারকে সুপারিশ করবে।

আদালত বা কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণের দাবি নাকচ করলে ভুক্তভোগী কোথায় যাবে—এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, সে ক্ষেত্রে রিট আবেদন করার সুযোগ থাকবে। জরিমানা ছাড়াও সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনকে ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনা করে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, আইনের বিধিবিধান বা প্রবিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড, কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। এরপরও সম্প্রচার আইনে অপরাধ চলতে থাকলে প্রতিদিনের জন্য অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার সুযোগ থাকছে। আইনের ২৮ ধারায় হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

তবে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান বাস্তবতায় এই আইন অপপ্রয়োগের সুযোগই বেশি। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আদালত অবমাননা, মানহানির বিষয়গুলো গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ মেনে চলে। তা ছাড়া লাইসেন্স নেওয়ার সময়ও এসব বিষয়ে গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষকে লিখিত অঙ্গীকার করতে হয়। তাই নতুন করে তার জন্য জেল-জরিমানার দরকার আছে বলে মনে করেন না তাঁরা।

জানতে চাইলে মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, খসড়াটি দেখে তাঁর মনে হয়েছে, এটা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে এবং সম্প্রচার গণমাধ্যমে অস্থিরতা বাড়াবে। তাঁর মতে, উদ্দেশ্য যাই থাক, দিন শেষে সম্প্রচারমাধ্যম হবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়নের সময় তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর বলেছিলেন, আইনটি একটি ঘুমন্ত বাঘ। পরে দেখা যায়, সেই বাঘই অনেক কিছু খেয়ে ফেলে। অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়, সাংবাদিকেরা গ্রেপ্তার হন। বাক্স্বাধীনতা ও তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা আর্টিকেল ১৯ ওই খসড়া আইনের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে একমত হলেও সংগঠনটি জেল-জরিমানা সমর্থন করে না।

জানতে চাইলে সংগঠনটির বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশীয় পরিচালক তাহমিনা রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে শুভ চর্চা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষায় ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ না করা এবং করতে হলেও তা এমন পর্যায়ে প্রয়োগ করা, যখন আর কিছুই করার উপায় থাকে না।’

তাহমিনার মতে, ‘এই উদ্বেগ ছাড়া বাকি বিষয়গুলোতে আমরা মোটামুটি একমত। আমরা মনে করি, আইনটির আওতায় একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কমিশন গঠন হবে এবং বহুত্ববাদ নিশ্চিত হবে।’ আইনের খসড়ায় বলা আছে, আইনটি বলবৎ হওয়ার পর অবিলম্বে সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশনে একজন নারীসহ পাঁচজন কমিশনার থাকবেন। রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেবেন। কমিশনারেরা সরকার গঠিত অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হবেন এবং রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগ পাবেন। তাঁদের অপসারণেও রাষ্ট্রপতি এক বা একাধিক বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করবেন।

তবে জেল-জরিমানা রাখায় আপত্তি তুলেছেন কমিটির অন্যতম সদস্য ও তথ্য প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার।

তিনি বলেন, ‘এসব শাস্তি সমর্থন করি না। শাস্তির বিষয়গুলো কমিশনের এখতিয়ারে থাকা উচিত ছিল।’ তিনি বলেন, চুরি-ডাকাতির অপরাধ আর গণমাধ্যমের অপরাধ এক করে দেখার সুযোগ নেই। সাংবাদিকতার বিধিবিধান বা নৈতিকতা লঙ্ঘন করলে বা গণমাধ্যম-সংক্রান্ত যেকোনো অপরাধ হলে সেগুলো চিহ্নিত করে তদন্ত ও শাস্তি ঠিক করবে কমিশন। এর বাইরে কোনো অপরাধ হলে মানহানির মামলা দায়ের বা প্রচলিত আইনে বিচারের সুযোগ আছে। খসড়া আইনটি নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনা করে এর অসংগতিগুলো দূর করা উচিত।

জেল-জরিমানা প্রসঙ্গে তানজীব উল আলম বলেন, জেল-জরিমানা না থাকলে সম্প্রচার কমিশন আরেকটি প্রেস কাউন্সিলে পরিণত হবে। তাহলে এই আইন করার মানেই হয় না। বিভিন্ন দেশের সম্প্রচার আইন পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রবণতা ও আইনকানুন বিশ্লেষণ করে এবং সংবিধান মাথায় রেখে খসড়াটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আইনে সম্প্রচারের জন্য ২৫ ধরনের কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে আছে মূল্যে বা বিনা মূল্যে দেশব্যাপী, স্থানভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন সম্প্রচার, দেশে-বিদেশে বা অঞ্চলে বেতার সম্প্রচার কার্যক্রম, অডিও-ভিডিও বার্তা সম্প্রচার কার্যক্রম, সম্প্রচার উপাত্ত, আইপি সম্প্রচার, কেব্ল অপারেটর সম্প্রচার, কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বেতার ও টেলিভিশন সম্প্রচার, টেরেস্ট্রিয়াল সম্প্রচার প্রভৃতি। তবে সামাজিক গণমাধ্যম সম্প্রচার আইনে আসবে কি না, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।

জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও খসড়া কমিটির সদস্য ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, শাস্তির বিধান না থাকলে আইন বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব থাকে না। যেমনটি হয়েছে প্রেস কাউন্সিলের ক্ষেত্রে। আবার তথ্য কমিশনের ক্ষেত্রে কিছুটা সুফল পাওয়া যায়।

কারণ, কেউ তথ্য না দিলে অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন জরিমানা করতে পারে। সম্প্রচার মাধ্যমগুলো এত দিন সরকার বা মন্ত্রণালয়ের হাতে ছিল। এখন কমিশনের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় এগুলো স্বাধীন ও গণমুখী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!