DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ওয়ারিদ থেকে এয়ারটেল হতে ৭৭ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ভারতের এয়ারটেল

airtelক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বর্তমানে দেশের মোবাইল ফোন খাতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ভারতের মোবাইল কোম্পানী এয়ারটেল। পাঁচ বছর আগে ওয়ারিদ টেলিকম পরিণত হয় এয়ারটেলে। ভারতীয় এয়ারটেল ওয়ারিদের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে নাম পরিবর্তন করে। ২০১০ সালে এই শেয়ার হস্তান্তরের সময় প্রায় ৭৭ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৫ জুন প্রতিবেদনটি সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়। ১৮ জুন সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৯তম বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়।

২০০৭-২০০৮ সালে ওয়ারিদ টেলিকমের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬৮৩ কোটি টাকার বেশি। পরের বছর ৩০ জুন এই সম্পদের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় প্রায় ৪৮২ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালের ৩০ জুন সম্পদের পরিমাণ নেমে আসে ঋণাত্মক ঘরে। তখন এর মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় (-) ২৬ কোটি ৮৯ লাখ ৫৩ হাজার ৭৪১ টাকা।

সে সময় প্রতিষ্ঠানটি দুই হাজার ৩৯১ কোটি সাত লাখ টাকা অ্যাকিউমুলেটেড লস (মোট ক্ষতি) দেখিয়ে সম্পদ ঋণাত্মক হিসেবে দেখায়। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ারিদ টেলিকম যখন এয়ারটেলের কাছে শেয়ার হস্তান্তর করছিল, তখন নেগেটিভ ইকুইটির (ঋণাত্মক সম্পদ) কারণে ওয়ারিদের সম্পদের টোকেন মূল্য এক লাখ মার্কিন ডলার দরে হস্তান্তর ফি বাবদ মাত্র তিন লাখ ৮০ হাজার ৫০ টাকা সরকারকে দেয়। টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ (সংশোধন) ২০০৭ অনুযায়ী, শেয়ার হস্তান্তরের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে মোট সম্পদ বা শেয়ার মূলধনের সাড়ে ৫ শতাংশ হারে হস্তান্তর ফি আদায় করতে পারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

ওয়ারিদ টেলিকম থেকে এই হারে হস্তান্তর ফি নেওয়া হয়নি। কোম্পানিটির ২০০৯ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী মোট শেয়ার মূলধনের পরিমাণ এক হাজার ৩৯৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬০০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী হস্তান্তর ফি দাঁড়ায় ৭৬ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯২৩ টাকা। কিন্তু হস্তান্তর ফি আদায় করা হয়েছে মাত্র তিন লাখ ৮০ হাজার ৫০ টাকা। ফলে এখানে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৭৬ কোটি ৯৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৭৩ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি বিটিআরসির ৮৫তম বোর্ড সভায় ওয়ারিদ টেলিকমকে ৭০ শতাংশ শেয়ার এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে হস্তান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়।

এয়ারটেল বাংলাদেশে নতুন ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে –এই শর্তে ওয়ারিদের ৭০ শতাংশ শেয়ার এয়ারটেলের কাছে হস্তান্তরের অনুমতি দেয়। পরে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই ওয়ারিদ তার ১০০ টাকা ফেসভ্যালুর (অভিহিত মূল্য) প্রতিটি শেয়ারের দাম কমিয়ে মাত্র ছয় পয়সা (০.০৬ টাকা) নির্ধারণ করে। এরপর ১১ কোটি ৪৪ লাখ ৭৪ হাজার ৬৪০টি শেয়ার ৬৮ লাখ ৬৮ হাজার ৪৭৮ টাকায় এয়ারটেলের কাছে হস্তান্তর করে।

যদিও ওয়ারিদ লিমিটেডের অনুমোদিত ২০ কোটি শেয়ারের মধ্যে ওয়ারিদের প্রকৃত শেয়ার ১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮০টি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৬টি শেয়ার এয়ারটেলের কাছে হস্তান্তর করার কথা। সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, পরবর্তীকালে এয়ারটেল ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলে ওয়ারিদ তার ২০ কোটি শেয়ারকে ৪৭ কোটিতে রূপান্তর করে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদনের পর ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এয়ারটেলের কাছে ২৫ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৫৭টি শেয়ার নতুনভাবে হস্তান্তর করে ওয়ারিদ। এ সময় শেয়ারের মূল্য দেখানো হয় দুই হাজার ৭৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ছয় পয়সার প্রতিটি শেয়ারের দাম দেখানো হয় ৭৯ টাকা ৮২ পয়সা। সিএজি কার্যালয় বলছে, ‘এতে প্রতীয়মান হয়, সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ০.০৬ টাকা দেখানো হয়। সঠিকভাবে সম্পদের মূল্য নির্ধারিত হলে বিটিআরসি ও জয়েন্ট স্টক কোম্পানি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে সক্ষম হতো।’ এসব প্রশ্নের উত্তরে অডিট প্রতিষ্ঠান নিজেদের পক্ষে জবাব দিয়েছে। তবে সেসব জবাব সন্তোষজনক বলে মনে করছে না নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ। ফলে ওয়ারিদ টেলিকমের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায় করে তার প্রমাণপত্র অডিট অফিসে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছি। কমিটিতে সচিব, বিটিআরসির প্রতিনিধি রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে প্রমাণসহ নথিপত্র হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এ বিষয়ে এয়ারটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন লিখে ই-মেইল করতে বলা হয়। মেইল করা হলে এয়ারটেলের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান শমিত মাহবুব শাহাবুদ্দিন একটি জবাব পাঠান। এতে বলা হয়, ‘এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড সব সময় সর্বোচ্চ মানের করপোরেট সুশাসন বজায় রেখে আসছে, ভবিষ্যতেও তা বজায় রাখবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সঙ্গে যে কোম্পানিটি জড়িত, এয়ারটেল বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান, বা এর মূল কোম্পানি ভারতী এয়ারটেলের সঙ্গে তার কোনো অংশীদারি নেই। কাজেই এ বিষয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারব না।’ একই বিষয়ে বিটিআরসির সচিব ম সারওয়ার আলম বুধবার দুপুর ১টায় আমাদের বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি বলতে পারবে।’

তবে তিনি দুই ঘণ্টা পর আবার যোগাযোগ করতে বলেন। পরে যোগাযোগ করা হলে তাঁকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর একান্ত সহকারী বলেন, ‘স্যার মিটিংয়ে আছেন।’ এর পরের কয়েক ঘণ্টায় আরো তিনবার চেষ্টা করা হলেও একই জবাব পাওয়া যায়।

টেলিযোগাযোগ সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!