DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া বার্তা

98195_1শ্রম ইস্যুতে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না ছড়াতে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বলেছে, 'শ্রমপরিবেশ নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের কার্যক্রমকে যেভাবে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন সরকারের ঊর্ধ্বূতন কর্মকর্তা ও বিজিএমইএ নেতারা, তা শ্রমবান্ধব নয়। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বাংলাদেশের শ্রমপরিবেশ সুরক্ষায় ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলবে।' শ্রম অধিকার সুরক্ষায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশটি।

ঢাকাকে কড়া বার্তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, 'বাংলাদেশ যখন শ্রমপরিবেশ উন্নয়নে ক্রেতা দেশগুলোর কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, তখন শ্রমিকদের ব্যাপারে এ ধরনের তথ্য আতঙ্কজনক এবং সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।' যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, তাদের কাছে সাম্প্রতিক যে রিপোর্ট রয়েছে, তাতে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে জিএসপি-সংক্রান্ত 'অ্যাকশন প্ল্যান' বাস্তবায়নেও কঠোর মনোভাব পোষণ করা হয়েছে মার্কিন প্রশাসন থেকে। দেশটির বাণিজ্য দফতর ইউএসটিআর সরকারকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, 'ইপিজেড আইনে ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা যুক্ত করার যে শর্ত রয়েছে (অ্যাকশন প্ল্যানে) তা পূরণ করতেই হবে। অন্যথায় ভেবে নেওয়া হবে, তাদের (ওবামা প্রশাসনের) দেওয়া শর্ত বাস্তবায়নে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ।' 'নন পেপার জিএসপি রিভিউ অব বাংলাদেশ' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ ধরনের কড়া বার্তা দিয়েছে মার্কিন বাণিজ্য দফতর ইউএসটিআর। প্রতিবেদনটির একটি সারসংক্ষেপ ৫ নভেম্বর নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন থেকে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়। মিশনের নোটিসে বলা হয়েছে- জিএসপি-সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের এই পর্যালোচনার জবাব ১৫ নভেম্বরের মধ্যে দিতে হবে। এদিকে গতকাল ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ এক পয়সাও শুল্ক দেয় না।'


যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই বার্তা এমন সময়ে দেওয়া হলো, যখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- জিএসপি-সংক্রান্ত যে অ্যাকশন প্ল্যান দেওয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগ শর্তই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। এমনকি ইপিজেড আইন পরিবর্তন করে সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ সংস্থা (ওয়ার্কার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন) গঠনেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে গত মাসে ইউরোপীয় কমিশনের সঙ্গে শ্রমপরিবেশসংক্রান্ত 'সাসটেইনেবল কমপ্যাক্ট' শীর্ষক বৈঠক শেষে ঢাকা ফিরে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'ইপিজেডের আইনে মন্ত্রিপরিষদে যে সংশোধন এসেছে তার বেশি একটা দাড়ি, কমা, সেমিকোলনও আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।'যুক্তরাষ্ট্রের রিভিউ প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- 'এখন বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকদের (উচ্চ পর্যায়ের) এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে যে, শ্রমিকদের ওপর কোনো ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা তারা আর বরদাশত করছেন না। পাশাপাশি যেসব কারখানায় নির্যাতন ও সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটছে, সেখানে বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতিতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদন এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে করে শ্রমবৈষম্য বা নির্যাতনের বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়।'

ব্রাসেলসে ২১ অক্টোবর ওই বৈঠকের পরের সপ্তাহেই নিউইয়র্কে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্ব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় শ্রমপরিবেশ উন্নয়নে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। তাদের অভিযোগের পক্ষে প্রমাণস্বরূপ আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনের (এএফএল-সিআইও) একটি পিটিশন সরকারের কাছে পাঠানো হয়, যেখানে পোশাক খাতে আরও ৪৬টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। পোশাক কারখানার পাশাপাশি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির বিরুদ্ধেও শ্রম অধিকার ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ উপস্থাপন করা হয় ওই পিটিশনে। বলা হয়- এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারের শ্রম দফতর কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। পিটিশনে আরও বলা হয়- বাংলাদেশের পোশাক খাতে ২০১১ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯৬টি কারখানায় ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র আটটি সংগঠন (৪ শতাংশ) মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষির (সিবিএ) চুক্তি করতে সমর্থ হয়েছে। এ ছাড়া ত্রিপক্ষীয় চুক্তির (মালিক-শ্রমিক-সরকার) আওতায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পোশাক কারখানা পরিদর্শন কার্যক্রম চলছে না বলে উল্লেখ করা হয় পিটিশনে। বলা হয়েছে- সরকার কর্তৃক বুয়েটকে কারখানা পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা খুব বেশি পরিদর্শন কার্যক্রম চালাতে পারেনি। যে কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে, তার প্রতিবেদনও প্রকাশ করেনি সরকার। এমনকি ইউনিয়নের বদলে সরকার ইপিজেডে শ্রমিককল্যাণ সংগঠন করার ঘোষণা দিলেও সেই সংগঠনগুলো মালিক কর্তৃপক্ষের শক্ত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এএফএল-সিআইওর ওই পিটিশনের পরপরই গত সপ্তাহে 'নন পেপার জিএসপি রিভিউ অব বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনটি সরকারের হাতে আসে। বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এ ব্যাপারে বলেন, 'মার্কিন প্রতিবেদনটি আমাদের হাতে এসেছে। আমরা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সময়সীমা মেনেই এর জবাব দেওয়া হবে।'

পোশাক রপ্তানিতে এক পয়সাও শুল্ক দেয় না বাংলাদেশ : পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে এক পয়সাও শুল্ক দেয় না বলে জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বছরে ৮০০ মিলিয়ন ডলার শুল্ক দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ যে ট্যারিফ পরিশোধ করে তার পরিমাণ জিরো, জিরো এবং জিরো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে চীন, ভারত, বাংলাদেশের জন্য একই হারে ট্যারিফ প্রযোজ্য রয়েছে বলেও জানান মোজেনা।

গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে এসব মন্তব্য করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। জিএসপি-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মোজেনা বলেন, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্ত পূরণের ওপর। এজন্য সরকারকে কারখানার কর্মপরিবেশ, অগি্ননিরাপত্তা, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা ও ত্রুটিপূর্ণ কারখানা সংস্কারের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে।

'ইউএস বাংলাদেশ ট্রেড টাইস : দ্য ওয়ে ফরোয়ার্ড' শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে মোজেনা বাংলাদেশকে এশিয়ার পরবর্তী বাঘ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, আগামীতে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের আকাঙ্ক্ষিত স্থান হবে এই দেশ। তবে এজন্য লাল ফিতার দৌরাত্দ্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমানোর পাশাপাশি আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করার জন্য যে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলোও তুলে ধরেন মোজেনা। তার মতে, বাংলাদেশকে সত্যিকারের বাঘ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি অবকাঠামো সক্ষমতা গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দেন মোজেনা।

অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ কম উল্লেখ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, এজন্য পাশের দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সহযোগিতা সম্পর্ক বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে জ্বালানি ও বাণিজ্যিক যোগসূত্রের ফলে এ অঞ্চলের সবাই উপকৃত হবে বলে মনে করেন তিনি। গ্যাস ও কয়লা আহরণের ব্যাপারেও সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন মোজেনা। আরও গুরুত্ব দেন যোগাযোগ অবকাঠামো দুর্বলতা বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আরও প্রশস্ত করার ওপর।

কানেকটিভিটিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করবে এই দেশ। এর ফলে একবিংশ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক পথ ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় করিডরের প্রধান যোগসূত্র এবং সর্ববৃহৎ পণ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসবে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দেখা তার স্বপ্ন বলেও জানান মোজেনা।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি সুলতান মাহমুদ ও পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!