DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কি ছাত্রলীগের সাম্রাজ্য???

98091_1কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল সোমবার এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে ফটোসাংবাদিক মনজুর আলম বেগের পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্ক্ষী ও নাগরিক সংগঠন ব্রতী।

তবে শান্তিপূর্ণ ওই সমাবেশটি ছাত্রলীগ কর্মীদের বাধার কারণে পণ্ড হয়ে যায়। তাদের বাধার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কিছু করতে পারেনি।

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের পরি‌‌‌চিত মুখ এসব কর্মীরা। গত সপ্তাহে ফটোসাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় এরই মধ্যে ছাত্রলীগের চার কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারাও গতকাল শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিল। সোমবার দুপুর ২টায় পূর্বনির্ধারিত প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারে শহীদ মিনারের দখল নেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। এদের বেশির ভাগই শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র।


প্রতিবাদ সমাবেশে আসা লোকজনকে তারা শহীদ মিনারের সিঁড়িতেই দাঁড়াতে দেয়নি। শহীদ মিনার দখলে নেওয়াদের বেশিরভাগই ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মী। তবে ছাত্রলীগের পদে থাকা কোনও জ্যেষ্ঠ নেতা জুনিয়র কর্মীদের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তিন শতাধিক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে শহীদ মিনারে শোডাউন চালায় তারা। এ সময় তারা প্রতিবাদকারীদের শহীদ মিনার কম্পাউন্ড ত্যাগের দাবি জানায়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী দাবি করেন, ছাত্রলীগের কোনও কর্মী শহীদ মিনারে যায়নি।

‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারে অবস্থান করা ছাত্রলীগের এসব কর্মী শহীদ মিনারে কোনও কর্মসূচির অনুমতি নেয়নি। অথচ যাদেরকে ঠেকাতে তাদের অবস্থান সেই প্রতিবাদকারীরা আগেই দাফতরিক অনুমতি নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, গত ৫ নভেম্বর একুশে পদক জয়ী ফটোসাংবাদিক মনজুর আলম বেগের ছেলে ইমতিয়াজ আলম বেগ এবং ভাতিজি সাবা আহমেদ ও রুবাইয়া আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলের পুকুরের কাছে ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার শিকার হন। ওই হামলার ছবি বিভিন্ন সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়।

এ ঘটনায় চার ছাত্রলীগ কর্মীকে শনাক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদেরকে সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ইমতিয়াজ আলম বেগ একজন খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার। তিনি বেগার্ট ইন্সটিটিউট অব ফটোগ্রাফির অধ্যক্ষ। তার ভাতিজি সাবা আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন (আইবিএ)- এর সাবেক শিক্ষার্থী।

সোমবারের সমাবেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠন ব্রতী। এতে অংশ নেন ইমতিয়াজ আলম বেগ, তার পরিবার, সংস্কৃতি কর্মী ও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থীরা। তারা ৫ নভেম্বরের হামলাকারীদের শাস্তির দাবি জানান। এসময় তাদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল, অপরাধীদের হাত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচান।

প্রক্টর আমজাদ হোসেনের ফোনে ওপার থেকে উত্তর আসে, ‘শহীদ মিনারে আসেন। আপনার লোকজনকে ফিরিয়ে নিন। তারা সমস্যা সৃষ্টি করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মান ধূলিস্মাৎ করে দিচ্ছে।’

৫ নভেম্বরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টিরও উদ্যোগ নেন প্রতিবাদ র‌্যালির আয়োজকরা। এ লক্ষ্যে তাদের অনুষ্ঠানে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সোমবারের ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, দুপুর ২টার দিকে কয়েকশ ছাত্রলীগ কর্মী শহীদ মিনারে জড়ো হয়। তারা শহীদ মিনারে মানববন্ধন করে। তাদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল, সাবা ও রুবাইয়ার অপপ্রচার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা কর।

সেদিনের ঘটনার ন্যায়বিচার দাবি করে তারা বলেন, সারা ও রুবাইয়া হামলা নিয়ে মিথ্যাচার করছেন এবং তারা ক্যাম্পাসে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এসময় তারা সাবা ও রুবাইয়ার পক্ষে একপেশে খবর প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমের সমালোচনা করেন। ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারের ছাত্রলীগ কর্মীরা জানায়, তাদের ক্যাম্পাসে এ ধরনের কোনও কার্যক্রম মেনে নেওয়া হবে না।

মজার বিষয় হচ্ছে, দুপুর ৩টা ২০ মিনিটের দিকে প্রতিবাদ সমাবেশে আসা লোকজন ফিরে যাওয়ার পরও শহীদ মিনার দখলে রাখা শিক্ষার্থীরা আর একটা স্লোগানও দেয়নি। পরে নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশে জড়ো হতে থাকে।

শহীদ মিনার বেদিতে যাওয়ার আগ প্রতিবাদকারীদের থামিয়ে দেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। তারা প্রতিবাদকারীদের শহীদ মিনার ত্যাগ করতে বলে। এ সময় সেখানে ছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক। পরে তারা শহীদ মিনারের বিপরীত দিকে অবস্থান নেন।

Nasir 13

ইমতিয়াজ, সাবা ও রুবাইয়া ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। তারা ব্রতীর প্রধান শারমিন মুর্শেদ, ব্যারিস্টার কামাল হোসেন, খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী লুবনা মারিয়াম, অধ্যাপক সি আর আবরার, সাংবাদিক জাফর সোবহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রকিবুদ্দিন আহমেদকে গাদ্দার ও বেগ পরিবারের এজেন্ট হি‌‌‌সেবে আখ্যায়িত করে।

এসময় যেকোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন সহকারী প্রক্টর ঘটনাস্থলে পৌঁছান। প্রতিবাদকারীরা গাছের নিচে গিয়ে বসেন। কিন্তু প্রতিবাদ সমাবেশে আসা লোকজনের একটা ব্যানার দেখেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ছাত্রলীগ। তারা ইমতিয়াজ, সাবা ও রুবাইয়ার বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।

ঢাবি প্রক্টর আমজাদ আলী ঘটনাস্থলে পৌঁছে শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নাগরিক সংগঠনের ব্যানার প্রত্যাহারের দাবি জানায়। প্রক্টরের সামনে তারা চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে যে। তারা আমাদের অপরাধী বলছে কেন?

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর প্রক্টর ও তার সহযোগীরা বাদনুবাদ নিরসনে ছাত্রলীগের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এক পর্যায়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান মোল্লা এবং শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন প্রক্টর।

আমজাদের ফোনে ওপার থেকে উত্তর আসে, ‘শহীদ মিনারে আসেন। আপনার লোকজনকে ফিরিয়ে নিন। তারা সমস্যা সৃষ্টি করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মান ধূলিস্মাৎ করে দিচ্ছে।’

এসময় প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে ছাত্রলীগ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের হস্তক্ষেপে তারা পিছু হটে।

এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের নিরাপত্তায় দাঙ্গা পুলিশ ডাকা হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও ঘিরে ফেলে ছাত্রলীগের কর্মীরা।

এদিকে, পল্লীগীতি ও দেশাত্মবোধক গান গাইতে শুরু করেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আনুশেহ আনাদিল, শায়ান ও বুনো। অপরদিকে উচ্চস্বরে ছাত্রলীগ কর্মীরা নারী কণ্ঠশিল্পীদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, ‘টি-শার্ট পরে বাংলা গান গাওয়া বন্ধ কর। হাতাকাটা পোশাক পরে এখানে আসবেন না। পশ্চিমা পোশাকে এ ধরনের গান গাইবেন না।’ পরে ছাত্রলীগও জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করে।

বিকেল ৫টার দিকে ব্রতীর প্রধান শারমিন প্রতিবাদ সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেন কোনও অপরাধমূলক তৎপরতা বা নারী নিপীড়নের ঘটনা না ঘটে সেদিকে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

অধ্যাপক আবরার বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জিত। আশা করছি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নই। তোমরাও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পার।’

এ প্রতিবেদক বেশ কজন শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অন্য সংগঠনকে বরাদ্দ দেওয়া স্থান কেন তারা দখল করলো?

পুরো পরিচয় প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে মঈন নামের একজন বলেন, ‘আমরা এখানে সমাবেশের অনুমতি নেইনি। আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমাদের কোনও অনুমতির প্রয়োজন নেই।’

বায়ো মেডিক্যাল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলোজির পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্র শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি পরিবার নামের ফেসবুক পেজে একটি ইভেন্ট পোস্ট করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী দাবি করেন, ছাত্রলীগের কোনও কর্মী শহীদ মিনারে যায়নি।

তিনি বলেন, ‘তারা সাধারণ শিক্ষার্থী। তাদেরকে সেখান থেকে নিয়ে আসার কোনও অধিকার আমাদের নেই। আমি শুনেছি, ব্রতী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্রিমিনাল বলেছে। ফলে তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!