DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়: হঠাৎ বিদ্যুৎহীন দেশ:নজীরবিহীন দূর্ভোগে দেশবাসী

1414860964জাতীয় গ্রিডে ত্রুটির কারণে রাজধানী ঢাকাসহ গোটাদেশ শনিবার বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে এক নজিরবিহীন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। দিনভর অফিস-কারখানা ও দোকানপাট ও হাসপাতালগুলো জেনারেটর থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ দিয়ে কাজ চালায়। দেশের প্রায় ৯০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র একে একে বন্ধ হলে দুপুরের পর চালুর চেষ্টা করেও বিপর্যয় থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি। বিকালের দিকে কয়েকটি কেন্দ্র চালু হলেও তা আবারও বন্ধ হতে থাকে।

এ অবস্থায় সন্ধ্যার পর কিছু কিছু কেন্দ্র চালু হতে থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর এটিই বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয়। নজিরবিহীন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর মানুষের মধ্যে উদ্বেগের পাশাপাশি নানা ধরনের গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে হঠাত্ করে বিভ্রাটের কারণ খুঁজতে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। 




শনিবার সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় একে একে বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে পুরো দেশের বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পায়নি রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসভবন থেকে শুরু করে সংসদ ভবন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, বিমানবন্দর, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন কলকারখানা।

 

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জেনারেটরের থেকে পাওয়া বিদ্যুত্ দিয়ে কাজ চলে। বিদ্যুত্ না থাকায় হাসপাতালগুলোতে দিনভর রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সন্ধ্যায় হাসপাতালগুলোতে পানির সঙ্কটও দেখা দেয়। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বন্ধ থাকে সাধারণ অস্ত্রোপচার। বেশিরভাগ কারখানা দুপুরের পর ছুটি দেয়া হয়।

 

সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ডুবে যায় রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ। পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় মোমবাতির চাহিদা বেড়ে যায়; এক পর্যায়ে কোনো কোনো এলাকায় মোমবাতি শেষও হয়ে যায়। জেনারেটরগুলো সচল রাখতে রাজধানীর পেট্রোল পাম্পগুলোতে ডিজেলের জন্য কন্টেইনার হাতে দেখা যায় বিকাল থেকেই। 


বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের বিদ্যুত্ না থাকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ পায়। বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বেলা সোয়া দুইটার দিকে তার ফেসবুকে লেখেন, জাতীয় গ্রিডে কারিগরি সমস্যার কারণে দেশজুড়ে বিদ্যুত্ বিপর্যয় হয়েছে।

 

কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যুত্ সরবরাহ ফিরে আসছে এবং ত্রুটি মেরামতের জন্য প্রকৌশলীরা কাজ করছেন। বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা দ্রুত কাটিয়ে উঠছিলাম, ৭০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত করেছিলামও। এর মধ্যেই গ্রিড আবার ‘ফেইল’ করে। সমস্যাটি ঠিক কী—তা বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী হামিদ সুনির্দিষ্টভাবে না জানালেও সন্ধ্যায় বিবিসিকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তাদের রিপোর্ট পেলেই প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে তা জানা যাবে।’ বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসকে প্রধান করে গঠন করা সাত সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। 

 

 


দেশে বিদ্যুত্ সঞ্চালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ’ পিজিসিবি’র ভেড়ামারা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চৌধুরী আলমগীর হোসেন শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিবেশী ভারতের একটি সাবস্টেশনের সমস্যার কারণে তার সাথে সংযুক্ত বাংলাদেশের গ্রিডে এই বিপর্যয় ঘটে থাকতে পারে।’ তবে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল-বেরুনি সন্ধ্যায় জানান, ‘কোনো গাফিলতির কারণে এই বিপর্যয় ঘটেনি, কারিগরি ত্রুটিই এর জন্য দায়ি।’ তবে এই ত্রুটি ঠিক কি এবং কোথায় তা ঘটেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তদন্ত কমিটি বলুক। ব্যক্তিগতভাবে আমার বলা ঠিক হবে না।’ 




বিদ্যুত্ বিভ্রাটের কারণ: 

ঠিক কি কারণে এভাবে হঠাত্ করে দেশজুড়ে বিদ্যুত্ বিভ্রাট ঘটেছে— তা নিয়ে কর্মকর্তারা বা বিদ্যুত্মন্ত্রী রাত আটটা পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি। তবে বিদ্যুত্ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জাতীয় গ্রিডে বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুত্ সঞ্চালন লাইনে সংযোগস্থলের কারিগরি ত্রুটি থেকেই বিভ্রাটের শুরু। বিবিসি বাংলা ভারতের বিদ্যুত্ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, শনিবার ভারতীয় সময় এগারোটায় (বাংলাদেশ সময় সাড়ে ১১টা) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যুত্ সরবরাহের যে ভেড়ামারা-বহরমপুর লাইন রয়েছে, তার একটি লাইন ‘ট্রিপ’ করেছিল বা বসে গিয়েছিল।

 

তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা এটাও নিশ্চিত করেছেন যে লাইন ‘ট্রিপ’ করার পরপরই দ্বিতীয় আরেকটি লাইন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিদ্যুত্ সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। ভারতীয় অংশে বিদ্যুত্ সরবরাহ অব্যাহত থাকে; কিন্তু ভারতীয় অংশে লাইন ‘ট্রিপ’ করার কারণেই বাংলাদেশ অংশে বিদ্যুত্ বিভ্রাট ঘটেছে কি না— তা ভারতীয় বিদ্যুত্ কর্মকর্তারা স্পষ্ট নয়।




বগুড়া প্রতিনিধি জানান বগুড়ায় শনিবার বেলা ১১টার পর থেকে পিডিবি’র লাইনে বিদ্যুত্ না থাকায় দুর্ভোগে পড়েন নাগরিকরা। বগুড়া পিডিবি’র সহকারী প্রকৌশলী খান মোহাম্মাদ জিয়াউল হক জানান, জাতীয় গ্রিড ফেল করায় বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ থাকে। খুলনা প্রতিনিধি জানান, খুলনায় পানির অভাব দেখা দিয়েছে অফিস-আদালত ও বাসাবাড়িতে। হিমায়িত খাদ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের খুলনা শাখার ব্যবস্থাপক আকবর হোসেন জানান, তিন ঘণ্টার বেশি বিদ্যুত্ না থাকায় এটিএম বুথগুলো বন্ধ থাকে। ফলে গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়েন। বরিশাল প্রতিনিধি জানান, বিদ্যুত্ বিপর্যয়ের ফলে পানির সমস্যায় পড়েন নগরবাসী।




রাজশাহী প্রতিনিধি জানান, হঠাত্ করে বিদ্যুত্ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় রাজশাহীর বিসিক শিল্পনগরীর বিভিন্ন কলকারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেইসঙ্গে বন্ধ থাকে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে ওঠা ওয়েল্ডিং কারখানা। রাজশাহীর বিসিক শিল্পনগরীর সপুরা সিল্ক মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ সদর আলী জানান বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কারখানা শ্রমিকদের ছুটি দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ে বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

পিকিং পাওয়ার প্লান্টের এলাকা দোহাজারী, চন্দনাইশ কিংবা আনোয়ারায়ও বিদ্যুত্ ছিল না। রংপুর প্রতিনিধি জানান, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে জরুরি অপারেশন বন্ধ থাকে। সেখানে পানির তীব্র অভাব দেখা দেয়। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি অপারেশন বন্ধ হয়ে যায়। পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, দেশের বৃহত্ বিদ্যুত্ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের ৯৫০ মেঘাওয়াট ক্ষমতার ৬টি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়।




বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ:

  বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে বিদ্যুত্হীন বাংলাদেশের খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে। বিবিসি অনলাইনের শিরোনাম ‘পাওয়ার লাইনের ত্রুটির কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুত্ বিভ্রান্তি’। খবরে বলা হয়, ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত একটি পাওয়ার লাইনের সমস্যার কারণে বাংলাদেশ বিদ্যুত্ পাচ্ছে না। যুক্তরাজ্যের মিরর অনলাইন জানায়, কারিগরি সমস্যার কারণে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ অন্ধকারে রয়েছে। প্রায় একই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করেছে এবিসি নিউজ। এছাড়াও প্রকাশ হয়েছে ভারতের এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইম্স, দ্য সিজনি মর্নিং হেরার্ল্ড, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ইকোনমিক টাইমস, দ্য হিন্দু, এপি, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ইত্যাদি সংবাদ মাধ্যমে। 


 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!