DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার আকাংখা, গণভোট ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

index6'স্বাধীনতা' একটি জাদুকরী শব্দ, যে টানে মানুষ প্রাণের মায়া অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারে, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করতে পারে। এমন প্রমাণ পৃথিবীজুড়ে নানা দেশে রয়েছে। রয়েছে উপমহাদেশেও। যেজন্য কবি লিখতে পেরেছেন উদ্দীপক পঙ্ক্তি- 'ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান'।

 

এমন অমেয় শক্তিধর স্বাধীনতা, যা প্রাণের চেয়েও প্রিয়, যার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের লাখো তরুণ এগিয়ে গেছে রণাঙ্গনে এবং শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার মানচিত্র, একটি স্বাধীন ভূখন্ড, নাম তার বাংলাদেশ-পরবর্তী পরিণাম যেমনই হোক না কেন? সম্ভাবনার দিকটাই বড় ইতিবাচক ঘটনা।

 

আর সে স্বাধীনতা কিনা অনায়াসে ছুড়ে ফেলে দিল স্কটল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ! অথচ বিশ্ব রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছে এ গণভোটের রায় জানতে। অপেক্ষা করেছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী, অপেক্ষা করেছে ইউরোপের রক্ষণশীল ঘরানার রাষ্ট্র ও অধিবাসীরা। অন্যদিকে বিশ্বের জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ, জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে বিশ্বাসী মানুষের প্রত্যাশা ছিল, স্কটিশ জনগণ ৩০০ বছরের পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করার পক্ষে ভোট দেবেন। একাধিক রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আশায় বুক বেঁধেছে এই ভেবে যে, স্কটরা স্বাধীন হলে তাদের সামনে একটি ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি হবে, হবে উদ্দীপক উদাহরণ।

 

না, তা হয়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশায় ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়ে স্কটল্যান্ডের ৫৫ শতাংশ ভোটার ৩০০ বছরের আকাঙ্ক্ষার ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করেছেন। স্বাধীনতাকামী স্কটল্যান্ডের জন্য তা একটি হতাশার কারণ হয়ে থাকল। স্বাধীনতার বিরুদ্ধপন্থীরা মনে হয় বিশ্বপরিস্থিতি ও আপাত সুবিধার দিকটাই বিবেচনা করেছে।

 

গণভোটের ফল প্রকাশের পর এখন চলছে ইতিহাসের পটভূমিতে বিচার-বিশ্লেষণের ধারা, সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ। কারও মতে, ব্যবধানটি তাৎপর্যপূর্ণ।

 

আমাদের কিন্তু তা মনে হয় না। একটি জাতির পক্ষে ৪৫ শতাংশ ভোটারের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মোটেই গুরুত্বহীন নয়। এই যে আকাঙ্ক্ষার সূচনা এ ধারা ক্রমেই শক্তিমান হবে, হবে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার শাসকদের আচার-আচরণের কারণে। তবে সন্দেহ নেই, পরিস্থিতি দৃষ্টে বিষয়টি সময়সাপেক্ষ।

 

সন্দেহ নেই, গণভোটের ফল দেখে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দল, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন, এমনকি স্বয়ং রানী এলিজাবেথ। যদিও তিনি প্রথমদিকে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন; কিন্তু পরোক্ষে হলেও তিনি তা পারেননি। শৈলভূখন্ড কে হারাতে চায়?

 

আর ব্রিটেনের সংসদীয় রাজনীতির বড় একটি পক্ষ শ্রমিক দল এবং তাৎপর্যহীন উদারনৈতিক দল কী ভাবছে? সবাই মনে হয় এ ফলে খুশি। জাতীয় স্বার্থ বলে কথা। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যগতভাবে ডান-বাম-মধ্য সবার এক 'রা'। ইতিহাস কম-বেশি এমন কথাই বলে। তাছাড়া ডান্ডি হারাতে, শিল্পনগর হারাতে কে চাইবে?

 

সত্যি বলতে কী, রক্ষণশীল বা উদারনৈতিক যে রাজনীতিই হোক, গণতন্ত্র নিয়ে যত হৈ-হুল্লোড় করা হোক না কেন, ব্রিটিশ রাজনীতি এখনও প্রকৃত গণতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারেনি, দীর্ঘদিনের সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণা কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়? যায় না বা তার চমকপ্রদ উদাহরণ তো শ্রমিকদলীয় প্রধানমন্ত্রী টনি বেস্নয়ার এবং তার ইরাক আগ্রাসন নীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী নীতির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলা।

 

আসলে এক্ষেত্রে বিশ্বরাজনীতি, ইউরোপীয় রাজনীতি ছোট্ট স্কটল্যান্ডের অন্দরমহলে প্রভাব রেখেছে বলে মনে হয়। সাম্রাজ্য হারানো সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাশুল গুনতে গুনতে এবং ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভুত্ব মোকাবিলা করতে যেখানে যুক্ত ইউরোপের, ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের নীতি গ্রহণ করেছে সেক্ষেত্রে তারা কেন চাইবে চোখের সামনে একটি বিভাজন, বিশেষ করে তা যখন একদা খ্যাতিমান ব্রিটেনকে নিয়ে।

 

এ বিভাজনের প্রভাব পড়বে বিশ্ববলয়ে, তা যত ছোট হোক না কেন স্কটল্যান্ড রাজ্য। স্পেনের বাস্ক-স্বাধীনতাবাদীরা 'হ্যাঁ' ভোটের জয়ে উৎসাহিত হতো, যেমন হতো কানাডার কুইবেক। আর কুর্দিরা তো বুশ-বেস্নয়ারের কল্যাণে এক পা বাড়িয়ে রয়েছে স্বাধীন কুর্দিস্তান গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। ইরাক এখন ততটা সমস্যা নয়, যত বাগড়া তুরস্কের। আর এক্ষেত্রে মার্কিন সমর্থন তাদের আশার আলো জিইয়ে রেখেছে।

 

এসব প্রভাব কি অস্বীকার করা যায়? সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকায় কোনো ফারাক নেই। তাই স্বাধীনতাবিরোধীদের জয়ে খুশি বারাক ওবামা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন 'না'পন্থী জনগণকে। হলেনই বা নির্যাতিত কৃষ্ণাঙ্গ-বংশধর-একবার ওই সাদা বাক্সে বন্দি হলে সাম্রাজ্যবাদী নীতিমাফিক চলাই দস্তুর, সেক্ষেত্রে সাদা-কালোয় কোনো তফাৎ হয় না।

 

এবার দেখা যাক, ফলের চরিত্রটা কেমন? মূলত তরুণদের বড়োসড়ো অংশই স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছে এবং দিয়েছেন স্বাধীনতাপন্থী রাজনৈতিক বলয়ের মানুষ অর্থাৎ ভোটার, যার যার বিচার-বিবেচনা মতো। তবে লক্ষ্য করার বিষয়, বয়স্ক ও বয়োবৃদ্ধদের ভোট গেছে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। বয়স্ক মননে স্থিতি, শান্তি, নিরাপত্তার বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে তারা সর্বদাই। তবে জানতে পারলে ভালো হতো, এ বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে শিক্ষিতের হার কত।

 

আমাদের ধারণা, অনিশ্চয়তার বিষয়টি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার বিষয়টি ভোটারদের, বিশেষ করে বয়স্ক ভোটারদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সেক্ষেত্রে বড় গাছে দড়ি বাঁধা থাকলে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকা যায় প্রাত্যহিক জীবনযাপনে। বুড়ো হলেও সিংহ তো সিংহই। সে অবস্থায় স্কটল্যান্ডের একা বাঁচার চেষ্টায় আস্থা রাখতে পারেননি বয়স্ক ভোটাররা।

 

এ বয়সে সবাই চান নিশ্চিন্তি। হাত-পা-মুখ না হয় একটু কমই নাড়াচাড়া করা গেল। তবু অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা তো অনেকটা থাকবে? একা স্কটল্যান্ড কতক্ষণ প্রতিকূল স্রোতে সাঁতার কাটতে সক্ষম হবে। শিক্ষার কথা বলছিলাম এ কারণে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকাও সম্ভবত বয়স্কদের মনে প্রভাব ফেলেছে এবং স্বাধীনতাবাদীদের ভোট কেটেছে। স্বাধীনতাপন্থী নেতা অ্যালেঙ্ স্যামন্ডের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়ার কথা অগ্রিম ঘোষণা না করাই বিচক্ষণের কাজ হতো।

 

এখন প্রশ্ন, এরপর কী হবে? প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন কী তার প্রতিশ্রুতি যথাযথ পালন করবেন, নাকি প্রত্যাশার আলোক বিন্দুগুলো রাজনীতির এক্কা-দোক্কা খেলায় হারিয়ে যাবে? অধিকতর ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টি কি কথার কথাই হয়ে থাকবে? আগামী নির্বাচন সামনে রেখে শ্রমিক দল, উদারনৈতিক দল স্কটল্যান্ডের পাওনাগন্ডার ব্যাপারে অধিকতর সোচ্চার হওয়ার সুযোগ পেল। ইচ্ছা করলে তারা তা কাজে লাগাতে পারে।

 

আর স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির হাতে সুযোগ এলো বিচক্ষণতার সঙ্গে না পাওয়ার বঞ্চনাকে কাজে লাগানো, জনমত বদলাতে সঠিক ভাষ্যে সোচ্চার হওয়া, যাতে ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। এক্ষেত্রে কৌশল ও কুশলী প্রচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ইস্যু সামনে রেখে।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!