DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

রানা প্লাজা ধসের বর্ষপূর্তিঃ মামলার জালে ক্ষতিপূরণ, অনুদানে দায় এড়ানোর চেষ্টা

images (32)রানা প্লাজার ধস বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিল্প দুর্ঘটনা। অতিলোভী সর্বগ্রাসী মালিকপক্ষের স্বার্থের কোপানলে হতাহত হয়েছে কত প্রাণ তার অনুপুঙ্খ হিসাব কোনোদিন কেউ দিতে পারবে না। নিরন্তর শ্রমে দরিদ্র বাংলাদেশকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর সংগ্রামে নিয়োজিত শ্রমিকদের জীবন ও সম্মান কত তুচ্ছ তার নগ্নরূপ দেখছে বিশ্ব।



রাতে ঘড়ির কাটা ১২টার সীমা পেরোলেই সময় আমাদেরকে ঠেলে দেবে ২৪ এপ্রিলের ঘরে। পূর্ণ হবে রানা প্লাজা ধসের এক বছর। তিনশ পয়ষট্টি দিন পেরিয়ে গেলেও আজও হতাহতের কোনো সঠিক হিসাব দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। যে মামলা করছে সরকার তার তদন্তেও লেগেছে দীর্ঘসূত্রীতার আছর। জামিনে বেরিয়ে গেছে অভিযুক্ত ৮ গুরুত্বপূর্ণ আসামি। শঙ্কায় ভুগছে বিচারপ্রার্থীরা। সাধারণ মানুষদেরও প্রশ্ন, আসলে দায়ীদের কোনো বিচার হবে কী?



রানা প্লাজায় হতাহতদের সংখ্যা:

রানা প্লাজা ধসের ক্ষণ বছর ঘুরলেও নিহত ও নিখোঁজদের সঠিক সংখ্যা বের করতে পারেনি সরকার। ফলে সরকারের পরবর্তী সব পদক্ষেপই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব হিসাব পাওয়া গেছে তাতে অসংগতির যেন শেষ নেই। এসব বিভ্রান্তি নিরসনেরও কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু নিরসনের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।



এ বছরের ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ও পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ, প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিষয়ক’ আলোচনায় এ বিষয়ে হতাশাজনক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। দুর্ঘটনার সময় ওই ভবনে কতজন শ্রমিক কর্মরত ছিলেন তার কোনো সঠিক হিসাব আজও জানা যায়নি। বিজিএমইএ-অ্যাকশন এইড তাদের রিপোর্টে ৩৫৭২ জন, সিপিডি ৩৬৭০, বিলস ৩৯৪৮ এবং কো-অর্ডিনেশন সেল ৩৮৪৮ জন শ্রমিকের কর্মরত থাকার কথা প্রকাশ করেছে।



জেলা প্রশাসক অফিসে রক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত এবং ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়। এ নিয়ে বর্তমানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে।

 

৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। অসনাক্তকৃত মরদেহের মধ্যে পুরুষ ৫৫ এবং নারী ২৩৬ জন।



এছাড়া ১ হাজার পাঁচশ ২৪ জন আহত হয়। এদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে এমন আহতের সংখ্যা ৭৮ জন। তবে হতাহতের সঠিক কোনো সংখ্যা না থাকার কারণে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বা সহায়তার কাজটিও কতটা নির্ভুলভাবে করা যাবে তা নিয়েও রয়েছে জটিলতা।



ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা:

সরকার তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের লাশ দাফনের জন্য প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে ৮৪৪ জনকে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রদান করে। এছাড়া আহতদের চিকিৎসার জন্যও ৫ হাজার টাকা করে দেয় সরকার।



দুর্ঘটনার পর দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেও ‘রানা প্লাজা ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ নামে একটি তহবিলে মাত্র ১৭ মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে। অথচ দুর্ঘটনার পর পাওয়া প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।



ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তির মাত্র একদিন আগে মাত্র দুজনকে ওই ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়ার কাজ শুরু করেছে এই সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটি।



কবে নাগাদ পুরোদমে এই কাজ শুরু করা হবে এবং শ্রমিকদেরকে এই বিষয়ে জানানো হয়েছে কি না সে কথা অবশ্য জানা যায়নি। তবে বিবিসির কাছে কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (বিকাশ) মাধ্যমে সবার কাছে এই অর্থ পৌঁছে দেয়া হবে। তবে অনুদান প্রদানের এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে অর্থ পৌঁছানোর বিষয়টি অধিকাংশ শ্রমিকই জানে না।



গত ১৭ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত ৫৩ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার চেক হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার তেজগাঁও কার্যালয়ে ৫৩ পরিবারের ৭৩ সদস্যের হাতে আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেন। গত বছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী তার ত্রাণ তহবিল থেকে নিহতদের পরিবার ও আহতদের মাঝে এ পর্যন্ত মোট ২২ কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ টাকা বিতরণ করেছেন।



এদিকে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্ট স্বঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। ওই রুলের শুনানিতে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি আদালতে বলেছিলেন, ‘ভবন মালিক ও গার্মেন্ট মালিকদের কাছ থেকে ৬শ কোটি টাকা আদায় করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে। যার মধ্যে ভবন মালিক দেবে তিনশ কোটি টাকা ও গামের্ন্ট মালিকরা দেবে বাকি তিনশ কোটি টাকা।’



তবে শুনানি শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের কাকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে গুরুত্ব বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করার জন্য নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, ঢাকা জেলার ডিসি, এসপি, বিজিএমইএ, ৫ গার্মেন্টের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, শ্রম মন্ত্রণালয়, বুয়েটের একজন করে প্রতিনিধি এবং মেডিসিন, মনোবিদ, অর্থনীতিবিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। আদেশ পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল কমিটিকে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকাও জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরলেও সেই কমিটিই গঠন করা হয়নি, প্রতিবেদন তো দূরের কথা।



রানা প্লাজা ধসের পর আদালতের উপরোক্ত নির্দেশনা ও আদেশের বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হয়েছে এ নিয়ে কথা হয় আহতদের পক্ষের আইনজীবী জ্যোতিময় বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি  বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের আজ (বৃহস্পতিবার) এক বছর পূর্তি হতে চলেছে। এই ঘটনায় তিনটি পৃথক মামলা হয়েছে। এছাড়াও আদালত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট সকল প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাথমিকভাবেই যে কমিটি গঠনের কথা ছিল তা এখনো করা হয়নি। আর কমিটি গঠন না হওয়ায় ঘটনার মূল প্রতিবেদন এখনো আদালতে প্রেরণ সম্ভব হয়নি। মামলাটি বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের কোর্টে রয়েছে। আদালতের অন্যান্য মামলার চাপে শুনানির দিন তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করছে।’

 

অ্যাডভোকেট জ্যোতিময় বড়ুয়া আরো বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে এখনো পর্যন্ত প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব হয়নি। অথচ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যা দেয়া হয়েছে তাকেই ক্ষতিপূরণ ধরে রিপোর্ট করছে। এটা মোটেই কোনো ক্ষতিপূরণ নয়। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে যেসব অনুদান পৌঁছানো হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে অনুদান হিসেবেই এসেছে। আর বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাই এই অনুদান দিয়েছে।’  



রানা প্লাজা ধসে দায়ীদের বিচার:

রানা প্লাজা ধসের ৩৬৫ দিনেও চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের সহকারী কমিশনার বিজয় কৃষ্ণ কর জানান, চার্জশিটের নব্বই শতাংশ কাজই শেষ। এখন আইনগত ফাঁক ফোকরগুলো দেখা হচ্ছে। এপ্রিলে না পারলেও মে মাসের মধ্যে তিনি চার্জশিট দাখিল করতে পারবেন। আগামী ২১ মে আদালতে মামলাটির চার্জশিট দাখিলের জন্য দিনি ধার্য রয়েছে।



এ দুর্ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এর একটি অবহেলায় মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০৪ক/৩৩৭/৩৩৮ ধারায় এবং অপরটি নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করায় ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ এর ১২ ধারায়। পরবর্তীতে প্রথম মামলাটিতে ৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭ ও ৩০৪ ধারা সংযোজন করা হয়।



তবে এ মামলার ২১ আসামির মধ্যে ৯ আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন। জামিনে থাকা ৯ আসামি হলেন- আব্দুল খালেক ওরফে খালেক কুলু, মোহাম্মদ আলী খান, রেফাত উল্লাহ, আবুল হাসান, অনিল কুমার দাস, শাহআলম মিঠু, এমতেমাম হোসেন, রাকিবুল ইসলাম ও আলম মিয়া।



এছাড়া মামলায় জেলহাজতে থাকা ১২ আসামি হলেন- বজলুস সামাদ আদনান, মাহমুদুর রহমান তাপস, সোহেল রানা, আমিনুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, আ. রাজ্জাক খান, আলমগীর, আব্দুল মান্নান, রাসেল, মধু ও সারোয়ার।



এ ঘটনায় দু’টি মামলার মধ্যে একটি মামলা করেছেন সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ খান। গত বছরের ২৫ এপ্রিল সাভার থানায় ফৌজদারি কার্যবিধিতে তিনি এই মামলা দায়ের করেন। অপর মামলাটি দায়ের করেন রাজউকের অথরাইজড অফিসার হেলাল আহম্মেদ। তিনি ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের দিনই জাতীয় ইমারত বিধি লঙ্ঘনের দায়ে মামলাটি দায়ের করেন।



পুলিশের দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় ভবনের মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, গার্মেন্টস মালিক আমিনুল ইসলাম, ডেভিড মেয়র রেকো, আনিসুজ্জামান ও বজলুস সামাদ আদনাকে। রাজউকের দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক এবং সাভার পৌরসভার সাবেক ৩ প্রকৌশলীকে।



মামলা দুটি দায়েরের পর প্রথমে তদন্ত শুরু করেন সাভার থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক কায়সার মাতুব্বর। এরপর মামলাটি ডিবিতে বদলী হয়। সেখানে মামলা দু’টি তদন্তের দায়িত্ব পান মীর শাহীন শাহ পারভেজ। এরপর মামলা দু’টি গত বছরের ১৫ মে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়।



ভবন ধসের ঘটনার চারদিন পরই ২৮ এপ্রিল যশোরের বেনাপোল থেকে ভবনের মালিক সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এর একদিন পর ২৯ এপ্রিল রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।



গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যে বিদেশি নাগরিক ডেভিড মেয়র রেকো ছাড়া অন্যরা আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। দুই মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি সাভার পৌরসভার মেয়র রেফাত উল্লাহ ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলীসহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন সময়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

 

আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে গত ১৩ মার্চ আদালতের নির্দেশে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার ব্যক্তিগত সব সম্পদ বায়েজাপ্ত করে সরকার।



রানা প্লাজা মামলার সরকারি কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর বাবুল  জানান, রানাকে গ্রেপ্তার করার সময় যে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছিল তা তদন্ত করে আগেই চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলা দু’টি বর্তমানে বিচারাধীন।  



উল্লেখ্য, গত বছরের ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়। এতে ভবনটির চারতলা পর্যন্ত বিভিন্ন অফিস ও দোকান মালিক কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। তবে পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো গুরুত্বই দেয়নি।



পরে ২৪ এপ্রিল সকালে পোশাক শ্রমিকরা কারখানায় কাজ শুরু করার পরপরই ঘটে পৃথিবীর ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!