DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

এবি সিদ্দিক অপহরণঃ ঘটনার বাঁকে বাঁকে রহস্য, ৪ দিনেও মেলেনি কোনো ক্লু

image_87353_0দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহরণ ঘটনার যেসব তথ্য ও বর্ণনা দিচ্ছেন তা নিয়ে তদন্ত কাজ চালাচ্ছে পুলিশের বিশেষ অনুসন্ধান দল। একই সঙ্গে রিজওয়ানা হাসানের দেয়া সন্দেহের তথ্যগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
 
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবু বকর সিদ্দিক এবং রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যে অনেক অসম্পূর্ণতা থাকলেও তাদের দেয়া তথ্য ও ধারণার ভিত্তিতেই কাজ করা হচ্ছে। তবে রোববার পর্যন্ত ঘটনার কোনো রহস্য উন্মোচিত করতে পারেনি তারা। মিলেনি সহায়ক কোনো আলামত। উল্টো পুলিশ, গণমাধ্যম ও স্বজনদের কাছে আবু বকর সিদ্দিক ৩৫ ঘণ্টা অপহৃত থাকার ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ছে।

আটক রাখার স্থানটি কোথায় ছিল তা সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে আবু বকর জানিয়েছেন, অপহরণের পর তাকে যে বাসায় নিয়ে রাখা হয়েছিল ওই বাসার ওপর দিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছেন। বুধবার ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে তিনি হেলিকপ্টার চলাচলের শব্দ পান বলে জোরালো দাবি করেছেন।

এ প্রসঙ্গে তদন্ত সংশ্লিরা বলছেন, রাজধানীসহ সারাদেশে হেলিকপ্টারের ব্যবহার সীমিত। সেক্ষেত্রে পরপর দু’দিন একই সময়ে একই স্থান থেকে হেলিকপ্টারের শব্দ শোনার সম্ভবনা কম। তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় যাচাই চলছে। তবে চোঁখ বাধা অবস্থায় তিনি সকাল-সন্ধ্যা কীভাবে নির্ধারণ করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে দু’দফা ফেরি পারাপার, মাইক্রোবাস বদলসহ বিভিন্ন সময় বর্ণনার ’সত্যতা’ নিয়ে তদন্তকারীরা সন্দীহান।

পুলিশ সদর দপ্তরের অনুসন্ধান কমিটির প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশানার শেখ মারুফ হাসান  বলেন, ‘আবু বকর অপহরণে জড়িতদের সম্পর্কে এখনো কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি খুবই রহস্যজনক। মোটিভ, আলামত ও সন্দেহ- এ তিনটি বিষকে প্রধান্য দিয়ে অপহরণ ঘটনার তদন্ত চলছে। বিশেষ করে কারা, কেন এবং কীভাবে, কী উদ্দেশ্যে আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করেছে তা বের করাই মূখ্য বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘রিজওয়ানা ও তার স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই বাছই করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন ও আসামিদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে।’

র‌্যাবের আইন ও মিডিয়া উইং পরিচালক এম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘র‌্যাব শুরু থেকেই চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছে। সারাদেশে র‌্যাবের একাধিক টিম আবু বকরকে অপহরণে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে তৎপর। তবে মূল তদন্ত করছে পুলিশ। র‌্যাব তদন্ত সহায়ক হিসেবে যা করণীয় তা করছে।’

এদিকে আবু বকর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাকে আটকে রাখার জায়গাটি অনেকটা বাংলোর মতো এবং গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি গেট দিয়ে ঢোকার পর কিছু সময় হাঁটিয়ে তাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কক্ষের পাশেই আরেকটি কক্ষ ছিল। যেটিতে কার্পেট বিছানো এবং চেয়ার টেবিল ছিল। রাতে তিনি কার্পেটের ওপরই ঘুমিয়েছিলেন। ওই কক্ষ তিনজন পাহারা দিতেন এবং প্রহরীরা তাকে মামা সম্বোধনে আপনি করে কথা বলতেন। ওই বাসায় আগেও আরো অনেক ব্যক্তিকে আটকে রাখা হয়েছে বলে তিন প্রহরী তাকে বলেছেন।

এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন চোঁখ বাধা অবস্থায় আবু বকর কীভাবে বুঝলেন ওই বাসায় কয়টি কক্ষ এবং সেখানে কী কী আছে। এমনকি প্রহরীদের সংখ্যা বোঝাও সম্ভব নয়। অপহরণকারীদের নিযুক্ত প্রহরীরা তাকে ’মামা’ সম্বোধন করে তাদের আগের অপহরণসহ অন্য অপরাধ সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে দেবে তাও বিশ্বাস করা কঠিন।

গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক আরো জানান, অপহরণকারীরা সবাই অনেক স্মার্ট। যা তাদের আচরণ ও কথাবার্তায় বুঝেছেন। অপহরণের দিন সন্ধ্যায় তাকে যখন ঘরে আটকে রাখা হয় তখন দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল। তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে জানিয়ে অপহরণকারীদের তিনি বলেছেন কয়েকটি ওষুধের নাম। কো-ডায়োভ্যান নামের দামি ওষুধটি না দিলেও অন্যগুলো এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করে দিয়েছে অপহরণকারীরা। রাতে ও দুপুরে তাকে মাংস ও ডাল দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছে। সকালে পাউরুটি-কলা নাস্তা খাইয়েছে। অপহরণকারীরা তিনটি গামছা ভাঁজ করে তাকে কার্পেটে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। রাতে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। কিন্তু চোখের বাঁধন ওরা খুলে দেয়নি।
 
সিদ্দিক আরো জানিয়েছেন, তাকে পাহারা দেয়া তিনজনের নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিন্তু কেউ নাম বলেনি। একজনের ভাষায় চিটাগাংয়ের আঞ্চলিকতার টান ছিল। পরে জিজ্ঞেস করলে সে তার বাড়ি চিটাগাং বলে স্বীকার করে।

অপহরণ ঘটনার বর্ণনায় এবি সিদ্দিক আরো জানান, অপহরণকারীরা তাকে গাড়িতে তুলে দুটি ফেরি পার হয়েছিল। প্রথম ফেরি পার হওয়ার পর তার গাড়িটি পরিবর্তন করা হয়। এ সময় তাকে কয়েকজনে ধরে অপর একটি গাড়িতে তোলে। তার ধারণা, নতুন গাড়িতে তুলে অপহরণকারীরা তাকে আবার ফেরি পার করে ঢাকার দিকে নিয়ে আসে। আটকে রাখার স্থানটিতে পৌঁছতে গাড়িটি নিচু থেকে উঁচুতে উঠেছে। অপহরণ পরবর্তী বাংলোয় আটকে রাখা পর্যন্ত গাড়িটি তিনঘণ্টা চলেছে বলে সিদ্দিক ধারণা দিয়েছেন। আর বন্দীদশা থেকে মিরপুরে ছেড়ে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা গাড়ি চলেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

স্বামী অপহরণ ও উদ্ধার নিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রোববার জানান, বিষয়টি এখনো তার কাছে রহস্য মনে হচ্ছে। তার ধারণা, অপহরণ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন তারা কেউই আবু বকরের শক্রু নয়। মূলত তার (রিজওয়ানা) কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ ঘটনা ঘটাতে পারে। তবে তিনি এ বিষয়ে সুর্নিদষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন না। গত বুধবার স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহৃত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রতিদিনই কিছু নতুন তথ্য যোগ করছেন। যাতে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নানান ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে।

ঘটনায় বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরে গঠিত পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি এখনো ঘটনার ক্লু খুঁজতে নানা চেষ্টা করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মুহম্মদ মারুফ হাসানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে রয়েছেন ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম, র‌্যাব ১১-এর মেজর সাদেকুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান ও পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান।

গত চারদিনে এ কমিটি ঘটনাস্থানগুলো ঘুরে দেখা, মামলার বাদী, অপহৃত ও অটোরিকশা চালকসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে কাজ এগিয়ে নিলেও রহস্য উদঘাটনের কোনো পথ বের করতে পারেনি বলে জানিয়েছে সূত্র।

রিজওয়ানা এবং তার স্বামীর সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শত্রুতা রয়েছে এমন কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকাও করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। খুলনায় নীল রঙের একটি হায়েস মাইক্রোবাস আটক করা হলেও এ ঘটনায় গাড়িটির সংশ্লিষ্টতা এখনো মেলেনি।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম  বলেন, ‘তদন্তে এখন পর্যন্ত বলার মতো কোন তথ্যই মেলেনি। তবে সন্দেহ হয় এমন সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’  

নিরাপত্তাহীনতায় হাফিজুর:
বৃহস্পতিবার রাতে যে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে আবু বকর বাসায় ফিরছিলেন তার চালক হাফিজুর রহমান এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। পুলিশ ও আদালতের কাজ শেষ করে গিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। ঢাকায় ফিরে আবারও তিনি কাজে ফিরতে চান। এ অপহরণ ঘটনায় তিনি কোনো ঝামেলায় পড়বেন কি না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গতকাল তিনি সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, ‘কোন যাত্রী নেই। খালি গাড়ি। কী করব ভাবছিলাম। মিরপুর ১৩ নম্বর থেকে খালি গাড়ি টেনে কাজীপাড়া-শ্যাওড়া পাড়ার মাঝামাঝি চলে আসি। সামনে আগাতেই এক ভদ্রলোক রিকশা থেকে আমাকে থামতে বলে। তখন ভদ্রলোককে অসুস্থ ও তটস্থ লাগছিল। আমি মনে করি, ওনি হাসপাতালে যাবেন। আমি বলি, কোথায় যাবেন। ওনি সেন্ট্রাল রোডে যাওয়ার কথা বলে রিকশা থেকে নেমে পড়েন। আর কোন কথা না বাড়িয়ে আমি তাকে গাড়িতে উঠতে বলি।’

হাফিজুর বলেন, ‘তাকিয়ে দেখি তার পা খালি। গায়ের পোশাক পুরাতন। হাতে একটা গামছা। এরকম অবস্থায় একজন যাত্রী পেয়ে আমিও কিছুটা চমকে যাই। ওনি গাড়িতে উঠার পর আমি তাকে বলি, আপনার এ অবস্থা কেন? মনে হলো উনি, আমার কথায় কিছুটা বিরক্ত। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওনার গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা দেই। তাকে নিয়ে আমি আগারগাঁও বিজয় স্বরণী হয়ে কলাবাগান এলাকায় আসতেই সামনে চোকপোস্টে আটকায় পুলিশ। ভেতর থেকে পুলিশ উনাকে নামতে বলে। উনি হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠেন। বলেন, আমি “সিদ্দিক”। পুলিশ বলে- কোন সিদ্দিক? তিনি বলেন- গত ১৬ তারিখে আমাকে “কিডনাফ” করা হয়। এ সময় আমি পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনতে পাই। এর মধ্যে পুলিশের একটি পিকআপ এসে সেখানে থামে। উনাকেসহ আমার গাড়িটি থানায় নিয়ে যায়।’
 
হাফিজুর রহমান  আরো বলেন, ‘একজন বিপদগ্রস্থ মানুষকে উপকার করে নিজেকেও ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ আমার গাড়ি আটকে রেখেছিল, তা নিয়ে কষ্ট পেয়েছি। আমাকে আদালতে নেয়া হয়েছিল, সেখানে সব বলেছি। এভাবে দুইদিন আমার এই কাজে সময় দিতে হয়। শনিবার রাতে গাড়ির প্রকৃত মালিককে সঙ্গে নিয়ে থানায় যাই। এরপর কাগজপত্র দেখিয়ে গাড়িটি ছাড়িয়ে মালিককে বুঝিয়ে দিয়েছি।’

চুয়াডাঙ্গার হাফিজুর রহমান ঢাকায় আদাবর এলাকায় থাকেন। দুই সন্তানের জনক তিনি। তিনি এ ঘটনায় কোনো ’ঝামেলায়’ পড়বেন কি না তা জানতে চান প্রতিবেদকের কাছে। ঘটনায় জড়িয়ে এখন তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও জানান।

রহস্য উদ্ঘাটন নিয়ে শঙ্কা:
বিশ্লেষকরা বলছেন, তথ্য সংক্রান্ত অসঙ্গতি এবং অস্পষ্টতার কারণে এ চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হবে না বলে ধারণা তাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়াউর রহমান  বলেন, ‘এ ঘটনার রহস্য কখনো উদঘাটন হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা যে প্রভাবশালী সেটা ঘটনা বিশ্লেষণে স্পষ্ট বোঝা যায়। অপরাধীদের হাত অনেক লম্বা। সেক্ষেত্রে ভয় পেয়ে বা অন্য কারণে বিষয়টি নিয়ে ভিকটিম পরিবার চুপসে গেলে আরো ক্ষতির কারণ হবে।’

তিনি বলেন, ‘রিজওয়ানা স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত। সেক্ষেত্রে “প্রকৃত সত্য” যদি তিনি অবগত হন, তবে তা প্রকাশ করে দেয়া হবে সমীচিন।’ এমনটি মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট আরো অনেকেই।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!