DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরিতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা!

9736দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৩ বছর পর সরকারি চাকরিজীবীদের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর সুবিধা নিতে জালিয়াতির মাধ্যমে এসব সনদ নেওয়া হচ্ছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে সরকারি চাকরিতে সুবিধা গ্রহণের অভিযোগে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে তলব  করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনেকের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। বাকিদের বিষয়ে তদন্ত চলছে।

সূত্রমতে, সনদধারীদের মধ্যে চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়েছে এমন সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। অবসরের মুর্হূতে এ ধরনের সনদ নেওয়া অনৈতিক হওয়ায় এসব সনদ ভুয়া কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়ম অনুযায়ী, কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে চাকরিতে যোগদানের সময়ই তাকে ঘোষণা দিতে হবে। পরে বললে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম পুরোপুরি কার্যকর হওয়া উচিত।

 

২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণ করে সরকার। এর আগে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁদের অবসরের বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়েছিল। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের হিড়িক পড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে।

 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী,  গত পাঁচ বছরে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন  পেশার  মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন।

 

আর অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারী তাঁদের সনদ প্রত্যয়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার সনদে গলদ পাওয়ায় মন্ত্রণালয় সেগুলো প্রত্যয়ন করেনি। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এক হাজার ৬৬৮ জনের সনদে গলদ ধরা পড়ে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫২ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ সঠিক নয় বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে চারজন সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন সাবেক সচিবের সনদ তদন্ত করে দেখছে দুদক। যাদের সনদ প্রাথমিকভাবে ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সুবিধা ভোগ করতে এ রকমের অনৈতিক প্রক্রিয়ায় আরো সনদ নিয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী ও ব্যাংকারসহ বিভিন্ন শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তারা।

 

মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে কেলেঙ্কারি

 

২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর আদেশ জারি করার পর এ সুবিধা নেওয়ার জন্য অনেকেই নানা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সনদ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই যে কোনো একটি মানদন্ডের ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

 

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত চারটি মানদ- হচ্ছে :  যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাঁদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ গ্রহণ করেছেন।

 

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন সচিবের নাম অন্তর্ভুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধা গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ওই সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের নামও রয়েছে। বর্তমানে তিনি প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান।

 

এছাড়া গেজেটে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব এ কে এম আমির  হোসেন, প্রবাসী কল্যাণ ও  বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব (সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব)  ড. খোন্দকার শওকত হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদারের নাম রয়েছে।

 

অভিযোগ উঠেছে, এই কর্মকর্তাদের অধিকাংশই চার মানদন্ডের আওতায় পড়েননি। চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও ঘোষণা করেন নি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের নথিপত্র তলব করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

 

উল্লেখ্য, মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান তিন বছর আগেই অবসরে গেছেন। এরপর তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও  পেয়েছেন। ১১ জানুয়ারি তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। চুক্তির মেয়াদ আবার বাড়িয়ে এবার তাঁকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

 

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেন তিনি। অপরদিকে গত বছরের ১৭ নভেম্বর স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞাকে মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তিনি এ বছরের ৩০ ডিসেম্বর অবসরোত্তর ছুটিতে যাবেন। চাকরিতে যোগদানের সময় না বললেও মেয়াদের শেষ সময়ে এসে জানালেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

 

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিয়াজ উদ্দিন মিঞা সচিব পরিচয় না দিয়ে আবেদন করেছিলেন। গাজীপুরের সংসদ সদস্য ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম  মোজাম্মেল হক এতে সুপারিশ করেছিলেন।

 

অতীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকায় নাম না থাকলেও সনদ নিয়েছেন খোদ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী।

 

আগামী বছর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চাকরিতে বহাল থাকতে সনদ নিয়েছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব আমির  হোসেন।

 

গত ১৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম এসেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আবুল কাসেমের। অভিযোগ উঠেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আবুল কাসেমের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে নয় বছর। এই অভিযোগের ব্যাপারে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ  থেকে তদন্ত চলছে বলে জানা  গেছে।

 

প্রবাসী কল্যাণ সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ ছাড়াও ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে দুদক তার বিরুদ্ধে একটি ফাইল তৈরি করেছে। তাকে দুদকে গিয়ে হাজিরাও দিয়ে আসতে হয়েছে।

 

নানা কারণে আলোচিত তোজাম্মেল

 

তোজাম্মেল হোসেন খান। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস ম্যানেজার। বিভিন্ন কারণে সহকর্মীদের কাছে বহুল আলোচিত। ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরির বয়স বাড়ানো, পেশাগত অসদাচরণ, সহকর্মীদের সঙ্গে একাধিকবার দুর্ব্যবহারের কারণেই তিনি আলোচিত-সমালোচিত।

 

রহস্যজনক কারণে কোন অভিযোগই এই দাপুটে কর্মকর্তাকে টলাতে পারেনি বলে জানান তার একাধিক সহকর্মী। তবে এই কর্মকর্তার খুঁটির জোর সম্পর্কে কেউ অবহিত নন।

 

এই সুচতুর কর্মকর্তার শিক্ষাগত সার্টিফিকেট অনুযায়ী চাকরির মেয়াদ ২০১২ সালে তার বয়স ৫৯ বছর। সে অনুযায়ী চাকরির মেয়াদও শেষ হওয়ার কথা। এরপর নিয়ম অনুযায়ী তিনি অবসরে যাবেন। কিন্তু চাকরির শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ জমা না দিলেও শেষ বছরে মুক্তিযোদ্ধার সনদ হাজির করেন তিনি। মুহূর্তেই বনে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেই সুবাদে বাড়তি দুই বছর চাকরি করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ায় বিমানে তোলপাড় শুরু হয়। জানা গেছে, তোজাম্মেলের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায় হলেও তিনি পটুয়াখালীতে যুদ্ধ করেন বলে দাবি করেছেন।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সনদ আগে দেখাননি কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে তো বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াবো না। যখন দেখানোর প্রয়োজন তখনই দেখানো হয়েছে।‘

 

তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা তা আত্মীয়-স্বজনরা জানেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে জানতো না। এখন অনেকেই জানে।’ এ বিষয়ে আর কোন কথা বলতে চাননি তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে পটুয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আবুল হোসেন জানান, ‘তোজাম্মেল হোসেন আমাদের সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে আমার জানা নেই। এমন তথ্য-প্রমাণও নেই। সুতরাং তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে না।’

 

চাকরি জীবনের শেষ সময়ে এভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া সন্দেহজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, চাকরির  শেষ সময়ে এসে কেন এসব ব্যক্তির মনে পড়ল তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এটা নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া কিছুই নয়।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত অনেকে ভুয়া সনদ দেখিয়ে অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে নিয়েছেন, অন্যদিকে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে অমুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-পুতিরা সরকারের বিভিন্ন স্তরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত চাকরিতে ঢুকছেন। এঁরা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য বরাদ্দ করা বিশেষ সুবিধা অবৈধভাবে ভোগ করছেন।

 

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান

 

চৌদ্দগ্রামের কেউ জানেন না এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান কখনো মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কিনা বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিনা। কিন্তু, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ ২ বছর বৃদ্ধি করার পর ওয়াহিদুর রহমান হঠাৎ করেই মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট যোগাড় করে নেন মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তিনি কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। শুধু তাই নয়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের বলে তিনি অবৈধভাবে অতিরিক্ত তিন বছর চাকরিও করেন।

 

ওয়াহিদুর রহমানের নিজের এলাকা চৌদ্দগ্রাম ও এর বাইরে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয় এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটকে কেন্দ্র করে। চৌদ্দগ্রাম এলাকার ১৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা তার সার্টিফিকেটকে ভুয়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে এই জালিয়াতির কারণে তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিতভাবে অভিযোগও করেন তারা।

 

অভিযোগে তারা বলেন, “চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ৫ নং শুভপুর ইউনিয়নের যশপুর গ্রামের মৃত আলী আজমের পুত্র ওয়াহিদুর রহমান একজন অ-মুক্তিযোদ্ধা। উক্ত ব্যক্তি ৭১ সালে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। দেশের অভ্যন্তরে বা ভারতীয় স্বীকৃত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়নি। ইহা আমরা হলফ করে বলতে পারি। গত ৩৯ বছর যাবৎ নিজেই মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেনি এবং কোনো পর্যায়ে তালিকাভুক্তির আবেদন করেনি। যেমন- ভারতীয় তালিকা, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত তালিকা, ১৯৯২ সালে প্রণীত ভোটার তালিকা কোনোটাতেই তার নাম অন্তর্ভুক্ত নাই। চৌদ্দগ্রাম থানার কোনো মুক্তিযোদ্ধা তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সে নিজ বাড়িতে অবস্থান করেছে, যা এলাকার জনগণ জিজ্ঞাসিত হলে প্রমাণ করবে।”

 

৩৩ জন সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা

 

মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি নেওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত ৩৩ জন সাব- রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছিলো।

 

পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু, চাকরিচ্যুতির আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হলে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। এরফলে তারা চাকরিতে বহাল আছেন।

 

এসব সাব রেজিস্ট্রাররা হলেন-মো. আব্দুর রশিদ মন্ডল-আখাউড়া, পারভীন আক্তার চান্দিনা, শিরীন চৌধুরী-নাগরপুর, সাবিনা ইয়াসমীন-তাড়াইল, খন্দকার নুরুল আমিন-নকলা, মো. নুরুদ্দিন মিয়া-কানাইঘাট, রফিকউদ্দিন-মৌলভীবাজার, সাইদুল ইসলাম-পতœীতলা, একেএম রফিকুল ইসলাম-জকিগঞ্জ, মো. জাহাঙ্গীর আলম- নওগাঁ, মো. আবদুল মতিন-জলঢাকা, মো. ইউসুফ আলী মিয়া- নীলফামারী, জাহিদুল ইসলাম-লক্ষ্মীপুর, একেএম ফয়েজউল্লাহ-চরফ্যাশন, হাফিজুর রহমান-নাজিরপুর, শাহ আবদুল আরিফ চৌধুরী-মধুখালী, মঞ্জুরুল ইসলাম-আমতলী, লুৎফর রহমান মোল্লা-তেরখাদা, মিজানুর রহমান-বিরল, মোহাম্মদ মোস্তফা-আনোয়ারা, ওমর ফারুক-খেপুপাড়া, সোহরাব হোসেন-শ্রীবরদী, মিনতী দাস-কালকিনী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল- দেলদুয়ার, খোন্দকার গোলাম কবীর-সুন্দরগঞ্জ, অসীম কল্লোল- গৌরনদী, আবদুল আজিজ চৌধুরী- পটিয়া, বোরহানউদ্দিন সরকার- দিরাই এবং ওসমান গনি মন্ডল-চিলমারী।

 

এ ছাড়া অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জেলা রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমান, সাব-রেজিস্ট্রার আ ব ম খায়রুজ্জামান, মমিনউদ্দিন মন্ডল, দাউদ শেখ, রফিকুল ইসলাম, শফি হাসানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। বর্তমানে এরা সবাই চাকরিতে বহাল আছেন। পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপীল) বিধিমালার ৩ডি(৩)(বি) বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আইনমন্ত্রণালয় থেকে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শেষ হয়েছে। এরপর শোকজ নোটিশের জবাবে সন্তুষ্ট না হলে তাদেরকে বরখাস্তের জন্য সুপারিশ করা হবে। এদিকে, দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাব রেজিস্ট্রার মমিনউদ্দিন মন্ডলের চূড়ান্ত শাস্তির সুপারিশ করে ফাইল আইনমন্ত্রণালয় থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) পাঠানো হয়েছে। পিএসসির অনুমোদনক্রমে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। এ ছাড়া মাগুরা সদরের সাব রেজিস্ট্রার সুব্রত কুমার দাসের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ২০১২ সালে বিভাগীয় মামলা করা হয়।

 

তদন্তের দায়িত্ব দুদকের হাতে

 

মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদধারীদের বিষয়ে অনুসন্ধানের নীতিগত সিদ্ধান্ত  নিয়েছে দুদক। সম্প্রতি দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. শাহাব উদ্দিন সাংবাদিকদের তা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সম্প্রতি  গেজেটে  প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি নাম নিয়ে গণমাধ্যম ও সরকারি মহলে তোলপাড় হচ্ছে। এঁদের মধ্যে কয়জন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা আর কয়জন ভুয়া, সেটা খতিয়ে দেখতেই দুদক বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত সূত্র জানায়, গত বছরের নভেম্বর  থেকেই বিভিন্ন সূত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। চাকরির  মেয়াদ বাড়াতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সরকারি কর্মকর্তারা অনিয়মের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেছেন বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সমালোচনা হয়েছে। সম্প্রতি ছয় সচিবের নথিপত্র তলব করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে দুদক চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে সচিবদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার আবেদনপত্র, প্রত্যয়নপত্র ও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করতে বলা হয়েছে।

 

সনদ দেওয়ার কার্যক্রম স্থগিত : তদন্ত করে ব্যবস্থা

 

সরকারি চাকরিতে সুবিধা নিতে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদধারীর সংখ্যা বাড়ায় সনদ  দেওয়ার কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করেছে সরকার। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও  ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

 

গত তিন বছরে এবং চাকরির শেষ সময়ে এসে যেসব সরকারি কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, সে বিষয়ে খতিয়ে দেখতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে  চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম  মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের কাছে প্রতিদিন সরকারি ও  বেসরকারিভাবে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। এ ছাড়া পত্র-পত্রিকায়ও বিষয়টি এসেছে। আমরা নিজেরাও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। তাই আমরা সনদ দেওয়া স্থগিত করেছি।’ তিনি বলেন, গত তিন বছরে যাঁরা সনদ নিয়েছেন এবং যাঁদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের সনদের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রথমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ বাতিল করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ  দেখিয়ে কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকলে তা  ফেরত  নেওয়া হবে। এরপর সনদ দিতে নতুন নীতিমালা করা হবে। পরে প্রয়োজন মনে করলে আবেদন যাচাই-বাছাই করে আবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ  দেওয়া হবে।

 

চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে কর্মকর্তাদের মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভুয়া সনদ নেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে  দেখতে  মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রীকে  প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশ দিয়েছেন।

 

সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় একজন নিরপেক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করবে। গত তিন বছরে যত সরকারি  গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, ওই কমিটি তা যাচাই-বাছাই করবে। এতে যাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে, তাঁদের সনদ বাতিলের পাশাপাশি সনদের কারণে পাওয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ফেরত নেওয়াসহ সরকারি  গেজেট বাতিল করা হবে। সরকারি কর্মকর্তা হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও অবসরে  গেলে ফৌজদারি ব্যবস্থা  নেওয়া হবে।  বেসরকারি ক্ষেত্রে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তা স্থানীয় পর্যায়ে খতিয়ে  দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য যাঁরা সুপারিশ করেছিলেন, প্রয়োজনে তাঁদের সঙ্গেও কথা বলা হবে। এসব কাজ শেষ করার পরই একটি নীতিমালা করা হবে এবং ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন করা হবে।

 

জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, যেসব ত্রুটি পাওয়া যাচ্ছে বা যাঁদের সনদ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাচাই করে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!