DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

জাতীয় নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন: ইইউ

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  বাংলাদেশের সাতই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা মনে করছে, এই নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের চর্চা নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য হলেও এ নির্বাচনে তা সীমিত ছিল।

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এই মূল্যায়ন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনবিশেষজ্ঞ মিশনের। গতকাল শুক্রবার প্রচারিত ইইউর ওই মিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে কিছু অংশীজনের মধ্যে আস্থার অভাব ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় ভোটাররা পুরোপুরিভাবে গণতান্ত্রিক অধিকারচর্চার সুযোগ পাননি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিজস্ব প্রক্রিয়া অর্থাৎ ‘নিজেদের’ প্রার্থী ও দলের ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের’ মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে ভোটারদের সত্যিকার অর্থে পছন্দের প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না।

ইইউর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৩৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন মূল্যায়নের পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন নিশ্চিত করতে ২১ দফার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওই পরামর্শগুলোর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাজের প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথাও বলেছে ইইউ নির্বাচনবিশেষজ্ঞরা।


উল্লেখ্য, গত বছরের জুলাই মাসে ইইউর একটি প্রাক্‌–নির্বাচনী মিশন বাংলাদেশ সফরে এসে নির্বাচনের সামগ্রিক সার্বিক পরিবেশ নিয়ে প্রায় শতাধিক বৈঠক করে অংশীজনদের সঙ্গে। তবে সেপ্টেম্বর মাসে নির্বাচন কমিশনকে ইইউ চিঠি লিখে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ মিশন পাঠানো হবে না। মূলত আর্থিক সংকটকে পূর্ণাঙ্গ মিশন না পাঠানোর কারণ হিসেবে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল।

তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের যথাযথ পরিবেশকে মূল কারণ হিসেবে দেখেছে ২৭টি দেশের জোট ইইউ। বিশেষ করে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া প্রাক্‌–নির্বাচনী মিশনের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে তেমন ইঙ্গিতই ছিল। পরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে চার সদস্যের কারিগরি দল পাঠায় ইইউ। নির্বাচনের আগে থেকে নির্বাচনের পর পর্যন্ত, ওই দলটি প্রায় দুই মাস বাংলাদেশে অবস্থান করে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে।

ইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি। সভা, সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন ও বক্তৃতাসহ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা সীমিত ছিল।

বিচারিক কার্যক্রম এবং গণগ্রেপ্তারের কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী ও দলের সঙ্গে যুক্ত ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের’ মধ্যে প্রতিযোগিতা ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার চর্চার সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো পরিবেশ না থাকায় গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অধিকারচর্চার সহায়ক পরিবেশ ছিল না, যা নাগরিক পরিসরে সমালোচনা, বিতর্কের চর্চা ও জবাবদিহি সীমিত করে দেয়।

ইইউ বলেছে, প্রাক্-নির্বাচনকালে বিরোধী দলের ধারাবাহিক বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। যে সমাবেশ পরবর্তী সময়ে রূপ নেয় সহিংসতায়। এর জের ধরে পরে বিএনপি ও জোটের নেতাদের গণগ্রেপ্তার ও আটকের ফলে দেশের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারচর্চার পরিবেশের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটে।

নির্বাচনের পুরো সময় বিরোধী দলগুলোর সভা, সমাবেশ, আন্দোলন এবং বক্তৃতার স্বাধীনতার চর্চা কঠোরভাবে সীমিত করা হয়। গ্রেপ্তার এড়িয়ে যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতা বিএনপির পক্ষে অসম্ভব ছিল; কারণ, দলের প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বকে কারাবন্দী করা হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে যাতে প্রতিহত করা না যায়, সে জন্য এই ফৌজদারি অভিযোগ গঠন ব্যাপকভাবে একটি কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক আচরণের জন্য মৌলিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার অপরিহার্য, যা বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বলা আছে। কিন্তু এই অধিকারগুলো ক্ষুণ্ন করা হয় আইন দ্বারা, যা অযথা বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।

ইইউ বলেছে, সামগ্রিকভাবে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নির্বাচনের দিন সহিংসতার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। ব্যালট বাক্স ভর্তি এবং জালিয়াতির চেষ্টাসহ নির্বাচন কমিশনে স্থানীয় প্রার্থীরা ভোটে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটির তাৎক্ষণিকভাবে সুরাহা করা হয়েছিল। ২৫টি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। তবে অন্যান্য ঘটনা অবহেলিত ছিল এবং পর্যাপ্তভাবে তদন্ত করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটের হার ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। এটাই সারা দেশে ব্যাপক বৈষম্যের চিত্র প্রদর্শন করে।

ইইউর নির্বাচনবিশেষজ্ঞরা তাঁদের প্রতিবেদনে ভবিষ্যতের স্বার্থে কিছু সুপারিশ করেছেন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২–সহ সংসদীয় সম্পর্কিত সমস্ত আইন, প্রবিধান এবং বিধিগুলোর একটি ব্যাপক পর্যালোচনা, যা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আইনি নিশ্চয়তা বাড়াতে পারে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!