DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা’ চাইলে মিলিটারির প্রস্তাব লুফে নিতাম -ড. মুহম্মদ ইউনূস

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউটিউবে ‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ টকশো-তে ‘মুখোমুখি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস’ অনুষ্ঠানের বক্তব্য দেশি বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ড. ইউনূসের বক্তব্যের পক্ষে শেয়ার, লাইক, কমেন্ট করা হয়েছে। তার বক্তব্য কার্যত টক অব দ্য কান্ট্রি। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব ইউনূসের ব্যবসা, ব্যাক্তিগত জীবন, মামলায় কারাদন্ড, বিশ্ব নেতা ও নোবেল লরিয়েটদের বিবৃতি এবং দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দেয়া তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমি যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চাইতাম তাহলে মিলিটারির প্রস্তাব লুফে নিতাম। ২০০৭ সালে মিলিটারি বাসায় এসে সারারাত বসে রইলো, রাষ্ট্র পরিচালনার ভার (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) নিতে রাজি হইনি। বাংলাদেশের কয়জন মানুষ বলবে, আমি সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করবো না? আমিতো করলাম সেটা। ‘ওয়ান ইলেভেন’ পরবর্তী ঘটনা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, যদি (রাষ্ট্র পরিচালনা করতে) চাইতাম, তাহলে যখন মিলিটারি আমার বাসায় এসে বসে রইলো সারারাত আমাকে রাজি করানোর জন্য, আমিতো লুফে নিতাম! রাজি করানোর জন্য বসে থাকতে হবে কেন! আমি যদি ক্ষমতা-ই চাইতাম তাহলে লূফে নিতাম। বলতাম, চলেন চলেন কি করতে হবে, কোন জামাটা পরতে হবে দেখিয়ে দেন, এখনই যাচ্ছি।

আমিতো সেটা করিনি। তাদের ( সেনা কর্মকর্তা) সাথে তর্ক করেছি। সারারাত ধরে তর্ক করেছি যে- না ভাই, আমাকে দিয়েন না। আমি এ কাজের জন্য উপযুক্ত না। আপনারা অন্য লক্ষ্যে যান। কিন্তু তারা আমার উপর মন ঠিক করে (তত্তাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে বসানো) ফেলেছে, আমাকেই নিতে হবে। আমিও বারবার বললাম তাদেরকে। শেষে তারা নিরাশ হয়েই ফিরে গেলো এই বলে যে সকাল বেলায় আবার আসবো। সকাল বেলায় আসলে তখন আপনি আমাদের বইলেন, আপনি রাজি আছেন।

আমি বললাম, না, সকাল বেলায় আসলে একই কথাই পাবেন। কারণ, এটাতো এমন কিছু না যে মনের মধ্যে সন্দেহ রেখে, দ্বন্দ্ব রেখে আপনাদেরকে বলছি। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই আপনাদের বলছি। না হলেতো আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যেতাম।

ড. ইউনূস সঞ্চালন খালেদ মুহিউদ্দীন পাল্টা প্রশ্ন করেন, কে ছাড়ে? দেশের, সরকারের প্রধান হওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছে আর রাজী হবে না। বাংলাদেশে এমন কয়জন মানুষ আছে যে বলবে- না, আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করবো না? আমিতো করলাম সেটা। এখন আমার নামে বলা হচ্ছে, আমি নাকি ১০ বছর চেয়েছি! বছর নিয়েতো প্রশ্নই উঠে না!

(তারা) প্রশ্ন করে যে, আগামীকাল সকাল বেলায় আপনি শপথ গ্রহণ করবেন? আমি বললাম, না করবো না। এরপরতো ১০ বছর…এই কান্ড… । আমি ১০ বছর দিয়ে করবো টা কি? আমিতো বলেছি, আমি এই কাজের জন্য নই। দেশ পরিচালনা করা আমার দায়িত্ব না, আমার কাজ না। আমি জানি না, এটা কিভাবে করতে হয়। আমি যেটা জানি, সেটা করি।

দেশে গণতন্ত্রের কথা মানুষ এখন মুখ খুলে বলতে পারছে না মন্তব্য করে আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি চারদিকে বিপদের মধ্যে আছি। এ অবস্থায় কথা না বলা নিজেকে রক্ষা করার একটা সুবিধা। যতো কথা কম বলা যায়, ততোই হয়তো ঝামেলার হাত থেকে বাঁচবো। ১২ তারিখে (ফেব্রুয়ারি) আমাদের অফিস দখল নিতে গেলো। আমরা পুলিশের কাছে গেলাম। পুলিশ বললো, আমরা এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবো না।

এ সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে দেশের সবাইকে এক কণ্ঠে কথা বলার আহ্বান জানান ড. ইউনূস। সঞ্চালক এই বক্তব্য ব্যখ্যা করার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, আমরা কেউই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে না এটা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আমরা সবাই গণতন্ত্রের পক্ষে, মানবাধিকারের পক্ষে, ন্যায়-নীতির পক্ষে। এগুলো না থাকলে জাতি হিসেবে আমরা টিকে থাকবো না। গণতন্ত্রের কথা সবাই এখন মুখ খুলে বলতে পারছে না।

বিভিন্ন সময় নিজেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক মন্তব্যের কারণ হিসেবে ড. ইউনূস বলেন, আমার মনে হয়, উনি মনে করেন যে আমি দেশের সর্বোচ্চ ডাকু, সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী; আমি সেরা চোর। উনি বলেন যে, আমি সুদখোর, আমি ঘুষখোর। এমনসব কটু শব্দ ব্যবহার করেন যাতে মনে হয় যে আমার সম্পর্কে তার ধারণা খুবই খারাপ।›
অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাছে জানতে চাওয়া হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস ও সামাজিক ব্যবসা পরিচালনার আমন্ত্রণ থাকলেও আপনি যাচ্ছেন না কেন? কেন বাংলাদেশে থাকছেন? জবাবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস বলেন, তুমি (সঞ্চালক) কি বলছো আমি দেশ থেকে চলে যাই? এমন কুসন্তান হলাম আমি যে আমাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে? আমি এই দেশের সন্তান, এই দেশেই থাকব।

সামাজিক ব্যবসা ও উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে ১২ থেকে ৩৫ বছরের জনগোষ্ঠীকে উৎসাহ দিয়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাদের জন্ম হয়েছে চাকরি করার জন্য না। আমরা সবাই উদ্যোক্তা। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ হচ্ছে বলে জানান। এমনকি খেলাধূলা নিয়েও বিশ্বের দেশে দেশে তার গবেষণা ও চিন্তা চেতনা কাজে লাগানো হচ্ছে বলে জানান।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমরা কেউ গণতন্ত্রের বিপক্ষে না, আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে, মানবাধিকারের পক্ষে, ন্যায়-নীতির পক্ষে। এগুলো না থাকলে তো জাতি হিসেবে আমরা টিকে থাকবো না। তবে বর্তমান সময়ে ভয়ভীতির কারণে মুখ খুলে মানুষ গণতন্ত্রের কথা বলতে পারছে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তাকে প্রতিদ্বন্দ্¦ি মনে করেন এবং তার উপর ক্ষুব্ধ কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মনে করেন, আমি দেশের সর্বোচ্চ ডাকু, সন্ত্রাসী কিংবা আমি অপরাধী, সেরা চোর। আমাকে বলেন আমি সুদখোর, ঘুসখোর।

ড. ইউনূস জানান তিনি কোনো কর ফাঁকি দেননি এবং তার বিরুদ্ধে কেউ আদালতে মামলাও করেনি। তিনি নিজেই ট্রাস্টিতে দান করা টাকার কর দিতে হবে কিনা তা জানতে আদালতে গেছেন। তিনি বলেন, আমার টাকা, আমি রোজগার করি, আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মালিক হবো না। যেহেতু আমি মালিক হবো না তাই আমি ট্রাস্টে দিয়ে দিতে চাচ্ছি। আমাদের আইনজীবী বলেছেন, আপনি যেহেতু দান করছেন, এটাতে আর কর দেওয়ার কোনো বিষয় নেই। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর দিতে বলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কর পরিশোধ করেছি।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, শুধু রোহিঙ্গ সংকট নয়, মিয়ানমারের বন্দুকের গুলি যখন গায়ের উপর লাগছে, ঘরের কাছে পড়ছে, এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। সীমান্তে সংঘাত ও রোহিঙ্গা সংকট একটা ব্যাপক বিষয়, বড় বিষয়। শুধু রোহিঙ্গা না, পুরো বার্মা বা পুরো মিয়ানমারই একটা জটিল জিনিস। বাংলাদেশের সীমান্তে বলে এটার জন্য আমরা বহুলভাবে সাফার করবো।

এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন ড. ইউনুস, বলেন, এখন থেকেই ঠিক করতে হবে, আমরা কিভাবে এটার নিষ্পত্তি করতে পারি। যারা পৃথিবীর বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণ করেন এগুলো সমাধানের জন্য তাদের সেই উদ্যোগটা আমাদের নিতে হবে। আমরা শুধু দর্শক হিসেবে থেকে গেলে হবে না। আমাদের একটিভ একশনে যেতে হবে। ঘরের কাছে এসে বন্দুকের গুলি যখন আমাদের গায়ের উপর লাগছে, আমাদের ঘরের কাছে পড়ছে, এটা খুব ভালো লক্ষণ না। কাজেই লক্ষণ থাকতে থাকতেই এটা সমাধানের জন্য যে পরিমাণ উদ্যোগের দরকার, সেই পরিমাণ উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে।

শতাধিক নোলেব বিজয়ীসহ দুই শতাধিক বিশ্ব নেতার বিবৃতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, তারা যা বলেছেন সে ব্যাপারে তারাই বলবেন। আমি তাদের বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!