DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

এস আলম সহ ১১বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কি অত্যাসন্ন?

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমনবিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ বাংলাদেশে বিভিন্ন মহলের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুক্ষিন হয়েছেন।

 বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তাকে বলেছেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশ থেকে অনেকে অর্থ পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। তারা আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তবে তা কার্যকর নয়।  দুর্নীতি দমনের আইন বাস্তবায়ন হয় না। সেইসঙ্গে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কণ্ঠস্বর দুর্বল। সামগ্রিক জবাবদিহি না থাকায় দুর্নীতি প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল।

ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমনবিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউর সঙ্গে বৈঠকে এসব মত দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো দুর্নীতি দমন নিয়ে আইন বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার এমনিতেই কমে যাবে।

রিচার্ড নেফিউ গতকাল সোমবার ব্যস্ত দিন পার করেছেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থনীতি ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি ও সুশীলদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে জড়িত ১১ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে বলে যে খবর বেরিয়েছে সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন,  দুর্নীতি দমনে নিষেধাজ্ঞা একটি অস্ত্র।

রোববার ঢাকা পৌঁছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। আজ মঙ্গলবার তাঁর ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, রিচার্ড নেফিউ বাংলাদেশ সফরে বুঝতে চেয়েছেন কীভাবে এখানে দুর্নীতি দমন ও অর্থ পাচার রোধ কার্যক্রম জোরদার করা যায়। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনে ও অর্থ পাচার রোধে কী ধরনের আইন রয়েছে। এতে রাষ্ট্র ও সরকার জনগণের কাছে কতটুকু জবাবদিহি করে। সুশীল সমাজ দুর্নীতি দমনে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে। তারা কতটুকু প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। বর্তমান ব্যবস্থায় সামগ্রিক জবাবদিহি কতটুকু আছে।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছেন রিচার্ড নেফিউ। তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো দুর্নীতির অর্থের এক প্রকার ‘সেফ হেভেন’ বা স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। দেশগুলোতে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করতে দেওয়া হয়। এসব দেশ তাদের দুর্নীতি দমন আইন কার্যকর ও বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের অর্ধেক দুর্নীতি নাই হয়ে যাবে।

বৈঠকের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সমকালকে বলেন, বৈঠকে বলেছি যে বাংলাদেশের দুর্নীতি বন্ধ করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ যুক্তরাষ্ট্র কেন আটকাতে পারছে না সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দুর্নীতির অর্থ দেশটির আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে, এটা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। দুর্নীতি রোধে যুক্তরাষ্ট্রের যে আইন রয়েছে, তা বাস্তবায়ন জোরদার করতে বলা হয়েছে।

গতকাল বিকেলে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে দুর্নীতি দমনে কাজ করছে, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার বাস্তবায়ন কীভাবে করা হচ্ছে, তা জানানো হয়েছে। এ ছাড়া দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কীভাবে সমন্বয় করে কাজ করে, তা জানানো হয়েছে। বিভিন্ন সময় আদালত থেকে দুর্নীতি রোধে বিভিন্ন নির্দেশনা আসে। সেগুলো কীভাবে প্রতিপালন করা হয়, তা রিচার্ড নেফিউর কাছে তুলে ধরা হয়েছে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুর্নীতি রোধে আন্তঃদেশীয় আইনি সহযোগিতা  বা মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেশগুলো থেকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমান সাড়া পায় না। দূতাবাসগুলো এ নিয়ে কাজ করে, তবে প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে সহযোগিতা করে না। কিছুদিন আগে সুইজারল্যান্ডে আমরা কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে সুইসরা তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ চায় সব দেশ যাতে এ বিষয়ে সহযোগিতা করে। অবৈধ অর্থ যেখানে জমা রয়েছে, সেখান থেকে যাতে আইনসিদ্ধ উপায়ে ফেরত নেওয়া যায়, সে বিষয়ে জাতিসংঘে অনেক দিন ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু এখনও কোনো উপসংহারে পৌঁছানো যায়নি। সুতরাং সবার সহযোগিতা না পেলে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে না।
আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে বড় বড় বিনিয়োগ গ্রহণ করার সময় ওইসিডির প্রকল্প ব্লু ডট থেকে যাচাই করে নিতে। আর্থিকভাবে, পরিবেশগত দিক থেকে প্রকল্পগুলো কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য, তা যাচাই করে নিতে তাদের তরফ থেকে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, অর্থ পাচার দুর্নীতির একটি অংশ। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ বলেছে, কিছু ছোট ছোট দেশ বা দ্বীপরাষ্ট্রে অনেক সহজে অর্থ পাচার করা যায়। হুন্ডি ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এগুলোর বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানো দরকার এবং একটি দেশ বা একটি সংস্থার পক্ষে শতভাগ সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। বৈঠকে সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে এ ধরনের ক্ষেত্রে বিচারহীনতা না থাকে। সব দেশেই এটি একটি সমস্যা।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশে প্রচুর প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং তাদের সক্ষমতাও রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেরত আনা অনেক পরের বিষয়। কোন পথে এগুলো গেছে বা এগুলোকে বন্ধ করা– এগুলোর সবই অবৈধ অর্থ নাও হতে পারে। কানাডার কথা প্রায়ই বলা হয়; মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক ডাক্তার বা প্রকৌশলী সেখানে বৈধ অর্থ পাঠায়। অনেকে রপ্তানির একটি অংশ সেখানে রেখে দেয়। বাংলাদেশে অনেকে তাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে অর্থ নিয়ে যায়। সব অর্থের উৎস অবৈধ বলা ঠিক হবে না। কিন্তু কীভাবে সেই অর্থ নেওয়া হয়েছে, তা যাচাই-বাছাইয়ের প্রশ্ন রয়েছে।

তিনি বলেন, তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ রয়েছে। অবৈধ অর্থের তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুব একটা সমস্যা নেই।

রিচার্ড নেফিউর সফর ঘিরে ১১ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। রিচার্ড নেফিউ নিজেই নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক কর্মকর্তা ছিলেন। কোনো ব্যক্তি বিশেষের কথা না বলে তিনি বলেছেন যে দুর্নীতি দমনে নিষেধাজ্ঞা একটি অস্ত্র। সুনির্দিষ্ট কোনো দেশ বা ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হয়নি।

এস আলমের অর্থ পাচার নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ নিয়ে তারা কোনো নির্দেশনা পাননি। দুদক তাদের অনুরোধ করলে আইনের মধ্য থেকে তারা কাজ করবেন।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!