এস এম মাঈন উদ্দিন (১৯ ডিসেম্বর ২০২১)
২০১৮ সালে “ডিজিটাল বাংলাদেশ”-এর ছায়ায় যাত্রা শুরু করা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ২০২১ সালে ভয়াবহ প্রতারণার অভিযোগে ধসে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন গ্রেপ্তার হন। লাখ লাখ গ্রাহক তাদের বিনিয়োগ হারিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ইভ্যালি কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে বড় প্রতারণার ঘটনায় পরিণত হয়।
ইভ্যালির উত্থান ও রাসেলের প্রতারণার ধরন
ইভ্যালি শুরু থেকেই অস্বাভাবিক ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করত—মোবাইল ফোন, মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজসহ নানা পণ্য ৫০–৭০% ছাড়ে। গ্রাহকদের আগাম অর্থ নিয়ে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব করত, কখনো কখনো মাসের পর মাস। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে আসে:
-
ইভ্যালির গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে দেনা: প্রায় ৫৫৭ কোটি টাকা
-
ব্যবসায়িক মডেল: নতুন গ্রাহকের টাকা দিয়ে পুরনো গ্রাহকের পণ্য সরবরাহ
-
অর্থ আত্মসাৎ: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা স্থানান্তর
আইনি পদক্ষেপ ও গ্রেপ্তার
-
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১: মোহাম্মদ রাসেল ও শামীমা নাসরিনকে ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার করে র্যাব।
-
অভিযোগ: অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, গ্রাহকের অর্থ ফেরত না দেওয়া
-
মামলার বাদী: সাদ স্যাম রহমান নামের এক গ্রাহক
-
অন্য আসামিরা: ইভ্যালির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আকাশ, আরিফ, তাহের, আবু তাইশ কায়েস
তারকাদের সম্পৃক্ততা ও জামিন
ইভ্যালির প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন জনপ্রিয় তারকারা:
| নাম | দায়িত্ব |
|---|---|
| তাহসান খান | শুভেচ্ছা দূত |
| রাফিয়াত রশিদ মিথিলা | ফেস অব ইভ্যালি লাইফস্টাইল |
| শবনম ফারিয়া | প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা |
-
৪ ডিসেম্বর ২০২১: তাহসান, মিথিলা ও ফারিয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়।
-
১৩ ডিসেম্বর ২০২১: তারা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পান।
ই-কমার্স খাতে আস্থার সংকট
ইভ্যালির ধসের পর আরও কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতারণার অভিযোগে আলোচনায় আসে:
-
ই-অরেঞ্জ
-
ধামাকা শপিং
-
সিরাজগঞ্জ শপ
-
Qcoom
এই প্রতিষ্ঠানগুলোও অগ্রিম অর্থ নিয়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হয়। ইভ্যালির কেলেঙ্কারি ই-কমার্স খাতে আস্থার সংকট তৈরি করে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও গ্রাহকদের ক্ষোভ
লাখ লাখ গ্রাহক সামাজিক মাধ্যমে #EvalyScam হ্যাশট্যাগে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেকে বলেন:
“আমার ৫০ হাজার টাকা আটকে আছে, কোনো উত্তর পাচ্ছি না।” “ইভ্যালি শুধু টাকা নিয়েছে, পণ্য দেয়নি। এখন রাসেল জেলে, আমরা পথে।”
বিভিন্ন শহরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়। গ্রাহকরা টাকা ফেরতের দাবিতে সরকারের হস্তক্ষেপ চান।
সরকারি তদন্ত ও সুপারিশ
-
বাংলাদেশ ব্যাংক: ইভ্যালির ব্যাংক হিসাব জব্দ করে
-
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়: ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে
-
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর: প্রতারণার প্রমাণ পায়
সরকার ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন করে, যেখানে:
-
Escrow Payment System চালু হয়
-
সেন্ট্রাল লজিস্টিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়
-
ই-কমার্স রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়
ইভ্যালি কেলেঙ্কারি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের পতন নয়, বরং এটি ডিজিটাল প্রতারণার এক ভয়াবহ উদাহরণ। অতি লোভ, অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক মডেল, এবং তারকাদের ব্যবহার করে জনগণের বিশ্বাস অর্জন—সব মিলিয়ে এটি ছিল পরিকল্পিত প্রতারণা। এই ঘটনার পর সরকার ই-কমার্স খাতে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে, তবে গ্রাহকদের ক্ষতি পূরণ এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া আস্থা ফিরবে না।


