DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

২৩শে জুন,পলাশী দিবস-রবার্ট ক্লাইভ ও মীর জাফর এবং আমাদের গ্লানি।

কর্নেল(অবঃ)মোহাম্মদ আবদুল হকঃ   ২৩ শে জুন দিবসটি সামনে আসলেই বুকে চিনচিন করে ব্যথা হয়। এ এমন একটি দিন যেদিন বলতে গেলে গোটা পাক-ভারত উপমহাদেশের বিশেষ করে মুসলমানদের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, দিনটি ছিল রবিবার, বিশ্বের খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের জন্য পবিত্র একটি দিন। এ দিনটি ছিল কেরাণী ক্লাইভের দিন, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিন, ইংরেজদের দিন, তিন হাজার সৈন্যের নিকট পুরো ভারতীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের দিন, মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম, নন্দকুমার, ইয়ার লাতিফ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণবল্লভের মতো বেঈমানদের দিন, মুসলমানদের লজ্জা ও গ্লাণির দিন এবং গোলামীর বন্ধনে আবদ্ধ হবার দিন।

২।  আর এর পেছনে যে দু’জন সবচেয়ে বেশি দায়ী তারা ছিলেন বৃটেনের রবার্ট ক্লাইভ ও বাংলার মীর জাফর। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘসময়ের গভীর বন্ধুত্ববোধের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করার অন্যতম হোতা ছিল এ ক্লাইভ। ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট ও বহুধা বিভক্ত এ ভূখন্ড মুসলিম শাসনের অধীনে এসে প্রায় একহাজার বছরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উন্নত সংস্কৃতির এক সুখী, সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। ১৭০৭ সালে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর উত্তরসূরীদের দুর্বলতার কারণে মাত্র চল্লিশ বছরে বিশাল সাম্রাজ্যে মুসলিম শাসন দুর্বল হতে থাকে এবং এ সুযোগে কট্টরপন্থী হিন্দু নেতৃত্ব শাসন ক্ষমতায় একটা পরিবর্তন চাচ্ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগায় সকল দেশীয় ও ইউরোপীয় ক্ষমতালোভী আধিপত্যবাদিরা। ব্যবসা-বানিজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে তারা দেশীয় ও ইউরোপের লোকদের সমন্বয়ে সৈন্যবাহিনী গঠন করে, যাকে ধীরে ধীরে শক্তিশালী করে ক্ষমতার দিকে হাত বাড়ায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরও ভাগ্য বদলে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। বাঙালি মুসলমানদের একটি দোষ হলো বিদেশী কাউকে দেখলে বা পেলে গদগদ হয়ে তার উপর হুমরি খেয়ে পড়ে। আর সাদা চামড়ার কেউ হলে তো কথাই নেই। তাদেরকে ত্রাতা হিসেবে মনে করে। আর এটাই ছিল মীর জাফরের মতো এ দেশিয় অসংখ্য্ মানুষের বড় দুর্বলতা। সাদা চামড়ার ইংরেজদের পেয়ে তাদের চাকরবৃত্তিকে তারা মুসলিম শাসকদের চেয়ে বেশি আকর্ষনীয় মনে করে।

৩। পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে রবার্ট ক্লাইভ একটি ঘৃণিত দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসীর নাম। ১৭২৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ক্লাইভ জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের একটি সাধারণ পরিবারে। বাবা রিচার্ড ক্লাইভ ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী। মা রেবেকা ক্লাইভ। তের ভাই-বোনের মধ্যে সে ছিল সর্বজ্যেষ্ট। শৈশব হতেই চরম উশৃংখল, বদ-স্বভাব, দুষ্টবুদ্ধি ও নানাবিধ অপকর্মের কারণে লেখাপড়ায় সুবিধা করতে না পেরে তার বাবার তদবিরে ১৭৪৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সামান্য কেরানি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিয়েই কোম্পানির ব্যবসার কাজে ভারতের মোম্বাই আগমন করেন। এখানে তিনি দু’বছর দোকানের হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করেন। দু’বছর পর এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৭৪৭ সালে ক্লাইভ কোম্পানির আর্মিতে নিম্নপদে যোগদান করেন। উচ্ছৃঙ্খল অফিসার হলেও তার মধ্যে ছিল দুষ্টবুদ্ধি ও শৌর্য্যর সমাহার। মাদ্রাজের সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখলের অভিযানে ফরাসিদের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল বীরত্ব ও সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে বিজয়ী হন। মারাঠা এক নেতার বিরুদ্ধে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় অভিযান চালিয়ে দেবীকোট দুর্গ অধিকার করেন। ১৭৫১ সালে ক্লাইভের পরবর্তী সামরিক তৎপরতা ছিল আর্কট অভিযান, এখানে তিনি সামরিক নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নবাবের দুর্গে অভিযান পরিচালনা করেন এবং কোনো প্রাণহানি ছাড়াই প্রতিপক্ষকে পালাতে বাধ্য করেন। এ সকল সফলতার পর ১৭৫৩ সালে তিনি বৃটেনে ফেরত যান। ভারতে ক্লাইভের বীরত্ব ও সাহসীকতা নজরে আসে কোম্পানি সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল স্ট্রিংগার লরেন্স ও বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট দা এল্ডারের এবং ইউরোপ জুড়ে তিনি বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। তার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল, “সামরিক প্রশিক্ষণ ব্যতিতই ক্লাইভ যে বিজয় এনে দিয়েছেন এ যেন ‘স্বর্গ প্রেরিত এক জেনারেল’।” ক্লাইভকে নানা সম্মানে ভুষিত করা হয়। কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স তাঁকে সম্মানিত করে এবং ‘জেনারেল ক্লাইভ’ নামে আখ্যায়িত করে তাঁকে রত্নখচিত তরবারি উপহার দেয়। এভাবেই উত্থান ঘটে ক্লাইভ নামক আন্তর্জাতিক এক সন্ত্রাসীর। অতি ধূর্ত, দুষ্টুবুদ্ধি, সাহসিকতা ও শৌর্যের সমন্বয়ে তাকে ক্রমাগত সম্মুখপানে এগিয়ে নিয়ে যায়। একসময় সে তার শহরের মেয়র, এমপি পদেও আসীন হন।

৪। মুসলিম জনগোষ্টির জন্য সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম সাম্রাজ্যসমূহে ইউরোপের আধিপত্যবাদিদের ছিল কুনজর। বাঁজ পাখির ন্যায় তারা ঘুরে ঘুরে মুসলমান শাসকদের দুর্বলতা গুলো পর্যবেক্ষণ করতো। আর সুযোগ মতো সেখানে থাঁবা বসিয়ে তা নিজেদের আয়ত্বাধীন করে ফেলতো। এমনটিই ঘটে ছিল বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের ক্ষেত্রে। ইউরোপের পর্তুগীজ, বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি, ফরাসী, ডাচ্, ডেনিস ইত্যাদি উপনিবেশবাদি শক্তি সমূহ মোগল সাম্রাজ্যকে মরা গরুর উপর শকুনের দলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া শুরু করলো। মুসলিম শাসকদের নির্লিপ্ততার সুযোগে বানিজ্য করার ছদ্মবেশে প্রবেশ করে স্থানীয় সহজ-সরল মানুষের ঘাড়ের উপর চেঁপে বসে তারা ধীরে ধীরে প্রভূত্ব ও আধিপত্য বিস্তার শুরু করলো। মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে বাংলা,বিহার, উড়িষ্যার ছিল বিশৃংখল অবস্থায়। এখানে মানুষ বিভিন্ন জাতি-গোষ্টিতে ছিল বহুধা বিভক্ত। কেন্দ্রীয় শাসন বলতে কিছুই ছিল না। ১৭৫৭ সালে মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলা,বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী। ১৭৫৬ সালের ১৬ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর মাত্র ২৩ বছর বয়সে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ক্ষমতায় বসেন। সিরাজের মা আমেনা বেগম ছিলেন আলীবর্দীর মেয়ে। আলীবর্দী তাঁর নাতিকে জন্মের পর হতেই নিজ তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলেন। ক্ষমতায় বসেই তিনি তাঁর নানার সাথে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে ক্ষমা করে দিয়ে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু এরপরও নবাবের সাথে তাঁর অধীনস্থ সেনাপতিগণ যে শতভাগ আনুগত্য পরায়ণ নন, তা তিনি ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন। এ সুযোগই গ্রহণ করে ক্লাইভ।

৫। ১৭৫৫ সালের জুলাই মাসে ক্লাইভকে সেন্ট ডেবিড ফোর্ট ও কুদালরের ডেপুটি গভর্ণর হিসেবে পুনরায় ভারতে পাঠানো হয়। এবারও তিনি বিভিন্ন অভিযান পরিচালনায় সাফল্য লাভ করেন। ১৭৫৬ সালের গোড়ার দিকে দু’টি দুঃসংবাদ আসে ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির জন্য। তা ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নব নিযুক্ত নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে কর্তৃক কোম্পানির কাশিমবাজার ও কোলকাতা দুর্গ পুনঃরুদ্ধার এবং প্রায় ৪০-৫০ জনের প্রাণহানি। এর প্রতিশোধ ও দুর্গ দু’টি পুনঃদখল করা জন্য এডমিরাল চার্লস ওয়াটসন ও ক্লাইভকে নির্দেশ দেয়া হলে তারা সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে অতি সহজেই তারা বাজবাজ দুর্গ দখল করে এবং ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭ সালে কলকাতা দখল করে। এ বিজয়ের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির মনোবল আকাশ চুম্বিরূপ ধারণ করে এবং এ দেশীয়দের সহজেই পরাজিত করার মনোভাব আরো শক্তিশালি হয়। ইতোমধ্যে ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্ণর পদে আসীন হন। দেশের মসনদ দখলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই তিনি পথের কাটা ফরাসীদের বিতাড়ন করেন। অতঃপর শেষ ও বড় শত্রু নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমত্চ্যূত করার পরিকল্পনা করেন। তিনি জানতে পারেন যে, নওয়াবের বিরুদ্ধে দরবারে একটা ষড়যন্ত্র চলছে এবং জগৎ শেঠ এ ষড়যন্ত্রের মূলনেতা। তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল ও দরবারের অসন্তুষ্ট অমাত্যদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের জন্য উমিচাঁদকে ব্যবহার করেন, যার ফলে ১৭৫৭ সালের ১৯ মে গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়। অভ্যুত্থানের নেতা নির্বাচিত করা হয় প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলীকে এবং রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম, নন্দকুমার, ইয়ার লাতিফ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণবল্লভের মতো প্রমূখ বেঈমানরা এর অন্তর্ভূক্ত হয়। মীর জাফরকে নবাবের আসনে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। বিনিময়ে ইংরেজদেরকে প্রায় বিশ লক্ষ পাউন্ড প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয় মীর জাফর। পরের ঘটনা সবার জানা।

৬। ষড়যন্ত্রের ছকানুযায়ী ২৩ শে জুন ১৭৫৭ সালে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভাগীরথি নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে মাত্র তিন ঘন্টার যুদ্ধে শুধু বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নয়, অস্তমিত হয় পুরো ভারতের স্বাধীনতার সূর্য। এ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বানিজ্যের জন্য আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বণে যায় প্রভূতে। এর ফলে শুধু ক্লাইভ নয়, ভাগ্যের চাঁকা ঘুরে যায় বৃটেনেরও। এ যেন হঠাৎ করে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হবারই বাস্তব উপাখ্যান। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ধন ভান্ডারের সর্বস্য লুটপাট করে ১৭৬০ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বৃটেনে ফিরে যায় ক্লাইভ। বিশাল সম্পদশালী ক্লাইভের সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা ও পদবী বহুগুণে বেড়ে ‘পিয়ার’, ‘ব্যারন অব পলাশী’, ‘কাউন্টি ক্লেয়ার’ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হন। এমনকি ঐতিহাসিক থমাস বেবিংটন ম্যাকাউলে তাকে ‘বৃটেনের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট’ উপাধি দিতেও কার্পণ্য করেননি। শুধু তাই নয়, এক সময়ের ছন্নছাড়া অভিজন শ্রেণির ব্যক্তিটি সাধারণ একজন দালাল ব্যবসায়ী হয়ে প্রতারণার মাধ্যমে একটি উপমহাদেশের মালিক বনে যায়।

৭। উগ্রস্বভাবের ক্লাইভ উচ্ছৃঙ্খলতার সাথে কুটবুদ্ধি ও শৌর্যের সমন্বয় ঘটায় ক্ষমতার দাপটে অন্ধ মুসলমান শাসকদের উপর সামরিক কর্তৃত্ব অর্জন করা তার জন্য ছিল অতি সহজ । তার চাতুর্য ও কুটকৌশল ইংরেজদের সাফল্যের পথকে যেমন সুগম করে, তেমনি নবাব সিরাজের পরাজয়কেও নিশ্চিত করে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ধন-সম্পদের বিশাল ভান্ডার ক্লাইভ ও তার সঙ্গী-সাথীরা লুট করে নেয়। ২৫ লক্ষ পাউন্ড তারা জমা দেয় বৃটিশ সরকারের কোষাগারে, ক্লাইভ নিজে নেয় ২,৩৪,০০০ পাউন্ড, মেজর ওয়াটস গ্রহণ করে ১,১৪,০০০ পাউন্ড। ফোর্ট উইলিয়ামের বাৎসরিক খাজনা আদায় করে ৩০,০০০ পাউন্ড। সে সময়ে বৃটেনের ধনীদের বাৎসরিক আয় ছিল মাত্র ৮০০ পাউন্ড। লুট করা বাংলার অর্থ-সম্পদের মাধ্যমে পাল্টে যায় বৃটেন ও এর জনগনের ভাগ্য। ১৭৬০ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ক্লাইভ নগদ ৩,৭০,০০০ পাউন্ড নিয়ে তার জন্মভূমিতে ফেরত যায়। এক সময়ের কেরানী হয়ে যায় বিশাল ধন-সম্পদের মালিক। এ তিন বছর বৃটেনে অবস্থান করেন তিনি। এ সময়ে নিজ শহরে আলীশান রাজপ্রাসাদ তৈরি করে এর নাম দেয় ‘পলাশী’। এরপর পুনরায় ক্লাইভকে পাঠানো হয় বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা ও লুন্ঠনের কার্যক্রমকে সুসংহত করার জন্য।

৮। সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার প্রশাসনে ব্যাপক ভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও এ দেশীয় আমলাদের মধ্যে যেন দুর্নীতি করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুন্ঠনের কারণে দরিদ্র কৃষক ও জনসাধারণের উপর গিয়ে পড়ে এর চাঁপ। হঠাৎ করে কর বাড়ানো হয় বিশ শতাংশ। তা আদায়ে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। দরিদ্র সীমার নীচে চলে যায় এ দেশের মানুষের অবস্থা। ব্যাপক অরাজকতা শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। বাংলায় লুটতরাজের অর্থ-সম্পদ এত বেশি ছিল যে রবার্ট ক্লাইভের বিরুদ্ধে বৃটিশ পার্লামেন্টে তদন্ত শুরু করে এবং সে একসময় আফিম ও নানা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। জীবনের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর ৪৯ বছর বয়সে নিজ বাসভবন ‘বেকারলি স্কোয়ারে’ বেশি মাত্রায় আফিমাসক্ত হয়ে কলমছুরি দিয়ে গলা কেটে আত্ম হত্যা করে। অপরদিকে বাংলার মীর জাফর ও অন্যান্য বেঈমানদেরও হয় করুণ পরিনতি, যা সবারই জানা।

৯। স্থায়ী প্রভাব: পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে এ উপমহাদেশে যে সকল স্থায়ী প্রভাব ও ক্ষতি সাধিত হয়, তার কয়েকটি হলো- (১) ইংরেজরা প্রথমেই এ দেশের মানুষকে বিভক্ত করে দুর্বল করার নীতি অবলম্বন করে। তাদের উস্কানিতে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে হাজার বছরের সম্প্রীতি-ভালবাসার অবসান ঘটে বা দুর্বল হয়ে পড়ে। (২) স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দুরা ইংরেজ শাসনকে স্বাগত জানায় এবং মুসলমানরা নিজেদের আভিজাত্যের কারণে ইংরেজদের ঘৃণা করা শুরু করে। ফলে এ দেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ে ইংরেজদের পক্ষে ও বিপক্ষে। (৩) বিশাল অঙ্কের কর বসানো হয় জনসাধারণের উপর। কৃষকেরা এ ভার সইতে না পেরে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে। কর আদায়ের জন্য চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন । (৪) কৃষকেরা উৎপাদন কাজে নিরৎসাহিত হয়ে পড়ে, অভাব-অনটন শুরু হয় ব্যাপক ভাবে, চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং ১৭৭৭ সালে বাংলা-বিহার- উড়িষ্যায় কঠিন দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। (৫) ধীরে ধীরে সারা ভারতে মুসলমানগণ ক্ষমতা হারাতে শুরু করেন। (৬) ইংরেজরা মুসলমানদেরকে তাদের প্রধান শত্রু ও পথের কাঁটা হিসেবে গণ্য করে। (৭) সারা ভারতবর্ষে হিন্দু ব্রাম্মন ও কায়স্থদের জমিদারিত্ব শুরু হয়। মুসলমান ও হিন্দু দলিত শ্রেণি পরিণত হয় তাদের প্রজায়। ফলে জমিদারদের অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হতে থাকে। (৮) ইংরেজ ও উগ্র হিন্দুবাদিত্বদের উস্কানিতে দফায় দফায় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা হতে থাকে এবং নিরীহ মুসলমানগণ হত্যার শিকার হতে থাকে। যা মুসলিম শাসনকালে কল্পনারও অতীত ছিল। (৯) মুসলমানরা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ার ফলে ধর্মীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে প্রচন্ড আঘাত আসে। বলতে গেলে ইসলামী আদর্শের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে তারা পঙ্গু জাতিতে পরিণত হয়। এমনকি নিজেদের মধ্যেও বিভিন্ন ফেরকার সৃষ্টি হয়ে প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বহু মুসলমান বিচ্যূত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন কুসংস্কার বদ্ধমুল হয়ে পড়ে তাদের ধর্মের সাথে এবং তাদের মধ্যে আন্তঃকলহ শুরু হয়। (১০) ধীরে ধীরে হিন্দু ও পশ্চিমা সংস্কৃতি মুসলমানদের গ্রাস করতে থাকে। (১১) বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের উপর বিপদ আপতিত হয় সর্বাধিক। বাংলা ভাষায় হিন্দু লেখকদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। তাদের সকল লেখা সাহিত্য, কবিতা, উপন্যাস রচিত হয় হিন্দু ধর্মের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে।ফলে মুসলমানদের তা দারুন ভাবে প্রভাবিত করে। একসময় হিন্দু ধর্মীয় আচার-আচরণকেই মুসলমানরা বাঙ্গালী সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করে। (১২) মুসলমানদেরকে দুর্বল করার জন্য ইংরেজরা তাদের ইচ্ছা মতো মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করে যেখানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করতো খ্রীষ্টান শিক্ষাবিদরা। (১৩) ইংরেজি শিক্ষা চালু হবার ফলে হিন্দুরা তা লুফে নেয় এবং মুসলমানগণ শিক্ষা-দীক্ষায় একেবারেই পিছিয়ে পড়ার ফলে সরকারি চাকরিতে হিন্দুরা প্রাধান্য পেতে থাকে এবং এক সময় মুসলমানগণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। (১৪) পৃথিবী খ্যাত মসলিন কাপড় তৈরির মুসলমান কারিগরদের নির্মম অত্যাচার করে হাতের আঙ্গুল কেটে দেয়া হয়, যাতে তারা আর মসলিন তৈরি করতে না পারে। (১৫) সারা ভারতে কৃষকদের নীল চাষ করার জন্য নির্মম নির্যাতন করা হতো এবং তাদের ন্যায্য মূল্য প্রদান করা হতো না। (১৬) এ দেশ থেকে বিদায় নেয়ার সময়ও ইংরেজ শাসকরা চিরস্থায়ী কিছু সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমন কাশ্মিরকে বিভক্তির ক্ষেত্রে অমিমাংশিত রাখা। ফলে এ নিয়ে পাকিস্তান ভারতের মধ্যে আজো যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান রয়েছে এবং লাখো লাখো মানুষ নিহত হচ্ছে। (১৭) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অংশ আসাম ও পশ্চিম দিনাজপুরকে ভারতের অংশ হিসেবে নির্ধারণ করা। (১৮) নেপাল-ভারত-চীনের মধ্যে সীমানা চূড়ান্ত না করার ফলে আজো দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ণে তা প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । (১৯) আজো ভারতে যে হারে মুসলিম নিধন করা হয় ও তাদের উপর নির্মম-নিষ্ঠুর-নৃশংস নির্যাতন করা হয় এ জন্য ইংরেজদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিছি দায়ী।
# পরিশেষে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বৃটেনের ক্লাইভ ও বাংলার মীরজাফরের কারণেই মুসলমান শাসকগণের কঠোর পরিশ্রমে সমৃদ্ধশালী একটি সাঁজানো- গোছানো, ভালবাসা ও শান্তির নীড় সমৃদ্ধশালী ভারতীয় উপমহাদেশ পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়, যা আজ আমাদের যত জন্য গ্লানি ও চিরস্থায়ী অশান্তির মূল কারণ।

লেখকঃ সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং সামরিক ইতিহাস বিশ্লেষক।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!