DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

শহীদ জিয়াকে কখনো হত্যা করা যাবে না।

আবু রুশদঃ  O Liberté, que de crimes on commet en ton nom! (Oh Liberty, what crimes are committed in thy name!)- স্বাধীনতা তোমার নামে কতই না অপরাধ সংঘটিত হয় : মাদাম রলাঁ।

ফরাসি বিপ্লবের একপর্যায়ে প্রতিবিপ্লবী হিসেবে তাকে ‘প্লাস দ্য লা রেভ্যুলুশন’ (পরে ‘প্লাস দ্য লা কনকর্দ’)-এ স্থাপিত গিলোটিনে মাথা কেটে হত্যা করা হয় ১৭৯৩ সালের ৮ নভেম্বর।

গিলোটিনের বেদিতে মাথা পেতে দেয়ার ঠিক আগে তিনি এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন উপস্থিত জনতার উদ্দেশে।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে। এই সময়টুকুতে বাংলাদেশ কোনো পরাধীন রাষ্ট্র ছিল না। এখনো নেই। রক্ত ঝরিয়েই স্বাধীনতা অর্জন করেছে এই দেশ। কিন্তু সেই স্বাধীন রাষ্ট্রেই ওই সময়টুকুতে নৃশংসভাবে নিহত হতে হয়েছে দুই মহীরূহকে।

তাদেরই অনুগ্রহভাজন ব্যক্তিরা রাতের আঁধারে হত্যা করেছে স্বাধীনতা অর্জনের পথিকৃৎ মহান দুই নেতাকে। মাদাম রলাঁর উক্তিটি কি এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে?

জানি না। তবে রক্তপাতকে মেনে নেয়া যায় না কোনোভাবেই। গিলোটিন তাও সহ্য করা যায়, কিন্তু বুলেটে ঝাঁঝড়া হওয়া রাষ্ট্রপতির লাশ স্বাধীনতার চেতনাকেই ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।

১৯৮১ সালের পর দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আবারো ৩০ মে চলে গেল নীরবে। বিএনপি নামে দলটির কিছু গৎবাঁধা অনুষ্ঠান ছাড়া বৃহৎ পরিসরে আর কিছু হয়নি। বরং রাষ্ট্র যেন তাকে ভুলেই গেছে।

তবে জিয়া নামটি ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ মুছে যায়নি, যাবেও না। মহান মানুষদের নিয়ে বেশি লেখার প্রয়োজন নেই। তাদের নিয়ে কে কী কটু কথা বলল তাতেও কিছু যায় আসে না। পাহাড়ের গায়ে মশা কামড় দিলেই কী না দিলেই বা কী আসে যায়?

বঙ্গবন্ধুকে হেয় করলে জিয়াকে বড় করা হয় না। জিয়াকে নিয়ে কটূক্তি করলে বঙ্গবন্ধুকে আরো ওপরে উঠানো যায় না। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পৈতৃক সম্পত্তি নন। শহীদ জিয়া নন বিএনপির একক নেতা। এরা পুরো জাতির সম্পত্তি, জাতীয় নেতা।

কেউ মানুন, আর না মানুন। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে তাই জিয়াকে নিয়ে যাচ্ছেতাই বলা সহজ। এর জন্য কোনো মামলা হবে না। কাউকে গ্রেফতারবরণ করতে হবে না।

জিয়া যেহেতু রাজনীতিতে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, তাই তাকে নিয়ে সমালোচনা হবেই। মহাত্মা গান্ধীকে নিয়েও ভারতে বহু সমালোচনা হয়, বের হয়েছে অগণিত বই। নাথুরাম গডসে গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। জেলখানায় বসে তিনি লিখেছিলেন কেন তিনি গান্ধীকে হত্যা করেছেন। তার লেখা বইটি ভারতের সব ভাষাতে অনূদিত হয়েছে। বাংলায় অনূদিত বইটির শিরোনাম ‘শুনুন ধর্মাবতার’।

যারা বিখ্যাত, যাদের হাতে ইতিহাস রচিত হয়েছে তাদের নিয়েই তো কথা হবে, লেখা হবে, সমালোচনা হবে। যদু-মধুদের নিয়ে নয়। মুজিব ও জিয়াকে নিয়ে যারা সমালোচনা করেন তারা হয়তো এটা ভুলে যান। ইতিহাসে নাথুরাম গডসের অবস্থান কোথায় আর মহাত্মা গান্ধীর ইমেজ কোন পর্যায়ে?

জেনারেল জিয়াউর রহমান বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেননি। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে প্রিয় সহকর্মীদের হাতে। তার মৃত্যু নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে।

সরকারি শ্বেতপত্রে চট্টগ্রামের তদানীন্তন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তমকে বিদ্রোহের মূল নেতা ও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পক বলা হলেও তার সত্যতা নিয়ে আজো সন্দেহের অবসান হয়নি।

জিয়া যখন নিহত হন, তখন আমাদের প্রজন্মের বয়স বড়জোড় ১৪-১৮ বছর। এদের কেউই আদর্শগত দিক দিয়ে গভীর চিন্তা করার উপযুক্ত ছিলেন না।

আমিও তাদের একজন। ১৯৮১ সালে রংপুর ক্যাডেট কলেজে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় বেড়াতে এসেছি নানার বাসায়। এসেই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছি ছোট মামার মাসুদ রানা কালেকশন, নয়তো দিনভর ঘুরে বেড়াচ্ছি শহরের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত। এয়ারকন্ডিশন্ড মধুমিতা ও আনন্দ সিনেমায় গিয়ে দেখছি হলিউডের ইংরেজি ছবি।

ক্যাডেট কলেজের বদ্ধপ্রাচীর থেকে মুক্তবাতাসে নিশ্বাস নেয়ার মজাই আলাদা। অমনি একদিন নানার সাথে গিয়েছি মিরপুর বাজারে, ৩০ মে তারিখে। হঠাৎ চার দিকে শোরগোল। দোকানদারদের মধ্যে ছুটোছুটি। জানা গেল প্রেসিডেন্ট জিয়া বিদ্রোহী একদল সেনাকর্মকর্তার হাতে নিহত হয়েছেন।

আমার বয়স তখন পনেরো বছর। কী-ই বা বুঝি রাষ্ট্রযন্ত্রের। ওসবে কি মাথা ঘামায় টিনএজাররা? কিন্তু অবাক করা ব্যাপার; দুই চোখ বেয়ে যে পানি গড়িয়ে পড়ছে! মনে পড়ছে জেনারেল জিয়াকে দেখার ঘটনা। রংপুর ক্যাডেট কলেজ তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ওটি ছিল রংপুর রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল।

১৯৭৬ সালে নানা অবসরে যাওয়ার পর কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক পিতা আমাকে ঢাকা থেকে রংপুর নিয়ে যান। ভর্তি করে দেন রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে। সে সময় দ্রুত সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ হচ্ছিল। কিন্তু তাদের ব্যারাক সে অনুপাতে নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় আমাদের স্কুল পরিণত হয় মিনি ক্যান্টনমেন্টে।

৩ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন এসে আস্তানা গেড়ে বসে আমাদের ছাত্রাবাস ও একাডেমিক বিল্ডিংয়ের একাংশে (আমি পরে ওই ৩ সিগন্যাল ব্যাটালিয়নে কমিশন পাই ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে)। একদিন সকালে দেখলাম আমাদের প্রিন্সিপালসহ শিক্ষকেরা সব মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের কাসে চুপচাপ বসে থাকতে বললেন। আশপাশ দ্রুত পরিষ্কার করা হলো। জানতে পারলাম সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া আসছেন সাময়িক (Makeshift) সেনানিবাস পরিদর্শনে।

দুপুরের দিকে আমরা জানালা দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখলাম সৈনিকদের মহড়া। দেখলাম ব্যাটন হাতে জেনারেল জিয়াকে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি আমাদের শ্রেণিকক্ষের পাশ দিয়ে দেখতে দেখতে এমাথা-ওমাথা করলেন।

ওই তাকে কাছ থেকে দেখা। চোখে সবুজ কাঁচের রেবান সানগ্লাস পরা স্মার্ট মুখটি মনে রাখা। কমব্যাট ড্রেসের ওই মানুষটিকে আমাদের মনে হলো জ্বলন্ত ধ্রুবতারার মতো। সেই থেকে তার প্রতি আমাদের নিরন্তর আকর্ষণ।

জিয়ার সেই ভঙ্গি মনে রেখেই আমাদের অনেকে পরে অন্য পেশায় না গিয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া। বুয়েট, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পর ক’জনই আজ সেনাবাহিনীতে যায়? এমনকি বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বন্ধুবান্ধব, সমসাময়িক অনেকেই আজো তার সেই আদি মডেলের রেবান সানগ্লাস ব্যবহার করছেন।

অথচ কত মডেল এরপর বাজারে এসেছে! আমার একসময়কার (দুই ব্যাচ সিনিয়র) রুমমেট ও পরে রংপুর ক্যাডেট কলেজের প্রথম কলেজ প্রিফেক্ট হোসেন সোহেল শাহনওয়াজ আমৃত্যু রেবানের ওই মডেল চোখে পড়েছেন। তিনি ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ হন। তাকে সানগ্লাস নিয়ে প্রশ্ন করলে বলতেন জেনারেল জিয়া মডেল ব্যবহার করছি বৎস্য…!

সেই জিয়াকে তাই কিশোর বয়সেই আবেগ দিয়ে মনে রেখেছি। ৩০ মে ১৯৮১ তে তার মৃত্যুর খবর শুনে চোখে পানি ঝরিয়েছি। কত বছর পেরিয়ে গেছে। কতভাবেই না এই মহান মুক্তিযোদ্ধাকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে করা হয়েছে কটাক্ষ। এমনকি আজেবাজে অশ্লীল কথাও বলেছেন অনেকে, এখনো বলছেন। তাতে কী-ই বা যায় আসে?

কই আমার মতো কোটি হৃদয়ে তিনি তো বেঁচে আছেন অমর হয়ে। তিনি তো সেই জিয়া যিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন আধিপত্যবাদের ভ্রকুটি উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে চলতে।

তিনি তো সেই দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরে মহাচীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করে সশস্ত্রবাহিনীর অবকাঠামো বাড়িয়েছিলেন কয়েক গুণ। তিনি তো সেই প্রেসিডেন্ট যিনি মুসলিম দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করেছিলেন সেসব দেশে।

আজ তারই সেই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় মুসলিম দেশগুলোতে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশী কাজ করছে, আর তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে জীবন নির্বাহ করছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ, বেড়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বিদেশী মুদ্রার মজুদ।

সরকার পরিবর্তন হলেও তারই দেখানো পথে চীন এখনো রয়ে গেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সমরাস্ত্র সরবরাহকারী। এগুলো যদি তার অপরাধ হয় তাহলে আর কিছু বলার নেই। শুধু বলতে পারি হাজারো কসরত করেও শহীদ জিয়াকে কখনো হত্যা করা যাবে না…।

লেখক : সাংবাদিক,সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!