DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি নিয়ে কানাডায় চম্পট মিঠু দম্পতির আলিশান বাড়ী ও ব্যবসা।

দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ-এর নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: বাংলাদেশে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সবচেয়ে এগিয়ে বেসিক ব্যাংক। ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের ব্যাংকটি থেকে নেওয়া ৩,৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ৬১টি মামলার তদন্ত বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলমান।

এতে কানাডার টরন্টোয় আত্মগোপনকারী শীপ স্ক্র্যাপিং বা জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ওরফে জি বি হোসেন ও তার স্ত্রী  নাহিদ আক্তার সংশ্লিষ্ট। গাজী বেলায়েত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ এবং তার দুটি পাসপোর্ট রয়েছে। একটি বাংলাদেশি এবং অপরটি কানাডিয়ান।  বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিতে নাম আসায় দুদক প্রথমে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর: বিআর ০৫০২১০৯ এবং পরে কানাডিয়ান পাসপোর্ট নম্বর: এবি ৯৪৫৭২৭ ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলশ্রুতিতে তার বাংলাদেশ আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তিনি দুদককে সুকৌশলে কাঁচকলা দেখাতে সক্ষম হন।

তথাপি এ বিষয়ে দুদক পরিচালক (বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির অনুসন্ধান দলের নেতা) সৈয়দ ইকবাল হোসেন জানান, গাজী বেলায়েত মিঠু তার বিদেশ যাওয়ার বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিলে তিনি বিদেশ চলে যান। এরপর তার আর কোনো হদিস নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তিনি ও তার স্ত্রী বর্তমানে কানাডার টরন্টোয় বসবাস করছেন। তার কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ির ঠিকানাও পাওয়া গেছে। তাতে ‘মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্ট (এমএলএআর)’-এর ভিত্তিতে অতি দ্রুত কানাডা সরকারের কাছে এই ঋণ লোপাট সংক্রান্ত বিষয়টি জানাবে। তিনি আরও বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে গাজী বেলায়েত নিজের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে বেসিক ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে একটি সমন্বয় করা হয়েছে এবং অন্যটি চলমান। তদুপরি তার নেওয়া অধিকাংশ ঋণই বেনামি এবং ভুয়া। সেগুলো শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।

দুদকের অপর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিচালক জানান, মেসার্স বেলায়েত নেভিগেশনসহ বেশ কয়েকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বড় অংকের ঋণ নিয়েছেন গাজী বেলায়েত। এসব ঋণ নেওয়ার জন্য তিনি বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও গুলশান শাখার ম্যানেজার শিপার আহম্মেদসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের ঘুষও দেন। বর্তমানে ওই ম্যানেজার দুদকের দায়ের করা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারনে বাচ্চুর বিরুদ্ধে এখনও কোনো মামলা করেনি দুদক এবং বর্তমানে বহাল তবিয়তে তিনি দেশেই রয়েছেন।

দুদকের পাওয়া তথ্যমতে, চারটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান জাহাজ আমদানির নাম করে বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে মোট ১২৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়। যেগুলো মূলত বেলায়েত বা তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। অথচ ঋণ নিয়েও কোনো জাহাজ আমদানি করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণ নেওয়া এসব প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- বেলায়েত নেভিগেশন কোম্পানির নামে ২৪ কোটি, রিলায়েন্স শিপিং লাইন্সের নামে ১৬ কোটি, এসবিআই শিপিং লাইনের নামে ১৫ কোটি এবং বে নেভিগেশনের নামে ৭০ কোটি টাকা। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, এ জালিয়াতিতে গাজী বেলায়েত সরাসরি জড়িত। এছাড়া বেলায়েত নেভিগেশনেরও মালিক তিনি।

জানা যায়, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ১২টি কোম্পানি ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। কোম্পানিগুলো হলো- এসএফজি শিপিং লাইন, এস সুহী শিপিং লাইন, এশিয়ান শিপিং লাইন, এস রিসোর্স শিপিং লাইন, শিফান শিপিং লাইন, ল্যাবস এন্টারপ্রাইজ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, ব্রাদার্স এন্টারপপ্রাইজ, গ্রীন বাংলা হোল্ডিং কিয়েব ট্রেডিং, ডেল্টা সিস্টেমস লিমিটেড, বাসগৃহ প্রোপাটিজ এবং এম নাছিরউদ্দিন। এই কোম্পানিগুলো ঋণের টাকা নিজেদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরাসরি লেনদেন না করে ১৭টি ব্যাংকের ২৪টি শাখা থেকে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান ও ৮জন ব্যক্তির নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ঋণের টাকা তুলে নেয়, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধান চালাচ্ছে। কেননা এসব কোম্পানির অধিকাংশের সঙ্গে গাজী বেলায়েতের জড়িত। এছাড়া তার নামে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিভোয়া), কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) ও ওয়াটার ট্রান্সপোট কো-অর্ডিনেশনের (ডব্লিউটিসি) তহবিল লুটেরও অভিযোগ রয়েছে।

তবে দুদক যে পন্থায় সম্পত্তির ইতিবৃত্ত অর্থাৎ ‘মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্ট (এমএলএআর)’-এর ভিত্তিতে কানাডা সরকারকে ঋণ লোপাট ও অর্থপাচার সংক্রান্ত তথ্য দেবে বা দিয়েছে, সেই সম্পত্তির তালিকাটি ইতিমধ্যে মন্ট্রিয়লভিত্তিক অনলাইন দৈনিক প্রথম বাংলাদেশের হস্তগত হয়েছে।

এক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে টরন্টোয় বসবাসরত এই গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ও নাহিদ আক্তার ওরফে ‘মিঠু-নাহিদ’ দম্পতি স্কারবরোর অন্টারিও লেক সংলগ্ন একটি দ্বিতল ‘স্টোন পার্ল জুয়েল’ খঁচিত আলিসান প্রাসাদে বসবাস করছেন, যার ঠিকানা: ৯১ হিল ক্রিসেন্ট, স্কারবরো, অন্টারিও এম১এম ১জে৩। এই সম্পত্তির সর্বনিম্ন মূল্য: ৯.৪ মিলিয়ন ডলার, মধ্যম মূল্য: ১৩ মিলিয়ন ডলার ও সর্বোচ্চ মূল্য: ১৬ মিলিয়ন। যদি র্বোচ্চ মূল্যটি ক্রয়কৃত মূল্য হয়, তবে তা দাঁড়ায় বাংলাদেশি টাকায় ১০০ কোটির টাকার উপর। কিন্তু কানাডায় অধিকাংশ বাড়ীর ক্রেতা যেহেতু একটি নির্দিষ্ট অংকের ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বাড়ী কিনেন, সেহেতু নিদেনপক্ষে দুইবা ততোধিক মিলিয়ন ডলার ব্যাংকে জমা দিয়ে বাকিটা ব্যাংকের বদৌলতে কেনা হয়েছে, বাকি অর্থ মর্টগেজ হিসেবে মাসে মাসে পরিশোধযোগ্য।

২০১৫ সালে এই বাড়ীতে স্থানান্তরের আগে তারা থাকতেন রিচমন্ড হিলে অনুরূপ প্রক্রিয়ায় ক্রয়কৃত অপর এক প্রাসাদে, যা এখনও বিদ্যমান। অপরদিকে অন্টারিও প্রদেশের লেক সিমকোর কাছাকাছি তাদের একাধিক ‘আলট্রামার’ ব্র্যান্ডের ‘গ্যাসস্টেশন’ বা পেট্রলপাম্পসহ টরন্টোর পাশ্ববর্তী অ্যাজাক্স সিটিতে একটি ক্ষুদ্র শপিং প্লাজা রয়েছে। এছাড়াও টরন্টোর বাঙালি অধ্যুষিত ডেনফোর্থ রোড ও ডেনফোর্থ এভিনিউর সংযোগস্থলের প্লাজায় ‘কলাপাতা’ নামের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট ও ভাসাভিস নাহিদ’স কালেকশন বলে একটি অত্যাধুনিক ফ্যাশন স্টোর রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা যথাক্রমে: ৩৪৫৪ ও ৩৪৫৬ ডেনফোর্থ এভিনিউ, টরন্টো, অন্টারিও এম১এল ১ই৩।

মজার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশসহ বর্হিবিশ্বের নানাবিধ বাংলা পত্রিকায় ‘বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট’ শীর্ষক সচিত্র সংবাদটি প্রচারিত হওয়ায় অজানা কারণে টরন্টোয় ওই দম্পতির সর্বশেষ দুটি প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে মঙ্গলবার ও বুধবার বন্ধ ছিল। কিছু উৎসুক প্রবাসী সেখানে বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে জড়ো হলে পরস্পরের সঙ্গে প্রচারিত সংবাদ নিয়ে মতবিনিময় করেন। তাদের মোদ্দা কথা, এ ধরণের ঋণখেলাপি বা অর্থপাচারকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কিছু অসৎ ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট ও মানি রেমিটরদের সহায়তায় ‘ইনভেস্টর’ বা বিনিয়োগকারী সেজে কানাডায় এসে অবশেষে কমিউনিটির দুর্নাম ছড়াতে অপেক্ষমান। এখনই বাংলাদেশি কমিউনিটির ভবিষ্যত প্রজন্মের অব্যাহত অগ্রগতির স্বার্থে এই ঘৃন্য ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সহযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে কমিউনিটি নেতৃবৃন্দরা হতে পারেন অগ্রপথিক। একই সঙ্গে এ ধরণের অভিযুক্ত লোকজনকে কমিউনিটিতে বয়কট বা এড়িয়ে চলা অপরিহার্য। 

কারণ, টরন্টোর তথাকথিত ‘বেগম পাঁড়ার’ বাসিন্দারা ‘মিঠু-নাহিদ’ দম্পতির মতো ধীরে ধীরে সমাদৃত হওয়ার অপেক্ষায়, যারা এখনও সমাজে অপরিচিত।    

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!