DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

বাংলাদেশ কি ধীরে ধীরে একটি ভূয়ার রাজ্যে পরিনত হচ্ছে?????

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ টাকার বিনিময়ে মন্ত্রী, এমপি, সচিবের মাধ্যমে তদবির করা হয়। একদম লিখিত সুপারিশ। সফলও হয়েছেন অবৈধ ‘সেবা’ গ্রহীতারা। কারণ প্রভাবশালী মন্ত্রীদের সুপারিশ সহজে এড়িয়ে যাওয়া দুষ্কর। মন্ত্রীদের লাগামহীন সুপারিশে বিব্রত হয়েছেন কেউ কেউ। বাধ্য হয়ে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।

তার পরই শুরু হয় হইচই। সুপারিশের স্বাক্ষর, সিল জাল। অন্তত চার মন্ত্রীসহ ১০ এমপির স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। স্বাক্ষর জাল করে বিদেশে প্রশিক্ষণ, বদলিসহ নানা সুযোগ নিচ্ছিল তারা। বিষয়টি ধরা পড়ার পর শুরু হয় বিভাগীয় তদন্ত। বরখাস্ত করা হয় অবৈধ সেবা গ্রহণকারীদের। মামলাও হয় আদালতে। মামলার তদন্ত করছে পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। সিআইডির তদন্ত ও বিভাগীয় তদন্তে মিলেছে অভিযোগের সত্যতা। একে একে বেরিয়ে আসে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম। মন্ত্রী, এমপি, সচিবদের নাম ভাঙিয়ে যারা তদবির করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঘটনা এটি।

তবে এমন ঘটনা শুধু এক জায়গায় নয়, দেশের সর্বত্র এখন ভুয়াদের দৌরাত্ম্য। তাদের কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ। সমাজের তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় ভুয়াদের একচ্ছত্র দাপট। তাদের কর্মকান্ডে জিম্মি সাধারণ মানুষ। ভুয়া পুলিশ, ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া আইনজীবী, ভুয়া দুদক কর্মকর্তা, ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, ভুয়া শিক্ষক, ভুয়া সন্ত্রাসী, ভুয়া সচিব, ভুয়া সেনা কর্মকর্তাসহ সব পেশা-শ্রেণিতেই এখন ভুয়াদের জয়জয়কার। হালে ভুয়া এমপি-মন্ত্রীর সন্ধানও পাওয়া গেছে। যারা মন্ত্রী-এমপির নম্বর ক্লোন করে অফিস-আদালতে ফোন করে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। স্বাক্ষর জাল করে ডিও লেটার দিচ্ছে বিভিন্ন দফতরে।

মন্ত্রী পরিচয় দিয়ে টাকা আত্মসাৎকারী দুই প্রতারককে গ্রেফতার করেছে ডিএমপি গোয়েন্দা উত্তরের একটি টিম। এরা হলেন রমাপদ ভট্টাচার্য ওরফে শংকর (৫৫) ও তন্ময় চক্রবর্তী (২০)। তাদের একজন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং অন্যজন মন্ত্রীর পিএস সেজে প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন। ভুয়া মন্ত্রী ও ভুয়া পিএস আটককারী ডিবি সদস্যদেরও নির্ভেজাল রাখা যায়নি। খোদ রাজধানীতেও ভুয়ারা সংঘবদ্ধ হয়ে ডিবি-র‌্যাবের আভিযানিক টিম পর্যন্ত গঠন করেছে। প্রায়ই চলছে তাদের নানারকম অভিযান। কখনো তারা টার্গেট ব্যক্তিকে অপহরণ করে গোপন ডেরায় আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে।

একপর্যায়ে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে তবেই মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। আবার কখনো এসব ভুয়া টিম কল্পিত নানা অভিযোগ তুলে কারও বাড়িঘর কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হানা দেয়। তারা তল্লাশির নামে রীতিমতো ডাকাতি-লুটপাট করে নির্বিঘ্নে সটকে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ভুয়াদের সবচেয়ে বেশি দৌরাত্ম্য চলছে সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগ ও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় কথিত প্রশ্ন ফাঁসের ক্ষেত্রে। চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে ভুয়ারা একটি প্যাকেজের আওতায় গোটা প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। সরকারি দফতরের কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে পাঠানো হাজার হাজার আবেদনপত্র সংগ্রহপূর্বক তাদের নামে ইন্টারভিউ কার্ড প্রদান, লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ, পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার কার্যক্রম পর্যন্ত সম্পাদন করে।

এসব কর্মকান্ডের ফাঁকে ফাঁকেই ‘ঘুষের’ নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ভুয়ারা থাকে সংঘবদ্ধ, কৌশলী। সর্বত্র তাদের দাপটে আসলরাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ভুয়াবাজির দাপটে সবচেয়ে বিপাকে আছেন ফেসবুক-ব্লগ-নেট ব্যবহারকারীরা। একশ্রেণির দুর্বৃত্ত ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে নানা অশ্লীল ও মানহানিকর অপপ্রচারের মাধ্যমে টার্গেট নারী-পুরুষকে সামাজিকভাবে চরম হেনস্তা করে। এ ক্ষেত্রে অনলাইনে ভুয়া খবরের দৌরাত্ম্যে লোকজনকে মারাত্মক বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়।

রংপুর ডিসি অফিসের জিএম শাখা থেকে জেলা প্রশাসকের সই জাল, ভুয়া পুলিশ ভেরিফিকেশন দিয়ে ব্যাক ডেটে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ৪০০ অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের নজিরবিহীন ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নামে ভুয়া নোটিস, আদেশ ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রদানে সক্রিয় প্রতারক চক্র। দুদকের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রতারক চক্রটি সরকারি বিভিন্ন অফিসে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে নোটিস, অনুসন্ধান, আবার অর্থের বিনিময়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রলোভনও দেখায়। এ যেন দুদকের বাইরে আর একটি কমিশন। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে প্রতারক চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অবশেষে চক্রটিকে শনাক্ত করতে একটি বিশেষ টিম গঠন করেছে দুদক।

দিনাজপুরে ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে আজ ভর্তি হলে কালই পাওয়া যায় সার্টিফিকেট। অনুমোদন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ও ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়ার অভিযোগে ভুয়া ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত ১০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করা হয়েছে। আটকদের কাছ থেকে জাল সনদসহ বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পরে তাদের সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদ-সহ ২০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ভুয়া মামলা-ভুয়া ওয়ারেন্ট : রাজধানীসহ সারা দেশেই ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের ধকলে অগণিত মানুষ সীমাহীন হয়রানির শিকার হচ্ছে। তারা এক জেলার বাসিন্দা হয়ে আরেক জেলার ভুয়া ওয়ারেন্টের ধকলে দিনের পর দিন হাজতবাস করেও মুক্তি পাচ্ছে না। আইনের কঠিন বেড়াজালে অন্তহীন দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য হচ্ছে তারা। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা ও কোর্ট-কাচারির প্রতারক চক্রের যৌথ কারসাজিতে দেশজুড়েই এ ভয়ঙ্কর ভুয়াবাজি চলছে।

সম্প্রতি ভাটারা থানায় এক পুলিশ কর্মকর্তার কোপানলে পড়ে এক ব্যবসায়ীর নামে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রাম, খুলনা ও দিনাজপুর আদালতের পাঁচটি ভুয়া ওয়ারেন্ট হাজির হয়। প্রতিবারই তাকে আটক করে থানায় নেওয়ার আগেই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রকৃত আসামির পরিবর্তে নির্দোষ জাহালম ও আরমানকে জেল হাজতে বন্দী রাখার মতো হয়রানির আরেক নজির হয়ে উঠেছেন রাজধানীর ভাটারা থানার সেলিম মিয়া। সরকারবিরোধী নাশকতায় জড়িত বিএনপি নেতা সেলিমের বিরুদ্ধে মামলা হলেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। অথচ তার আটটি মামলারই ঘানি টেনে চলেছেন শ্রমিক লীগ কর্মী সেলিম মিয়া। বার বারই থানা পুলিশের ধরপাকড়ে নির্দোষ সেলিম দিশাহারা, কোর্ট-হাজত আর থানা পুলিশ ঘুরেও কূলকিনারা পাচ্ছেন না তিনি। খিলক্ষেত থানার বরুড়ায়ও স্কুলশিক্ষক জহিরুল ইসলামকে ভুয়া মামলায় হাজত খাটানোর নির্মম ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিপক্ষ মামলা-হয়রানির হুমকি প্রদানের এক সপ্তাহের মধ্যেই শিক্ষক জহিরুলের নামে ভুয়া ওয়ারেন্ট পৌঁছায় এবং তা তামিলের ঘটনা ঘটে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনো মামলা ছাড়াই ওয়ারেন্টটি প্রস্তুত করে থানায় পৌঁছানো হয়েছে। এর আগে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালা মিয়া নামের এক ব্যক্তির বিনা অপরাধে ভুয়া মামলায় দীর্ঘ নয় বছর জেল খাটারও নজির রয়েছে। পুলিশের অসতর্কতার কারণে বিনা অপরাধে ওই ব্যক্তি এত দিন সাজা ভোগ করেছেন বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী আল নোমান শরীফ। প্রকৃত আসামি কালুর বদলে কালা মিয়াকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায় কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ।

এরপর একটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে তিনি কারা ভোগ করতে থাকেন। শুধু অসতর্কতায় নয়, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে ভুয়া ওয়ারেন্টের ভয়ঙ্কর বাণিজ্য শুরু করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আদালতের ভুয়া ওয়ারেন্ট হাতে নিয়ে পুলিশ নিরীহ-নিরপরাধ ব্যক্তিদের চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এমনকি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে পুরছে। আদালতসূত্রে জানা গেছে, খুব সহজে আদালত থেকে ভুয়া ওয়ারেন্ট তৈরি করে থানায় পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিচারাধীন মামলায় বিচারক পলাতক আসামিকে গ্রেফতারের আদেশ দেওয়ার পরই কেবল আদালতের পেশকার গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরি করেন। পরে তা বিচারকের সিল-স্বাক্ষরসহ ডেসপাস শাখায় জমা দেওয়া হয়। অন্যদিকে মামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে বিচারক আদেশ দেওয়ার পর কোর্ট জিআরও গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরি করে ডেসপাস সেকশনে পাঠান।

উভয় ধরনের ওয়ারেন্টই আদালতের স্মারক নম্বর দিয়ে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট থানায় বিলি করা হয়। এ ছাড়া কখনো কখনো আদালত থেকে সরাসরি থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে দেওয়া হয়। মূলত এই তিন সেকশনের কেউ না কেউ ভুয়া গ্রেফতারের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া ভুয়া ওয়ারেন্ট থানা পুলিশের হাতে পৌঁছানো ও তা তামিল করানো অনেকটা অসম্ভব। তবু ভুয়া ওয়ারেন্ট চক্রকে চিহ্নিত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার উদ্যোগ নেই।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!