DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

উল্টে গেল দৃশ্যপট: ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের নামে এটা কী মঞ্চস্থ করেছে সরকার?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী: সরকার, নির্বাচন কমিশন, দলীয়করণকৃত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী মিলে বাংলাদেশে গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের নামে এটা কী মঞ্চস্থ করেছে; জনগণ ভালো করেই জানে। এখন চলছে ‘পপিচুসে’র (পরস্পর পিঠ চুলকানি সমিতি) পালা। এ ওকে বলেন, ‘অসাধারণ কাজ করেছেন।’ সে ওকে বলেন, ‘বাহবা বাহবা বেশ; অসাধারণ কাজ করেছেন। জাতি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ সে কৃতজ্ঞতা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। আর সরকারপ্রধান জানিয়েছেন পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, মিলিটারি ও জনগণকে।

বাংলাদেশে নজিরবিহীন নির্বাচনী প্রহসনের পর সরকার সুপরিকল্পিতভাবে এক বিবেকহীন কথা বিশ্বাসীর মধ্যে ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের কাজ ছিল, সরকার নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনগুলোতে সরকারের মনোভাবের জোরালো প্রচারণা চালানো। তা হলো, নির্বাচন খুবই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। আর ২৯৮ আসনের মধ্যে বিএনপিকে যে মাত্র ছয়টি আসন দেয়া হয়েছে, তার ‘যৌক্তিকতা’ তুলে ধরা হলো। তিন সপ্তাহেরও অধিক সময় ধরে টেলিভিশনগুলোতে একই গীত প্রচারিত হয়েছে। বলা হয়েছে, বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হেরেছে নিজের দোষে। আর সে দোষ হলো, ‘তারা জামায়াতকে ২২টি আসন ছেড়ে দিয়েছে।’ কী সাংঘাতিক কথা! জামায়াতের সাথে বিএনপির সখ্য! আস্তাগফিরুল্লাহ!

কিন্তু কোনো কোনো আলোচক মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, আওয়ামী লীগও তো ১৯৯৬ সালে জামায়াতকে সাথে নিয়ে বিএনপি সরকারকে হটানোর আন্দোলন করেছে। জামায়াতের নেতা মরহুম মতিউর রহমান নিজামীকে পাশে বসিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে। তখন কি ‘মহাভারত অশুদ্ধ’ হয়ে যায়নি? তার জবাবে ওই সব দলকানার বক্তব্য ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ তো তাদের ফাঁসি দিয়েছে। ফলে ‘মহাভারত শুদ্ধ’ হয়ে গেছে। ওই দুর্মুখ আলোচকেরা যখন বলেছেন, যদি ধরে নেয়া যায়, যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে, তারা সবাই ‘যুদ্ধাপরাধী’ ছিলেন; তাহলে তো জামায়াত বেশ সাফ-সুতরো হয়ে গেছে, এখন তবে কেন আর ‘জামায়াত জুজু’! তখন ওই বুদ্ধিজীবীরা বলেছেন, কিন্তু জামায়াত তো যুদ্ধাপরাধীর দল। ‘অন্যের অপকর্মের জন্য জামায়াতকে দোষারোপ করা কি সঙ্গত?’ তখন ওই সব বাকজীবী এর কোনো জবাব দিতে পারেননি।

এসব শোতে আরো একটি বিষয় উঠে এসেছিল। আর তা হলো, এখন জামায়াত কারা করে? দুর্মুখেরা বললেন, জামায়াতে এখন যাদের বয়স পঁয়ষট্টি বা তার কম, ’৭১ সালে তাদের কারো রাজাকার হওয়ার বয়স হয়নি। কারণ, আঠারো বছরের কম বয়সী কাউকে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী। জামায়াত-শিবিরে যাদের বয়স ৫০ বছর, তারা জানেও না যে, মুক্তিযুদ্ধে কী হয়েছিল। তাহলে তাদের কেন অপরাধী বলতে হবে? তা ছাড়া, বঙ্গবন্ধুর সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তিনি সিমলা চুক্তির পর তাদের ক্ষমা করে দিয়ে গর্ব করে বলেছিলেন, বাঙালি জাতি দেখিয়ে দিলো, তারা ক্ষমা করতে জানে। গুরুতর অপরাধ করেনি, এমন ব্যক্তিদের জন্য সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তা হলে ক্ষমার পর এখন তাদের শাস্তি দিতে হবে, এ কেমন কথা!

কিন্তু বাকজীবীরা বলতেই থাকলেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধী। তাহলে সরকার এই দলকে কেন নিষিদ্ধ করছে না? ওই ব্যক্তিরা তারও কোনো জবাব দিতে পারেন না। এ দিকে আবার আনিসুল হক আইনমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার কথা ভাবছে সরকার। এ জন্য তারা শিগগিরই আইন প্রণয়ন করবেন। কিন্তু দেশের সংবিধান ও ইসলাম কাউকে এ ক্ষমতা দেয়নি যে, পিতার অপরাধের জন্য পুত্র-কন্যা কিংবা পুত্র-কন্যার অপরাধের জন্য পিতামাতাকে শাস্তি দেয়া যাবে। বিদায় হজের ভাষণেও হজরত মুহাম্মদ সা: এ কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে গেছেন। তাহলে তাহাজ্জুদ পড়া ও প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করা প্রধানমন্ত্রী কোন বিধান বলে তেমন আইন অনুমোদন করবেন?

এই ডামাডোল এখনো চলছে। এখনো বলা হচ্ছে, জামায়াতকে সাথে নেয়াতেই বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে। এরা কেউ মানতেই চান না যে, আসলে বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বর সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এরা বলেছেন, বিএনপির নেতৃত্ব ব্যর্থ। প্রতি আসনে তিন-চারজন করে প্রার্থী রাখা, অচেনাদের মনোনয়ন দেয়া প্রভৃতি হলো বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবির কারণ। কিন্তু যখন বলা হয়েছে, কেন বিএনপিকে একাধিক প্রার্থী রাখতে হয়েছে? তখন তারা সে যুক্তি মানতে চাননি। বিএনপির ডজন ডজন প্রার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভিপি জয়নাল, মাহবুবউদ্দিন খোকন, মেজর আক্তারুজ্জামানসহ অনেক প্রার্থীর ওপর আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা চালিয়ে তাদের জখম করেছে। নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করে তাতে লাখ লাখ আসামি করা হয়েছে। যাতে কেউ পোলিং এজেন্ট না হতে পারে, সে জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ তাদের ‘দৌড়ানি’ ও হুমকি দিয়েছে। আর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন কী হয়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া সে দৃশ্য দেখাতে না পারলেও প্রিন্ট মিডিয়ায় তা প্রকাশ হয়েছে, সেটাই যথেষ্ট যে, বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়েছে না ভোট ডাকাতি হয়েছে।

আসলে এসব বাকজীবী সব ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, ‘নির্বাচনে বিএনপি জনগণের ভোটে হেরেছে। আর এই হারের কারণ, জামায়াতসংশ্লিষ্টতার কারণে তরুণ প্রজন্ম বিএনপিকে ভোট দেয়নি।’ বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ১০ কোটি। তিন কোটি তরুণ প্রজন্মের সবাই যদি বিএনপিকে ভোট না দিয়ে থাকে, তাহলে বাকি সাড়ে সাত কোটির মধ্যে বিএনপি ক’টা ভোট পেয়েছে? এসব আলোচক বারবার বলেছেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল, তাদের রয়েছে বিপুল জনসমর্থন।’ কিন্তু তার ফলাফল কি এই!

তবে গোল বেধেছে বেশ কয়েকটি জায়গায়। প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে বলেছেন, ‘লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আওয়ামী লীগ যে জিততই সে কথা বলেছিল। আর যেটা তিনি উল্লেখ করেননি, তা হলো ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলেছে, গণতান্ত্রিক দেশের কাতারে নেই বাংলাদেশ। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাদের ভোট দিতে বাধা দেয়া হয়েছে। ব্যালট বাক্স আগের রাতেই সিল মেরে ভরাট করে রাখা হয়েছিল।’ এ রকম নির্বাচন তিনি না করলেও পারতেনÑ এমন কথাও বলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সব সংস্থাই যখন বলছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ জিতত, তাহলে এত কারচুপি-জালিয়াতির কেন প্রয়োজন পড়ল? সরকারের কাছে আসলে ভিন্ন চিত্র ছিল। তারা জানতেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ৩০টির বেশি আসন পাবে না। সুতরাং ‘যত পথ’ আছে সব পথই তারা অনুসরণ করেছেন। আর সেটি করতে গিয়ে আজব খেল দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও ধাওয়া করেছে; যাতে কেউ ভোটকেন্দ্রের কাছেও যেতে না পারেন। আর জেলায় জেলায় পুলিশের বড় কর্তারা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এমনও নির্দেশ দিয়েছেন, ৫০ শতাংশ ব্যালট আগের রাতেই নৌকার পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢোকাতে হবে। দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমে তার বিবরণ প্রকাশ হয়েছে।

আরো একটা বিষয় আলোচনায় ছিল। তা হলো, বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের প্রহসনকে ‘খুব খাঁটি ভোট’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই সার্টিফিকেট দানকারী সংস্থা ছিল দু’টি। তার একটি হলো সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন।

এই ফাউন্ডেশনের মনোগ্রাম সার্কের মনোগ্রামের মতো দেখতে, কিন্তু সার্কের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি ঢাকার মিরপুরের ধূলিধূসরিত একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট অফিস। সেখানে নিয়মিত কোনো কাজ নেই। এর প্রধান হলেন হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি আবদুস সালাম (৭৫)। তিনি ও তাদের একজন কানাডীয় পর্যবেক্ষক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুক্ত হয়ে ‘অনুতপ্ত’ হওয়ার কথা জানিয়েছেন সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে। ঢাকার ৯টি নির্বাচন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে তারা জানিয়েছিলেন, ‘নির্বাচন ভালো হয়েছে।’ কিন্তু পরে তারা এই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। বিচারপতি আবদুস সালাম রয়টার্সকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগের রাতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছেন এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ভোটারদের কাছ থেকে নির্বাচনের এমন বিবরণ শোনার পর তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, নতুন করে নির্বাচন হওয়া দরকার। এখন সব কিছু জানতে পেরেছি এবং বলতে দ্বিধা নেই যে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি।’

সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের হয়ে কানাডীয় নাগরিক তানিয়া ফস্টার প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশে কানাডার মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে তার নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আর এই ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টাদের একজন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আর একজন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য। বিচারপতি আবদুস সালাম বলেন, কয়েকজন প্রিজাইডিং অফিসার তাকে বলেছেন, ব্যালট বাক্স ভরতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। কানাডীয় নাগরিক ফস্টার বলেন, তিনি বাংলাদেশীদের কাছে শুনে পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটিকে একটি মজার অভিজ্ঞতা হিসেবে তিনি পর্যবেক্ষক হয়েছেন। তিনি জানতেন না যে, এর সাথে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং সার্কের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

অর্থাৎ ধোপে টিকল না নির্বাচন ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ। আর তাই প্রশ্ন হচ্ছে, এহেন পন্থায় অধিষ্ঠিত এই সরকার কত দিন টিকে থাকবে? 

লেখক : ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!