DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

সৌদি কনস্যুলেটে যুবরাজের সমালোচক সাংবাদিক খুন, নেপথ্যে কী?

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  বান্ধবীকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে মঙ্গলবার দুপুরে সৌদি কনস্যুলেটে ঢুকেছিলেন দেশটির যুবরাজের সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগি। উদ্দেশ্য ছিল তার বিবাহ-বিচ্ছেদের সার্টিফিকেট নেয়া। তার পর থেকেই জামাল খাসোগি নিখোঁজ হন। ছয় দিন পর তুরস্কের পুলিশ এখন বলছে, তাকে হয়তো কনস্যুলেটের ভেতরেই খুন করা হয়েছে।

সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী জামাল খাসোগির রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া নিয়ে পাশ্চাত্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যমে ক'দিন ধরেই তুমুল হৈ চৈ চলছিল; কিন্তু এখন তা পুরোদস্তুর হত্যা রহস্যের চেহারা নিয়েছে।

জামাল খাসোগি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের একজন সমালোচক এবং বেশ কিছুকাল ধরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে- এমন ধারণার পক্ষে কোন প্রমাণ দেয়নি তুর্কী পুলিশ। এদিকে, সৌদি কর্মকর্তারা একে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

বিচিত্র এই ঘটনার শুরু মঙ্গলবার। খাসোগির সাথে হাতিস চেঙ্গিজ নামে একজন তুর্কী মহিলার প্রণয় চলছিল। হাতিসকে নিয়েই তিনি ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেট ভবনে এসেছিলেন। চেঙ্গিজ বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং খাসোগি কনস্যুলেটের ভেতরে যান।

কিন্তু খাসোগি আর বেরিয়ে আসেননি।

তাকে হত্যা করতে এসেছিল সৌদির ১৫ সদস্যের একটি দল?

খাসোগিকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে; প্রাথমিকভাবে এমন অনুমান করছে তুরস্কের পুলিশ। শুধু তাই নয়, শনিবার দুই অজ্ঞাতনামা সূত্রের বরাত দিয়ে তুর্কী সংবাদমাধ্যম ও ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, খাসোগির মৃতদেহ কনস্যুলেট থেকে বের করেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, খাসোগিকে হত্যা করতে ১৫ জনের একটি বিশেষ দল পাঠানো হয়েছিল।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে, যে সময়ে খাসোগি কনস্যুলেটের ভেতরে ছিলেন; সেই সময় প্রায় ১৫ সৌদি নাগরিক সেখানে ছিল। মঙ্গলবারই এই ১৫ জন বিমানে ইস্তাম্বুল পৌঁছায়।

তুর্কী-আরব মিডিয়া এসোসিয়েশনের প্রধান তুরান কিসলাকচি মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, তুর্কী পুলিশ সৌদি কনস্যুলেটের নিরাপত্তার জন্য বসানো সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করেছে এবং তাতে জামাল খাসোগি বেরিয়ে যাচ্ছেন এমন কোন কিছু দেখা যায়নি।

কিন্তু এ সময়ই কিছু কূটনৈতিক গাড়ি কনস্যুলেটে ঢুকতে এবং বের হতে দেখা গেছে। খাসোগির অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত শুরু করেছেন তুরস্কের কর্মকর্তারা। একটি নিরাপত্তা দল ইতোমধ্যে ইস্তাম্বুল এসেছে। কিন্তু তাকে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করার কোন প্রমাণ বা কিভাবে তাকে খুন করা হলো- এ ব্যাপারেও কোন তথ্য দেননি তুর্কী কর্মকর্তারা।

এর আগে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ব্লুমবার্গ নিউজকে বলেন, তুর্কী কর্তৃপক্ষ কনস্যুলেট ভবন তল্লাশি করতে পারে, এতে কোন বাধা নেই।

কেন সৌদি কনস্যুলেটে এসেছিলেন জামাল খাসোগি?

খাসোগির কনস্যুলেটে আসার উদ্দেশ্য ছিল, তার পূর্বতন স্ত্রীকে যে তিনি ডিভোর্স (তালাক) দিয়েছেন- এ মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র নেয়া, যাতে তিনি হাতিসকে বিয়ে করতে পারেন।

খাসোগি তার মোবাইল ফোনটি হাতিসের হাতে দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢোকেন। হাতিস সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, খাসোগি এ সময় বিমর্ষ এবং মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। কারণ তাকে ওই ভবনে ঢুকতে হচ্ছে।

হাতিস আরো বলেন, জামাল খাসোগি তাকে বলেছিলেন যদি তিনি কনস্যুলেট থেকে বের না হন। তাহলে তিনি যেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের একজন উপদেষ্টাকে ফোন করেন।

হাতিস জানান, তিনি কনস্যুলেটের বাইরে অপেক্ষা করেন মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দুপুর একটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু তিনি জামাল খাসোগিকে কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেননি। বুধবার সকালে কনস্যুলেট খোলার সময় তিনি আবার সেখানে উপস্থিত হন।

তখন পর্যন্ত খাসোগির কোন খোঁজ তো মেলেইনি, এখনো তিনি নিরুদ্দেশ।

কে এই জামাল খাসোগি?

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অন্যতম প্রধান সমালোচক হচ্ছেন এই ৫৯ বছর বয়স্ক জামাল খাসোগি। তিনি আল-ওয়াতান পত্রিকা ও সৌদি টিভির সাবেক সম্পাদক ছিলেন। তিনি সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং উর্ধ্বতন সৌদি কর্মকর্তাদের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কিন্তু কয়েকজন বন্ধুকে গ্রেফতার করার পর আল-হায়াত পত্রিকায় তার কলামটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং টুইট করা বন্ধ করতে সতর্ক করে দেয়া হয়।

এর পর খাসোগি সৌদি আরব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখান থেকে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় লেখালিখি ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন।

যুবরাজ সালমানের সংস্কার পরিকল্পনা পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রশংসিত হলেও- ভিন্নমতাবলম্বী, মানবাধিকার ও নারী অধিকারকর্মীদের দমন, বুদ্ধিজীবী এবং ধর্মীয় নেতাদের গ্রেফতার, ইয়েমেনের যুদ্ধ ইত্যাদি সমালোচিত হয়েছে।

এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?

বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন তিক্ত অবস্থায় আছে এবং একজন সুপরিচিত সৌদি ভিন্নমতাবলম্বীকে তুরস্কের মাটিতে রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যার ব্যাপারটি প্রমাণিত হলে তা আরো বিরূপ হবে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই সৌদি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এ ঘটনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়েছে। তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টিও বলেছে, খাসোগির কি হয়েছে তা ব্যাপক তদন্তের মাধ্যমে বের করা হবে।

সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া কি?

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, খাসোগি একজন সৌদি নাগরিক এবং তার কি হয়েছে তা জানতে তিনি খুবই ব্যগ্র, তারা তুর্কী সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।

যুবরাজ বলেন, আমি যা বুঝতে পারছি তা হলো- তিনি (খাসোগি) কনস্যুলেটে ঢুকে আবার কয়েক মিনিট বা ঘণ্টাখানেক পরই বেরিযে যান, তবে আমি নিশ্চিত নই। আমরা তদন্ত করছি।

তিনি আরো বলেন, কনস্যুলেট ভবন সৌদি আরবের নিজ ভূখন্ডের মর্যাদা ভোগ করে। কিন্তু তদন্তকারীরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে অনুমতি দেয়া হবে এবং তাদের কোন কিছু লুকানোর নেই।

সৌদি আরবে খাসোগির নামে মামলা আছে কি? জানতে চাইলে যুবরাজ সালমান বলেন, তিনি কোথায় আছেন সেটাই তারা প্রথম জানতে জানতে চান। বিবিসি বাংলা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!