DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

জিয়া পাকিস্তানী গুপ্তচর হলে কি করে ‘বীরউত্তম’ হলেন ???

মোহাম্মদ আলী বোখারী * টরন্টো থেকে : একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন জেড-ফোর্সের প্রধান ও এগার নম্বর সেক্টর কমান্ডার তদানীন্তন বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমানের ১ মিনিট ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবে রয়েছে। সূচনায় ভাষ্যকারের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, পাশ্চাত্যের কোনো গণমাধ্যম তা ধারণ করেছিল। ভাষ্যকার বলছেন ‘আর্মির আক্রমণ শুরুর পর মেজর জিয়া পূর্ব বাংলার আর্তি বিশ্বকে জানিয়েছেন’।

দৃশ্যপটে পাহাড়ী রণাঙ্গনে সদ্য তৈরি ট্রেঞ্চ থেকে বাঙালি জোয়ানদের অবিরাম গুলিবর্ষণ চলছে। আর জিয়া দৃঢ়চিত্তে ইংরেজিতে বলে চলেছেন ‘যখন আমাকে বলা হলো ও জানতে পারলাম, আমাদের জনসাধারণ ও আর্মি অফিসারদের হত্যায় পাকিস্তানিরা বেরিয়েছে, আমরাও পথের সন্ধানে অস্ত্র হাতে বেরিয়েছি। ২৭ তারিখ আমরা চট্টগ্রামের রেডিও স্টেশনটি দখল করে নিই এবং তার আগে আমাকে বেতার কেন্দ্রে যেতে হয়েছিল। কেননা পাকিস্তানিরা ব্যাপকভাবে ( চট্টগ্রামে জড়ো হচ্ছিল এবং জেনেছি ১৬ ডিভিশনের উপর তারা আঘাত হেনেছে।

শেষ রক্ষা হিসেবে, আমি বিশ্বকে জানিয়েছি কী ঘটেছে এবং বিকেলে রেডিওতে যাই ও ঘোষণাটি দিই। রেডিওতে আমার কণ্ঠ শুনে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অপরাপর রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল এবং একইসঙ্গে পুলিশ বাহিনী বিদ্রোহ করে’। 

এই রেডিও ঘোষণার যোগসূত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর সেনানী এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জার বক্তব্য সম্বলিত প্রথমা প্রকাশনী থেকে মুদ্রিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ বইটির কথা সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই পত্রিকা মাধ্যমে জেনেছেন।

এরও আগে স্বাধীনতাপরবর্তী এক দশকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস রচনা করেন ‘বাংলাদেশ – এ লিগেসি অব ব্লাড’।

এই বইটিতেও স্বাধীনতার সূচনায় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম উদ্যোক্তা বেলাল চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে মেজর জিয়াকে অনুরোধ করে বলেছেন, ‘আপনি মেজর, আমরা মাইনর; আপনার ঘোষণাটিই হবে অর্থবহ’। এই বইটি সম্পর্কে লেখকের স্বগতোক্তি: ‘এই বইয়ে আছে ১২০টির উপর সাক্ষাৎকার, যার প্রতিটি নারী-পুরুষই ইতিহাসের নাটকীয়তায় জড়িত’। 

পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রেক্ষাপটে বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবির্ভূত হলে পুরো প্রয়াসের প্রতি তৎকালীন সেনাপ্রধান নির্লিপ্ত থাকলেও আর্মি থেকে প্রতিশোধ স্পৃহায় জেগে উঠেছিলেন প্রয়াত কর্নেল শাফায়েত জামিল। পরিণতিতে বঙ্গভবন থেকেই তাকে মারাত্মক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিফল হয়ে ফিরতে হয়। সেই সাহসী কর্নেল জামিল তার বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখেছেন ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে যোগ্যতম ও অকুতোভয় যোদ্ধা’।

মেজর জিয়ার সেই সাহসিকতা ও ধীমানশীল যোগ্যতার ইতিহাসটি কী? ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ওয়ার্ল্ড বায়োগ্রাফি’ থেকে জানা যায়, সেটি গড়ে উঠেছে কলকাতার হেয়ার স্কুলে, যে স্কুলটিতে পড়েছেন অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস পার্টির সভাপতি মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও নেতাজি সুভাষ বোস।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে জিয়াউর রহমান কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে তার অসম সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ অর্জন করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদকÑ ‘হেলাল-ই-জুরাত’ বা ‘ক্রিসেন্ট অব কারেজ’।

১৯৬৬ সালে জিয়া কোয়েটার আর্মির কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষক নিযুক্ত হলে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য বিদূরীকরণে ৮ম ও ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তুলতে সহযোগিতা জোগান। এক্ষেত্রে উইকিপিডিয়ায় তার অবস্থানটি – ‘রোল মডেল ফর এসপায়ারিং বেঙ্গলি আর্মি অফিসার্স’।

পরে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও শেরপুর নিয়ে গঠিত এগার নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মেজর জিয়া ওই অঞ্চলের কামালপুর ও বাহাদুরাবাদে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করেন। পরবর্তীকালে সেটাই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে কৌশলগতভাবে মেজর জেনারেল জি এস নাগরা’র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঢাকা আগমনের পথকে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর উম্মুক্ত করে দেয়। এক্ষেত্রে ঢাকার পথে দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা একমাত্র মুক্তিবাহিনীর দল, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীর প্রায় ৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকাটি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল ডি কে পালিত রচিত বই ‘দ্য লাইটেনিং ক্যাম্পেইন : ইন্ডো-পাকিস্তান ওয়ার, ১৯৭১’-এ এর উল্লেখ রয়েছে। ভারত রক্ষক মনিটরে ‘ইমেজেস অব ১৯৭১ : দ্য পাকিস্তানি সারেন্ডার এট ঢাকা’য় হেলিকপ্টার অবতরণের চিত্রসহ বর্ণিত আছে।‘ এই মেজর জেনারেল জি এস নাগরাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে মিরপুর থেকে আত্মসমর্পণের জন্য প্রথম যোগাযোগ করেন। কাকতালীয়ভাবে তারা দুজনই ব্রিটিশ রেজিমেন্টে একত্রে ব্যাচমেট ছিলেন। 

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে এভাবেই মেজর জিয়ার ভূমিকাটি হয় অবিস্মরণীয়। সেজন্য সকল সেক্টর কমান্ডারদের মাঝে সর্ব প্রথম তাকেই ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। 

দুঃখজনকভাবে সেই জিয়াউর রহমানকে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে সরকার সমর্থকরা ‘পাকিস্তানি গুপ্তচর’ আখ্যায়িত করছেন। এমনকি জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে তার সমাহিত লাশ তুলে ‘ডিএনএ’ টেস্টের কথা তুলেছেন। গত ৪ ফেব্র“য়ারি দৈনিক আমাদের অর্থনীতির নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ বোরহান কবীর যে শীর্ষ মন্তব্য প্রতিবেদনটি লিখেছেন তাতে বিস্ময় জেগেছে। ‘জিয়াকে লেখা কর্নেল বেগের চিঠি’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘জিয়া আসলে ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এজেন্ট’। পাশাপাশি শুধু ‘কর্নেল বেগ’ নামের ওই পাকিস্তানি সামরিক অফিসার সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ‘কর্নেল বেগ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম কর্তা। সকাল-সন্ধ্যা বাঙালি নিধনের নির্দেশ দিচ্ছেন, ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করছেন’।

কিন্তু হতবাক করার মতো বিষয়টি হলো একাত্তরের গণহত্যা পরিচালনায় যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের তালিকা সর্বজন বিদিত, তাতে এই ‘কর্নেল বেগ’ বলে কেউ নেই। বরং যে চারজন কর্নেলের নাম রয়েছে, তারা হল ফজলে হামিদ, কে কে আফ্রিদি, মোহাম্মদ খান ও মোহাম্মদ মোশাররফ আলী। লক্ষণীয়Ñ ওই চিঠির হস্তাক্ষর, ভাষা, তিনটি শব্দের বানানগত ত্র“টি এবং জিয়াকে পুরস্কৃত করার কর্তৃত্বসর্বস্ব আশ্বাসÑ সবই অবস্থান বিবেচনায় প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় হিসেবে প্রতীয়মান। বড় বিষয়টি হচ্ছে, আর্মিতে ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক সব চিঠিরই একটি ‘ডিও’ নম্বর থাকে। এক্ষেত্রে সেটির নম্বরটি কি জানা যায়নি।

এ বিষয়গুলো নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যায় অপর প্রতিবাদী বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের সঙ্গে টেলিফোনে তাৎক্ষণিক কথা বললে তিনি জানান, এভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হেয় করা চরিত্র হনন করার সামিল। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানই ছিলেন প্রথম খেতাবপ্রাপ্ত বীর উত্তম। তার সে অবদানটি যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়েছিল বলেই খেতাবটি তাকে দেয়া হয়েছে। আমি যুদ্ধাহত অবস্থায় মেঘালয়ের তেলঘালায় মেজর জিয়ার সান্নিধ্য লাভ করেছি। সেখান থেকেই তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। তার দেশপ্রেম বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। আজকের আওয়ামী লীগ ‘কমিউনিস্ট মার্কা’ হয়েছে বলেই এই অধঃপতন। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী নয়। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!