DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ডক্টর তুহিন মালিকের কলামঃ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট

tuhin1ড. তুহিন মালিকঃ এক. বাংলা সিনেমার শেষ অংশে ভিলেনকে পরাস্ত করার পর নায়ক যখন প্রতিশোধ নিতে যায়, ঠিক তখনই পুলিশ এসে বলে ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’। অন্য দিকে, ইংরেজি ভাষায় ভিলেনকে পুলিশ বলে ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’। এখন দিন বদলেছে; কিন্তু পুলিশের সেই বিখ্যাত ডায়লগ ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’ এখনো সমানে চলছে বাস্তব জীবনে। এখনকার অ্যারেস্ট মানে গণগ্রেফতার।

এটা যতটা না ফৌজদারি আটক, তার চেয়ে অনেক বেশি আটক-রাজনীতি। যার আরেক নাম আটকবাণিজ্য। রাজনৈতিক ঋতুচক্রের সাথে তাল মিলিয়ে এই বাণিজ্যের মওসুমও সারা বছরই ঘুরেফিরেই আসে। এই ‘গ্রেফতার অর্থনীতির’ প্রধান মুনাফাভোগী পুলিশ হলেও এই অর্থনীতির সুফল ভোগ করছে দেশের একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও থানা-কোর্ট-হাজতের বহুবিধ চক্র।

কয়েক বছর ধরে আমাদের ফৌজদারি মামলার এজাহারে নতুন উদ্ভাবিত এই গণগ্রেফতারে দুই-চারজন আসামির নামের সাথে জুড়ে দেয়া হয় অজ্ঞাতনামা শত শত আসামির গল্প। এমনকি এই অজ্ঞাতনামা মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজার পর্যন্ত দেখা গেছে সম্প্রতি কালিহাতিসহ বেশ কিছু মামলার এজাহারে। এতে পুলিশের হয়েছে বহুবিধ ফায়েদা। প্রকৃত আসামির সন্ধানে তদন্তের কোনো প্রকার কষ্ট সহ্য করতে হয় না তাদের। গণহারে গ্রেফতার করে জনপ্রতি মামলাভেদে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ-কোটি টাকা পর্যন্ত মুক্তিবাণিজ্য আদায় করার এ যেন এক মহা উৎসব! তা ছাড়া এত আসামিকে ধরে আইনের কাছে সোর্পদ করার প্রশাসনিক বাহবা তো সাথে আছেই। আর নিরীহ জনগণ ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’ সংলাপকে মেনে নিয়েই আইনের শাসন খুঁজতে গিয়ে কোর্ট-কাচারিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এখানেও রয়েছে একেক মামলার জামিনের একেক রেট। যে পুলিশ ধরছে, সেই আবার রাস্তা বাতলে দিচ্ছে, কোন পদ্ধতিতে গেলে নিশ্চিত জামিন পাওয়া যাবে।

ক’দিন আগে পত্রিকায় এসেছে, ঢাকার সিএমএম আদালতের এক সেরেস্তা নিজেই নাকি শত শত মামলায় জামিন দিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ দিন পর জানা গেল, এসবই ছিল ভুয়া জামিন। এ তো গেল একটা রূপ। আর করুণ বাস্তব রূপটা আদালত চত্বরে ভুক্তভোগীরাই বেশি জানেন। বিপদগ্রস্ত মানুষের অসহায়ত্বকে জিম্মি করে অর্থ আদায়কারীদের দৌরাত্ম্যে বিচারপ্রার্থীরা এখন আর কোর্ট-কাচারিতে ভালো উকিল না খুঁজে ‘লাইন-জানা’ উকিলের পেছনেই ছুটছে।

দুই. আমার দুই দশকেরও বেশি দীর্ঘ আইনপেশায় এ রকম বহু মামলায় দেখেছি শুধু মানুষের পকেটের টাকা নিজের পকেটে ভরার লোভে কিভাবে পুলিশ নিরীহ মানুষকে জেলে ঢুকাচ্ছে। বছর দশেক আগে এক মামলায় একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী নয় বছর পর ঈদের ছুটিতে মাত্র পনের দিনের জন্য দেশে এসে হত্যা মামলার আসামি হয়ে যায়; কিন্তু ঘটনার আসল মোটিভ ছিল

এই প্রবাসীর নয় বছরের প্রবাস জীবনের রোজগারের টাকাগুলোকে হাতিয়ে নেয়া। এভাবে হাজার হাজার মামলায় গুটিকয়েক প্রকৃত অপরাধী ছাড়া গণগ্রেফতারের বেশির ভাগই হচ্ছে দেশের সাধারণ নিরপরাধ মানুষ। গণগ্রেফতারের রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি! এই অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি আবার বিবিধ রেটের সাথে ওঠানামা করে। অজ্ঞাত আসামি না হতে চাইলে এক রেট।

নাশকতার মামলা থেকে ছাড়া পেতে আরেক রেট। ভয় দেখিয়ে মামলা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে একরকমের রেট। থানা থেকে মুক্তি পেতে লাগে অন্য রেট। কোর্ট থেকে মুক্তি পেতে আরেক রেট। বেইলবন্ড তৈরি করতে আর জামিননামা তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে তদবির নামক রেট। জেল গেটে দেখা করতে ভিন্ন রেট। রিমান্ড কাটাতে এক ধরনের রেট। আবার রিমান্ডে ভালো আচরণের নিশ্চয়তায় আরেক রেট। বিস্ফোরক বা অস্ত্র উদ্ধার থেকে বাঁচতে চাইলে স্পেশাল রেট।

হাতে ইসলামি বইকে ‘জেহাদি বই’ বলে ধরিয়ে দিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করা থেকে বাঁচতে চাইলে হাদিয়ার রেট। বিদেশী হত্যা বা তাজিয়া মিছিলে বোমা মামলা থেকে বাঁচার জন্য রয়েছে ভিআইপি রেট (রাজনৈতিক অনুমতিসাপেক্ষে)। জেলের ভেতর ভালো থাকতে বিশেষ রেট। ভালো খেতে আলাদা রেট। বেশি রেটে জেলের হাসপাতালে থাকারও সুবন্দোবস্ত রয়েছে। তবে ডাক্তারি সার্টিফিকেট তৈরির রেটের পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। মামলাকে হালকা করার জন্য রয়েছে এক ধরনের রেট।

চার্জশিটে নাম বাদ দেয়ায় জন্য আছে বড় ধরনের রেট। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চাইলে বিশাল রেট। ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতে চাইলে সর্বোচ্চ রেট। এ যেন এক মহাবাণিজ্য, সুবিশাল অর্থনীতি! নিরীহ মানুষের রক্ত শোষণের অদ্ভুত এক গণগ্রেফতার সংস্কৃতি। আর বড় বিচিত্র এই ‘আটক অর্থনীতি’!

তিন. গত পরশু বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম, দেশের ৬৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার, বন্দী ৭৮ হাজার। এগারো দিনে গণগ্রেফতার ৫২৫৪ জন। ধারণক্ষমতার ১৩০ শতাংশ বেশি বন্দী দিয়ে ভরে গেছে কারাগারগুলো। এদের প্রায় প্রত্যেককেই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার মানবজমিন রিপোর্ট করেছে, ১৫ দিনে গ্রেফতার ৮০০০ জন। গত ৫ নভেম্বর থেকে পুলিশের বিশেষ অভিযানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের গণগ্রেফতার চলছে। কারাগারগুলো যেন মুড়ির টিনের মতো মানুষ দিয়ে ঠেসে ভর্তি করা হচ্ছে। জেল কোড অনুযায়ী প্রত্যেক বন্দীর জন্য জায়গা বরাদ্দ থাকার কথা ৩৬ বর্গফুট। অথচ বাস্তবে এই ৩৬ বর্গফুটের মধ্যে একাধিক বন্দীকে শিফট করে ঘুমাতে হচ্ছে।

কেউ ঘুমালে অন্যদের তখন দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। একবার যৌতুক মামলায় অভিযুক্ত এক আসামি মাত্র তিন মাস জেল খেটে জামিনে বের হলে আদালত চত্বরে তার সাথে কথা হলো। সারা শরীর চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি জানালেন, জেলের ভেতর প্রচণ্ড গরমে একজনের ঘামের ওপর আরেকজনকে ঘুমাতে হয়। তার ভাগ্য ভালো ছিল, তাই তাকে রান্নাঘরে কাজ করার মতো সহজ সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। সে কারণে প্রতিদিন হাজারো কয়েদির রুটি গোলাতে গিয়ে তার হাত দু’টিতে মাত্র তিন মাসেই পচন ধরে যায়।

আসলে আমাদের বন্দী ব্যবস্থাপনার সরকারি যে বাজেট বরাদ্দ রয়েছে তা দিয়ে একটা গৃহপালিত পশুরও পুষ্টির জোগান দেয়া সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই বন্দীরা পাঁচগুণ দাম দিয়ে বাইরের খাওয়া ম্যানেজ করে। আর এই খাওয়া সাপ্লাইয়েরও রয়েছে বিশাল একটা বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট।

চার. গণগ্রেফতারের রাজনৈতিক দিকটি আরো নির্মম, নিষ্ঠুর। শুধু দলীয় সমর্থনের কারণে হাজারো মানুষ আজ কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে দিন অতিবাহিত করছে। সাথে দাড়ি-টুপি বা মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে তো দুনিয়াই যেন তার জন্য জাহান্নাম!

অজ্ঞাত আসামিদের মধ্যে সবচেয়ে ‘দামি আসামি’ এরাই। পুলিশের সাথে কিংবা স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের সাথে ঠিকমতো ‘সেটিং’ দিতে না পারলে বীভৎস সব নিষ্ঠুরতা। চাহিদামাফিক টাকার জোগান দিতে গিয়ে অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট শূন্য হয়ে গেছে। কারো কারো সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে প্রভাবশালী নেতাদের দিতে হয়েছে। আর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে যে কত শত সহস্র কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে তা সচেতন মানুষেরা সবাই জানেন। বিএনপি নেতাদের মধ্যে যাদের টাকা-পয়সা আছে, তাদের সম্পদ এখন প্রতিপক্ষের নেতাদের পকেটে। এই সুযোগে পুলিশও বেজায় খুশি। দুইটা বাণিজ্য নেতারা করলে আটটা বাণিজ্য তারা করবে না কেন? কে কাকে রুখবে? পুলিশকে দিয়ে অন্যায় কাজ করালে পুলিশকে খবরদারি করার নৈতিক ভিত্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই পুলিশও আজান দিয়েই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু অন্য দিকে সাধারণ মানুষ গণগ্রেফতার হলেও গ্রেফতার হয় না শিশুকে গুলি করা এমপি সাহেবরা। গ্রেফতার হয় না সচিবালয়ে সচিবের অফিস ভাঙচুর করা মন্ত্রীরা। হাইকোর্টের আদেশ দেয়ার পরও গ্রেফতার করা যায় না গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ মারা এমপির ছেলেকে। আসলে গণগ্রেফতারের নামে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে সরকার একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছে।

এই সুযোগে পুলিশও তাদের আখের গোছাচ্ছে। এরা জানে, ক্ষমতা চলে গেলে যখন তারা দেশ ছাড়া হবে, তখন বিদেশের মাটিতে বাড়ি-গাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্সের ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। কিংবা নতুন সরকারের দুর্নীতিবাজদের ম্যানেজ করার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকার জোগান ঠিক রাখতে হবে। আসলে যে সমস্যাটি রাজনৈতিক, তা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। প্রশাসন দিয়ে গদি রক্ষা সম্ভব হলেও রাজনীতি রক্ষা সম্ভব নয়। গত সাত বছরে আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে শুধু দলীয়করণই করেনি; দলকেও প্রশাসনিক করেছে।

প্রশাসনের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের নেতাদের মতোই কথা বলছে। আর দলীয় নেতারা প্রশাসনের মতোই হুকুম নির্দেশ দিচ্ছেন।

পাঁচ. গণগ্রেফতারের সবচেয়ে মারাত্মক দিকটি হচ্ছে, একজন নিরীহ মানুষ যখন বিনা অপরাধে জেল জীবনের করুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে, তখন রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি তার প্রবল অশ্রদ্ধাবোধের জন্ম নেয়। তাতে সে চরমপন্থার দিকে সহজেই আকৃষ্ট হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া জেল জীবনে দাগি আসামিদের সাহচর্যে নিজেকে তখন আর অপরাধ জগতের অচেনা মানুষ মনে হয় না নিজের কাছে। ‘আটক অর্থনীতির’ এই মারাত্মক কু-প্রভাবে সমাজে অপরাধবোধেরও জন্ম দিচ্ছে। আর আইনকানুন-কোর্ট কাচারির সীমাহীন ভ্রষ্টাচারের কারণেও মানুষ আজ ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’- নামক নীতিকে নিছক বাংলা সিনেমার সংলাপই মনে করছে।

আইন যখন ময়লার গাড়ি পোড়ানো মামলায় অজ্ঞাত আসামির খোঁজে প্রতিপক্ষ দলের শীর্ষ নেতাদের নিশ্চিহ্ন করায় ব্যস্ত থাকে, তখন সাধারণ মানুষ আইনকে নিছক ক্ষমতার ছড়ি হিসেবেই ভাবে। এ দেশে যে কেউ, যেকোনো সময়, যেকোনো পেন্ডিং মামলার আসামি হয়ে যখন গণগ্রেফতার হয়, তখন আইনের শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ আর অবশিষ্ট থাকে না।

‘নাশকতার অভিযোগ’ নামক রাজনৈতিক জুজু যেভাবে আমাদের রাজনীতিকে পঙ্কিল করে দিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবেই বিচারিক প্রশাসনকেও অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কোর্ট-কাচারিতে এখন আর সাধারণ চোর-ডাকাত পাওয়া যায় না। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ অপরাধীকে পর্যন্ত বিএনপি বা জামায়াত-শিবির কর্মী বানিয়ে চালান দেয়া হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় তো এখন পুরুষ মানুষ খুঁজে পাওয়াই দুরূহ ব্যাপার। এই সুযোগে দিব্যি বেঁচে যাচ্ছে পেশাদার অপরাধীরা। শুধু বিএনপি-জামায়াত নিধনে ব্যস্ত পুলিশের পক্ষে সে কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এতটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। আর সে কারণেই পুলিশ প্রধানকে বলতে শোনা যায়, ‘পুলিশের পক্ষে সবাইকে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়’।

ছয়. নভেম্বর মাসের ৫ তারিখ থেকে বিএনপি-জামাতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ৩২ জেলায় র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি দিয়ে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে হাজারো মানুষকে গণগ্রেফতার করা হচ্ছে। এই অভিযানের আগে প্রতিটি জেলার এসপিকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের লিস্ট হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা সেই তালিকা ধরে বিএনপি-জামায়াত নির্মূল অভিযানে নেমেছে। ঘরের মা-বোনদের পর্যন্ত জামায়াতের সমর্থক বলে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে চালান দেয়া হচ্ছে। এর সাথে ‘আটক অর্থনীতির’ প্রভাবে আরো হাজারো নিরীহ সাধারণ মানুষ পুলিশের খপ্পরে পড়ে কারাগারে চলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অভিযানের নামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে এসব সাধারণ নিরপরাধ মানুষই।

পুলিশ যেন প্রকাশ্যেই ‘ডেথ ওয়ারেন্ট’ নিয়ে তাড়া করছে সাধারণ মানুষগুলোকে। রাজনৈতিক কর্মীদের অবস্থাও যে এর চেয়ে ভালো তা বলা যাবে না। জামিনে মুক্তি মিললেও কারাফটক থেকে আবারো গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেকে তো এটাকেও মন্দের ভালো বলছে। কারণ গ্রেফতারের পর পুলিশ যদি আটকের কথা অস্বীকার করে বসে, তবে তো সর্বনাশ। লাশও খুঁজে পাবে না স্বজনেরা।

সাত. দেশে এখন কোনো গণ-আন্দোলন হচ্ছে না। কোনো হরতাল-অবরোধ নেই। অসহযোগ আন্দোলন তো দূরের কথা, সামান্য মানববন্ধন পর্যন্ত করার অনুমতি নেই। মাঠে সরকারের কোনো প্রতিপক্ষই নেই। শেষবারের মতো সভা সমাবেশ কবে হয়েছিল বলা মুশকিল। সরকারের সাথে আঁতাত করে ও দলকে নিষ্ক্রিয় করে কিছু নেতা সরকারের সাথে ম্যানেজ করেই তো চলছে। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাও প্রায় ভঙ্গুর। অন্য দিকে বিএনপির দুর্নীতিবাজ একটা অংশ নিজেদের লুটের মাল সামলানোয় ব্যস্ত।

জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই ফাঁসি কাষ্ঠে। বাকিরা হয় জেলে, না হয় ঘরছাড়া, আর না হয় হাসপাতালে। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার দৃশ্যমান কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না এখন। প্রতিপক্ষের কথা বলার সব মিডিয়া বন্ধ করে মিডিয়ার ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারের একক হাতে। ইতোমধ্যে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারের মতো সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কিছুই আর প্রকাশ হওয়ার রাস্তা অবশিষ্ট নেই।

তার পরও সরকারের এত ভয় কিসের? গণহারে কেন হাজারো মানুষকে এভাবে ধরপাকড় করা হচ্ছে? প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের লোকদের হাত গুটিয়ে আত্মসমর্পণ করা অবস্থায়ও কেন নিষ্কৃতি মিলছে না? বিরোধী মতধারা মনের ভেতর গোপনে ধারণ করেও রক্ষা মিলছে না কেন? বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি যাতে দল গোছাতে না পারে, তৃণমূলের সম্মেলন যাতে না ডাকতে পারে, পৌর নির্বাচনে প্রতিপক্ষরা যাতে প্রার্থিতা না দিতে পারে, আর বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে ফিরে এসে যাতে আন্দোলনের ডাক না দিতে পারে, গণগ্রেফতারের আসল উদ্দেশ্য এটাই।

অপর দিকে, কেউ কেউ বলছে, সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের জন্যই এই গণগ্রেফতার; কিন্তু সাঁড়াশি অভিযান না চালিয়েও তো সরকার প্রতিপক্ষের এসব কর্মকাণ্ড-আন্দোলন রুখতে পারে। তাই আসল কারণটা হচ্ছে ভিন্ন কিছু। অতি নিকটবর্তী অবস্থানে চলে এসেছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রমের নিষ্পত্তি। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক প্রক্রিয়াও প্রায় শেষের দিকে।

তাই গণগ্রেফতার নাটকের চূড়ান্ত সংলাপ হতে যাচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’। তবে এমন হলে দেশের মানুষকে তখন বাংলা সিনেমার ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’ সংলাপের মতো বাণী শুনিয়ে নিবৃত্ত রাখা যাবে কি না সন্দেহ আছে।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ e-mail: [email protected]

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!