DMCA.com Protection Status
title="৭

ভারতের সমর্থনেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিঁকে আছে: আনন্দবাজার পত্রিকা

modi3আনন্দবাজার প্রতিবেদনঃ কি ছু মানুষ নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেলেও সমাধানে পৌঁছতে পারে না। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নেতাদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রবল। দেখেশুনে মনে হয়, চেষ্টাটাই সব নয়। চেষ্টা করেও সমস্যা একই ভাবে জিইয়ে রাখাটা আসলে বেশ সহজ। সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে হলে চেষ্টা ও সদিচ্ছার সঙ্গে একটা সাহসও থাকা চাই। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল সমস্যা নিরসনের মাধ্যমে একই সঙ্গে সেই সদিচ্ছা ও সাহসের পরিচয় দিলেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি ও শেখ হাসিনা ওয়াজেদ।

দীর্ঘ ৬৮ বছরের আলো আঁধারি জীবনের অবসান ঘটিয়ে গত ৩১ জুলাই ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫১ হাজার অধিবাসী পেল নতুন পরিচয়। ভারতের ভেতর ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ও বাংলাদেশের ভেতর ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে জ্বলে উঠল স্বপ্নের বাতি। সূচিত হলো ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের নতুন একটি সম্ভাবনাময় পর্ব।

পরিচয়হীন মানুষগুলোকে নাগরিক মর্যাদা দানের কৃতিত্ব শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদিই পাবেন, তবে কাজটা শুধু এই দুজনের জন্য হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরেই নতুন দিগন্তের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছিল। মনমোহন সিংহ, সনিয়া গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুষমা স্বরাজ ও ছিটমহল আন্দোলনের জনক দীপক সেনগুপ্তের অবদানও মনে রাখতে হবে।

Hasina_Modiছিটমহলের চূড়ান্ত সমাধান আমাদের অন্যান্য অমীমাংসিত দ্বিপাক্ষিক সমস্যার ব্যাপারেও এখন আশান্বিত করে তুলছে। বাংলাদেশের দিক থেকে দেখতে গেলে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তি দ্বিতীয় গুরুতর সমস্যা। আবার, ভারতের দিক থেকে দেখলে, স্থল-যোগাযোগ হল পরবর্তী জরুরি চিন্তা।

স্থল-যোগাযোগের জন্য অবশ্য কলকাতা-আগরতলা বাসযাত্রা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, পরীক্ষামূলক যাত্রা হয়েছে ঢাকা-গুয়াহাটি রুটেও। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্য যাতে পিছিয়ে না থাকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেই সেটা দেখতে হবে, আলোচনায় বসতে হবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কোন দিকে এগোয় সেই আলোচনা, চুক্তি শেষ পর্যন্ত সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত তা নিয়ে বাংলাদেশের মনে অশান্তি থাকবেই।

এক দিকে তিন্তাসহ সব দ্বিদেশিক নদীর পানি যথাযথ বণ্টন, অন্য দিকে ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটানের মধ্যে অবাধ স্থল-যোগাযোগ কার্যত এই পুরো অঞ্চলটাকেই অনেকগুণ শক্তিশালী ও শান্তিপূর্ণ করে তুলতে পারে, জোরালো অর্থনীতির বুনিয়াদের উপর দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। আজ যে ভারত-বাংলাদেশ এমন দুর্দান্ত সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তা কিন্তু আদৌ অবধারিত ছিল না।

কিছু কাল আগেও দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব ছিল। অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে, এবং উলফার ঘাঁটি হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবহার নিয়ে ভারত অনেক বার অভিযোগ করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতের এই অভিযোগে তারা কর্ণপাতও করেনি। চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা বাংলাদেশেও সবাই জানে। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লিগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই কেবল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা শোনা গেল।

আজ দু’দেশের মধ্যে আস্থার যে সম্পর্ক, তার ভিত্তিটা এখানেই। তবে, ভারতের বিগত ইউপিএ সরকারের শাসনকালে আওয়ামি লিগ নানা কারণে এই জায়গাটায় পৌঁছতে পারেনি। চেষ্টা থাকলেও এখনকার মতো পুক্সখানুপুক্সখভাবে চিন্তার সাহসটাই তখন দেখা যায়নি। এই মুহূর্তে আমাদের দুই দেশের নাগরিকদের দেখে মনে হয়, গত দুই দশকে তাঁরা যথেষ্ট পরিণত হয়েছেন। সস্তা জাতীয়তাবাদী বুলিতে তাঁরা সহজে বিচলিত হচ্ছেন না। রাষ্ট্রনেতারাও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বস্তুটা আরও হিসেব করতে শিখেছেন, ছাড় না দিলে যে সমস্যার সমাধান হয় না, বোধহয় এটাও বুঝতে শিখেছেন।

বাংলাদেশে হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে, ভারত সরকারের জোরালো সমর্থনের সুবাদেই ২০১৪-র বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামি লিগ সরকার ক্ষমতায় টিঁকে গেছে। মোদীর ঢাকা সফরের সময় যে সব চুক্তি হয়েছে, স্বভাবতই এই প্রতিপক্ষের মতে তাতে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই বেশি লাভবান হয়েছে।

তবে বাংলাদেশে এমন একটা রাজনৈতিক পক্ষও আছে যারা বিশ্বাস করে আওয়ামি লিগ সরকারের উপর ভারত সরকারের ধারাবাহিক আশীর্বাদের ব্যাপারটা অনস্বীকার্য। তার হেতুটা ইতিহাসে লুকিয়ে নেই, ব্যক্তিগত সম্পর্কেও নিহিত নেই। আছে আওয়ামী লিগ সরকারের সন্ত্রাসবিরোধিতার মধ্যে। ৯/১১ পরবর্তী যুগে বিএনপি যে ভাবে জঙ্গি গোষ্ঠীদের লালন করেছে, তাতে কেবল ভারত নয়, অনেক পশ্চিমি দেশের কাছেই তাদের গ্রহণযোগ্যতা ঘোরতর প্রশ্নযোগ্য হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এটাও বুঝতে হবে যে মোদির পক্ষেও বাংলাদেশকে কোনও ধরনের অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া সহজ ব্যাপার নয়।

নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি বাংলাদেশি অভিবাসীদের সম্পর্কে যে সব কথা উচ্চারণ করেছিলেন, তার পর বাংলাদেশের প্রতি তাঁর মনোভাব নিয়ে কম সংশয় ছিল না। অথচ তাঁর সফর দেখিয়ে দিল, একটি বড় শক্তিশালীতর দেশের নেতা হিসেবে কোনও প্রতিবেশীর আতিথেয়তা কী ভাবে নিতে হয়। গোটা সফরের যেন উদ্দেশ্য ছিল একটাই: বাংলাদেশকে যে ভারতবাসী শ্রদ্ধা করে, এই বার্তাটি একেবারে স্পষ্ট করে দেওয়া। ক্রিকেট খেলা নিয়ে দুর্বলতর বাংলাদেশকে ভারতীয়দের সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যঙ্গ করার মতো লঘু ব্যাপার থেকে শুরু করে সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের গুলি করে মারার গুরুতর ঘটনায় ভারতের প্রতি বহু বাংলাদেশির মনেই অনেক দিনের জমাট ক্ষোভ।

নরেন্দ্র মোদির আচরণ কিন্তু এই উষ্মা অনেকাংশে হালকা করে দিতে পেরেছে। হতেই পারে, মোদির এই বার্তার মধ্যে অনেকটাই প্রতীক, অনেকটাই বাইরের আচরণ। কিন্তু কূটনীতিতে সেটাও জরুরি। দুটি দেশের সম্পর্ক তো শুধু নীতি কিংবা শুধু প্রতীকবাদ দিয়ে চলে না। দুটোই পাশাপাশি চালাতে হয়। কোনটা প্রকাশ্য, কোনটা প্রচ্ছন্ন, কোনটা আসল, কোনটা নকল, সে সব পরবর্তী কূটনীতিতেই বোঝা যাবে।

কিন্তু কথাটা হল, প্রকাশ্যেও যে এতখানি সংশয়ের বাতাবরণ ভেদ করে এতখানি আস্থা তৈরি করা গিয়েছে, সেটা কম কথা নয়। যে নরেন্দ্র মোদি আগে একের পর এক বাংলাদেশ-বিরোধী মন্তব্য কেেরছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিবেশী দেশে এসে সেই মোদিই বাংলাদেশের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারত-সহ ভুটান-নেপাল-শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে বাণিজ্যিক কর্মকা- শুরুর উদ্যোগের কথা বলছেন, বাইশটি চুক্তি স্বাক্ষর করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটা ‘মোমেন্টাম’ তৈরি করেছেন, এবং দেশে ফিরে সেই চুক্তি সাধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা বড় সুখবর। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের ভূমিকা ছিল দুই দেশের সম্পর্কের নতুন ভিত রচনায় প্রথম পদক্ষেপ। আর মোদির সফরকালে ভারতীয় পক্ষের নমনীয়তার প্রকাশ হল দ্বিতীয় পদক্ষেপ। ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বাস্তবায়ন হল দুই দেশের যুগপৎ অঙ্গীকার পালনের প্রথম বাস্তবায়ন।

আশা করা যাক, এই পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার হাওয়াটা থাকতে থাকতেই তিস্তার পানিবণ্টন এবং স্থল যোগাযোগের বিষয়ে অগ্রসর হওয়া যাবে। কে জানে, ভবিষ্যতে হয়তো সুযোগ সমান ভাবে বজায় রাখা যাবে না। সুতরাং এখনই এগোনো ভাল। কেবল দুই দেশের জন্যই তো নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই এটা একটা বিরল সুযোগ।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!