DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

যেভাবে দারোয়ান থেকে কোটিপতি গডফাদার হলেন পটিয়ার ডাকু জাহাঙ্গীর

dakuদৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃপশ্চিম পটিয়ার কর্ণফুলী থানাধীন পাঁচটি ইউনিয়নের ত্রাসখ্যাত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ডাকু জাহাঙ্গীর। খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, নারী ধর্ষণ, গরুর বাজার ও বালুর ব্যবসা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে ২০ বছরে নিজেকে যেমন এলাকার ‘গডফাদার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তেমনি বনেছেন বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক।

 

অতীতে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও সম্প্রতি আওয়ামী লীগের থানা এডহক কমিটির পদ বাগিয়ে নিয়ে নিজের প্রভাবকে আরও পাকাপোক্ত করেছেন। তার প্রতিবন্ধকতার কারণে শিকলবাহা এলাকায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাথর ও বালু সরবরাহের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঠিকাদারি কাজে অংশ নিতে যাওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের অপর একটি গ্রুপের ওপর হামলা করে জাহাঙ্গীর ও তার লোকজন। এ ঘটনায় দায়ের করা ১০ লাখ টাকার একটি চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তার লোকজন ৮ ঘণ্টার জন্য অচল করে দেয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক।

 

নতুন করে আলোচনায় আসে জাহাঙ্গীরের নাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাহাঙ্গীর ও তার লোকজনের নেতৃত্বে ৬টি গ্রুপে রয়েছে কয়েক হাজার সদস্য। এসব গ্রুপ পুরো কর্ণফুলী এরাকার মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে।

 

জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান যেভাবে : পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্র জানায়, কর্ণফুলী এলাকায় চৌকিদার নেছার আহমদ হত্যাসহ প্রায় এক ডজনের বেশি মামলার আসামি জাহাঙ্গীর আলম। কর্ণফুলী থানার শিকলবাহা এলাকার আবদুল জলিল সারেংয়ের ছেলে। এক সময় কর্ণফুলীর ঘাটে ঘাটে নৌকা থেকে টাকা তুলতেন। এরশাদ সরকারের আমলে কর্ণফুলী সেতু নির্মাণের পর দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা এলাকায় গড়ে ওঠে শিল্প কারখানা। ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে এস আলম স্টিল মিলে সিকিউরিটি গার্ড বা দারোয়ানে চাকরি নেন। চাকরি বেশি দিন টেকেনি। সিকিউরিটি গার্ড হয়েও স্টিল মিলের মালামাল সরিয়ে ফেলার অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন। এরপর চাক্তাই থেকে নৌকাযোগে বিভিন্ন পণ্য জেলার প্রত্যন্ত আঞ্চলে যাওয়ার সময় নৌকায় হানা দিতেন। এভাবে একটি নৌকা থেকে ৮ বস্তা চাল গায়েব করার ঘটনা ধরা পড়ায় আবছার নামে এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করলে তাকে ছুরিকাহত করে জাহাঙ্গীর আলমের লোকজন। তখন থেকেই জাহাঙ্গীরের নাম প্রচার পেতে শুরু করে।

 

এরই মধ্যে ’৯৭ সালে একবার শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর আলম। পরে কর্ণফুলী ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের বালু বিক্রির মাধ্যমে কর্ণফুলীর উত্তর তীরে বাস্তুহারা বস্তি ভরাট, দক্ষিণ তীরে সরকারি জায়গায় বালু বিক্রির কেন্দ্র স্থাপন, মইজ্জার টেক এলাকায় গরুর বাজারের নিয়ন্ত্রণ, দক্ষিণ চট্টগ্রামে চলাচলকারী যানবাহন থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় প্রভাব খাটিয়ে কাজ নেয়াসহ নানাভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করতে থাকেন।

 

দারোয়ান থেকে বনে যান কোটিপতি। সব শেষে শিকলবাহায় নির্মাণাধীন ২২৫ মেগাওয়াট ডুয়েল-ফুয়েল কম্বাইন্ড পাওয়ার প্লান্টের ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে কয়েকশ’ কোটি টাকার বালু ও পাথর সরবরাহ কাজ হচ্ছে। এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও নেন জাহাঙ্গীর আলম।

 

এখানে ঠিকাদারি ব্যবসা করতে আসায় স্বয়ং পটিয়া আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ভাই মুহিবুল্লাহ চৌধুরী নবাবের ওপর হামলা করেন জাহাঙ্গীর। ১৩ মে পটিয়া থানা পুলিশ তাকে পোস্ট অফিস এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তার বাহিনীর লোকজন কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্জারটেক এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরদিন আদালতে সোপর্দ করলে জামিনে ছাড়া পান তিনি।

 

অভিযোগ আছে, একজন প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদ থাকায় জাহাঙ্গীর আলম দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন জাহাঙ্গীর। এ সড়কে চলাচলকারী যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছ থেকে মাসিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়। পরিবহনে চাঁদা আদায়কালে গত বছরের ২১ মে বাকলিয়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় রফিক ওরফে ধামা রফিক নামে এক সন্ত্রাসী। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রফিক জানায়, সে জাহাঙ্গীরের নির্দেশে চাঁদা আদায় করছিল। জাহাঙ্গীরকে টাকা না দিলে ওই চালকের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। এ টাকায় তিনি বনে যান বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক।

 

শিকলবাহা এলাকায় বিপুল ভূসম্পত্তি ক্রয়, শতাধিক ডেইরি ফার্ম, গরুর বাজার, এস্কেভেটর বুলডোজার ব্যবসা গড়ে তোলার পাশাপাশি শিকলবাহায় নির্মাণ করছেন আলিশান বাড়ি।

 

সন্ত্রাসী তালিকায় জাহাঙ্গীরের নাম : ২০০৭ সালে সিএমপির ১২ থানায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের থানাভিত্তিক যে তালিকা হয় ওই তালিকায় কর্ণফুলী থানার শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে রয়েছে জাহাঙ্গীর আলম ও ওরফে ডাকু জাহাঙ্গীরের নাম। নতুন করে আর কোনো তালিকা না হওয়ায় এ অবস্থানেই রয়েছে তার নাম। একই সময়ে সিএমপি ৩৯৬ শীর্ষ সন্ত্রাসীর যে তালিকা করে তাতেও রয়েছে তার নাম। সর্বপ্রথম বন্দর থানায় চাল চুরির একটি মামলা হয় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে।

 

এর পর থেকে বিভিন্ন অপকর্মের কারণে জাহাঙ্গীরের মামলার তালিকা দীর্ঘ হয়। পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। খুন, ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়। কর্ণফুলী থানায় ৮টি মামলা হয়েছে। চান্দগাঁও এবং পটিয়া থানায়ও মামলা হয়েছে। লামা থানার একটি মামলায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে জেলে যান জাহাঙ্গীর ।

 

সম্প্রতি পটিয়া উপজেলার শিকলবাহায় নির্মাণাধীন ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাথর, বালু সরবরাহের ঠিকাদারি বাগিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন জাহাঙ্গীর। অন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না তার বাহিনীর লোকজন। এ জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে তার কর্মীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

 

২০১২ সালে শিকলবাহা ইউনিয়নের বাংলাপাড়া এলাকায় এক দরিদ্র পরিবারের স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। পরে অত্যাচার-নির্যাতন বেড়ে গেলে পুরো পরিবারটি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। একই বছর পটিয়া শিকলবাহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম বকুলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাটের পাশাপাশি তার ব্যবহৃত গাড়ি পুড়িয়ে দেয় জাহাঙ্গীর ও তার লোকজন। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান আবুল কালাম বকুল বাদী হয়ে পটিয়া থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা করেন। ২০০১ সালে কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক এলাকায় শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার নেছার আহমদ খুন হন।

 

এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগেও মামলা হয় জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ক্যামেরা পারসন শফিক সাজিবের ওপর হামলা করে জাহাঙ্গীর। জনৈক মোস্তাফিজুর রহমান ও কামাল উদ্দিন আহমদের কাছ থেকে কৌশলে মইজ্জারটেক এলাকার বৃহৎ গরু বাজারের জায়গা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

 

জাহাঙ্গীর আলম যা বলেন : এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, রাজনীতি করতে গিয়েই তিনি প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন । এ কারণে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা হয়েছে। তিনি এ রকম আটটি মামলার কথা স্বীকার করে বলেন, বেশির ভাগ মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন এবং জামিনে আছেন। রাজনৈতিকভাবে এলাকায় হয়রানি ও হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যই প্রতিপক্ষের লোকজন বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ তুলে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!