DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

পাকিস্তানকেও বাংলাওয়াশ : ‘চুনকাম’ লেপে দিলো বাংলাদেশ

bct ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ প্রত্যাশিত বাংলাওয়াশ, নির্ভেজাল বাংলায় যাকে বলে ‘চুনকাম’ তাই লেপে দিলো পাকিস্তানকে। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে শেষের ম্যাচেও বুধবার ৮ উইকেটে জয় বাংলাদেশের।

 

আগুনের শক্তি কি আলোতে, না দহনে? সৃষ্টিশীলতায় তা যদি হয় আলো, দহনে অবশ্যই ধ্বংস! বুধবার বাংলাদেশিরা সৃষ্টিশীলতায় আলোতেই উজ্জ্বল হলো। ক্রিকেটারদের এমন কৃর্তিতে বিশ্বজুড়ে আরো উজ্জ্বল বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তান যে অঙ্গার হলো দহনে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের তেজস্বীতায় পুড়ে গেল পাকিস্তানের গৌরব ও অহমিকা।

 

বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষের প্রত্যাশিত ‘বাংলাওয়াশ’টা করেই দিলো টাইগাররা। বাংলাওয়াশটা শুধু নামেই নয় গৌরবেরও। সেই সাথে ইতিহাসও। প্রথমবারের মতো টানা দুই সিরিজে বাংলাওয়াশ করলো বাংলাদেশ। প্রথমবার ওয়াশ হয় গত বছর শেষ দিকে জিম্বাবুয়ে আর এরপর বিশ্বকাপ থাকায় আর কোন দ্বিপাক্ষিক সিরিজি খেলেনি টাইগাররা। আর বিশ্বকাপ শেষে এই প্রথম পাকিস্তানের সাথে সিরিজ খেলেই আরেকটি ওয়াশ করে ইতিহাসে জায়গা করে নিলো বাংলাওয়াশ।

 

এর আগেও নয়বার বিভিন্ন দেশকে এ লজ্জা দিয়েছেন বাংলাদেশিরা, তবে এবারই প্রথম এমন লজ্জা পেলো পাকিস্তান। কি ব্যাটিং আর কি বোলিং বাংলাদেশের উন্নতিটা চোখে পড়ার মতোই। তিন উইকেটে পাকিস্তান সংগ্রহ করে ২০৩ রান। বাকি সাত উইকেট হারিয়েছে ৪৭ রানে! ব্যাটিংয়েও যে সাফল্য রয়েছে টাইগারদের। প্রথম বারের মতো ওয়ানডে সেঞ্চুরি করলেন সৌম্য সরকার।

 

গল্প নয়, এ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সাফল্যের কাব্যকথা। যে বাংলাদেশ প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখে একদিন ‘আমরা করবো জয়’ এই বিশ্বকে। আপাতত বিশ্বজয় না হলেও বিশ্বের বড় বড় দলগুলোকে ঠিকই হারাচ্ছে বাংলাদেশ। যেখানে জয়ের সাথে মিশে থাকছে ইতিহাসও। বিজয়ের পর ড্রেসিং রুমে ‘আমরা করবো জয়’ এই গানটা নিয়মিতই গাইতো ক্রিকেটাররা। এখন সে সব অতীত। সময় এসেছে এখন কিছু করে দেখানোর। যেখানে এখন অনেক বড় দলকে হারানোর পরও যেন বাংলাদেশের মনে হয় এ আর এমন কি! কোন নির্দিষ্ট বোলার বা ব্যাটসম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে না গোটা দল। কেউ না কেউ দলের হাল ঠিকই ধরে নেন। এ যেন সত্যিই এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ বদলানো ক্রিকেট দল। যেখানের গত বছরও ছিল ব্যর্থতার হিড়িক শুধু শেষের দিকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাফল্যই ছিল বাংলাদেশের। আর এর পরের গল্পটা সবারই জানা।

 

বিশ্বকাপের অভাবনীয় সাফল্য। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সর্বশেষ পাকিস্তানকে ‘বাংলাওয়াশ’। বিশ্বের অনেক দল বাংলাদেশের কাছে হারলেও এই একটি মাত্র দল কোন না কোন ভাবে ফসকে যেতো বাংলাদেশের কাছ থেকে। তাইতো গত ষোলটি বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় ছিলো অধরা। আর যখন জয় ধরা দিলো কি বার্তাই না নিয়ে আসলো! যেন গত ষোলটি বছর এমন একটি সাফল্যে পুষিয়ে দিলো, ভরিয়ে দিলো বাঙালির মন-প্রাণকে।

 

পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা এবং বাংলাদেশের আরেকটি জয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন টাইগারদের।

 

গৌরবের জয় পেতে টাইগারদের করতে হবে ১৫১ রান এমন স্কোর দেখেই মাঠে নামে দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। ক্রিকেটীয় ব্যাকরন মেনে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন দুই ওপেনার। ২০ ওভার শেষে পাকিস্তান যেখানে ৯৯ রান এক উইকেট হারিয়ে সেখানে বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ৯৬ রান। মনে একটা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দেখেশুনে ব্যাট চালিয়েছেন এই জুটি। যেখানে সৌম্য সরকার তুলে নেন দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরি। ২৫ ওভার ৩ বলে দলীয় ১৪৫ রানে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। জুনায়েদ খানের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ব্যক্তিগত ৬৪ রানে সাজঘরে ফেরেন আগের দুই ম্যাচে টানা দুটি সেঞ্চুরি করা তামিম ইকবাল।

 

তামিমের পর সৌম্য সরকারের সাথে জুটি গড়েন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। একই বোলার ব্যক্তিগত চার রানে ফিরিয়ে দেন মাহমুদউল্লাহকে। দলীয় রান তখন ১৫৪। সৌম্য কে সঙ্গ দিতে মাঠে নামেম মুশফিকুর রহিম। এই জুটি ভাঙার চেষ্টা যখন চালাচ্ছেন পাক বোলাররা ততক্ষণে নিজের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি উঠিয়ে নিয়েছেন সৌম্য সরকার। আযাহার আলীর বলে ছয় মেরে উল্লসিত হয়ে উঠলেন সৌম্য। প্রথম সেঞ্চুরি বলে কথা! তবুও উল্লাসটা যেন একটু কমই হলো আসল রোমাঞ্চ তখনো বাকি যা বিজয়ের উল্লাস। এর আগে রোদেলা দুপুরে শেষ ওয়ানডেতে টসে জিতে পাকিস্তান ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন আর বাংলাদেশকে ২৫১ রানের টার্গেট ছুড়ে দেয়। ৪৯ ওভারে ২৫০ রানে অল আউট হয় পাকিস্তান।

 

গতকাল বুধবার দুপুরে টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ইনিংসের শুরুটাও ভালই ছিল পাকিস্তানের। দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান আজহার আলী ও সামি আসলামের ধীরস্থির সূচনায় কিছুটা হলেও স্বস্তি আসে সিরিজ খোয়ানো পাকিস্তান শিবিরে। তবে অধিনায়ক আজহার আলীর সেঞ্চুরির পর দুইশ পেরোনো পাকিস্তান পথ হারিয়ে ফেলে। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানো পাকিস্তানের ইনিংস থামে ২৫০ রানে। এর আগে ১৭ ওভার পাঁচ বলে উদ্বোধনী জুটি থেকে ৯১ রান আসে পাকিস্তানের। ১৮তম ওভারের শেষ বলে টাইগারদের পক্ষে প্রথম আঘাত হানেন নাসির। উইকেট কিপার মুশফিকুর রহিমের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান অভিষিক্ত সামি আসলাম।

 

উদ্বোধনী এ ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সংগ্রহ তখন ৪৫ রান। আসলাম আউটের পর উইকেটে আসা অলরাউন্ডার মোহাম্মদ হাফিজ দ্রুত ফিরে গেলে কিছুটা চাপে পড়ে পাকিস্তান। আজহারের সঙ্গে ১৪ রানের ছোট্ট জুটিতে হাফিজের অবদান ছিল মাত্র ৪ রান। ১০৫ রানে আরাফাত সানির বলে বোল্ড ফিরে যান আগের দুই ম্যাচে ব্যর্থ হাফিজ। হাফিজ আউটের পর উইকেটে আসা হারিস সোহেলের সঙ্গে জুটি বাধেন অধিনায়ক আজহার আলী। ১৭ ওভার দুই বল খেলে ৯৮ রানের জুটি গড়েন দুই ব্যাটসম্যান। এর মধ্যেই ওপেনিংয়ে নামা আজহার তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। তবে শতরান পূর্ণ হওয়ার পর দ্রুতই বিদায় নেন আজহার, একই সঙ্গে স্বস্তি ফিরে টাইগারদের মধ্যে। সাকিবের বলে বোল্ড হওয়ার আগে ১১২ বলে ১০১ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলে পাকিস্তানের ভিত্তি গড়ে দেন অধিনায়ক আজহার। আজহার আউটের পরপরই মাশরাফির বলে বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হন হাফ সেঞ্চুরি করা হারিস সোহেল। ৫৮ বলে ৫২ রান করে আউট হয়েছেন প্রথম ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করা এ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। দলীয় রান তখন ৩৯ ওভার ২ বলে ২০৭। আজহার আউটের পর উইকেটে আসা মোহাম্মদ রিজওয়ানও টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ। ১২টি মোকাবেলা করে মাত্র ৪ রানে করেই ফিরে যান তিনি। ২১৩ রানের মাথায় নিজের বলে নিজেই ক্যাচ নিয়ে রিজওয়ানকে ফিরিয়েছেন সাকিব। দুই ওভার পর ২২৪ রানের মাথায় ষষ্ঠ উইকেটের পতন ঘটে পাকিস্তানের।

 

৪৪তম ওভারের প্রথম বলে নাসির হোসেনের তালুবন্দী হয়ে সাজঘরের রাস্তা ধরেন ফাওয়াদ আলম। মাশরাফির বলে আউট হওয়ার আগে তার সংগ্রহ ছিল ৪ রান। দুই উইকেটে ২০২ থেকে ২২৪ রানে ছয় উইকেট হয়ে যায় পাকিস্তানের। সব মিলিয়ে পাকিস্তানকে চেপে ধরে টাইগাররা। ২২৪ রানে ষষ্ঠ উইকেট পতনের পর কিছুটা বিরতি আসে পাকিস্তানের উইকেট পতনে। উইকেটে তখন গত ম্যাচে ঝড়ো হাফ সেঞ্চুরি করা ওয়াহাব রিয়াজ ও উমর গুল। তবে তেমন কিছু করে দেখাতে পারেন নি ওয়াহাব। ৪৬তম ওভারের শেষ বলে ২৪৩ রানের মাথায় ফিরে যান এ পেসার। রুবেলের বলে মাশরাফির তুলুবন্দী হওয়ার আগে আজ ৭ রান করেন ওয়াহাব।

 

চার বল পরে দলীয় স্কোর বোর্ডে মাত্র এক রান যোগ হতেই ফিরে যান উমর গুল। সাকিব ও আরাফাত সানির যৌথ প্রচেষ্ঠায় রান আউটের আগে এ পেসার রানের খাতাই খুলতে পারেন নি। উইকেটে তখন পাকিস্তানের শেষ আশা সাদ নাসিম। রুবেলের বলে তাসকিনের হাতে ক্যাচ দেওয়ায় আগে ২২ রান করেন সাদ। ২৫০ রানের মাথায় শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন জুনাইদ খান। পাকিস্তান দলে তিনটি পরিবর্তন এসেছে। দলে এসেছেন উমর গুল, জুলফিকার বাবর ও সামি আসলাম। বাদ পড়েছেন রাহাত আলি, সাইদ আজমল ও সরফরাজ আহমেদ।

 

জিম্বাবুয়ে, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর টেস্টখেলুড়ে দেশ পাকিস্তান প্রত্যেকেই বাঘের ডেরায় এসে সাক্ষাৎ বাঘেরই দর্শন পেল। দেখে নিল মাশরাফিদের জার্সির লোগোতে থাকা বাঘের চেহারার মতোই মাঠেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে টাইগাররা। চুনকামের মঞ্চ যে দুইম্যাচ জিতে আগেই তৈরি ছিল শুধু লেপে দেয়া ছিল বাকি!

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!